শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ইসরায়েলে মুসলিম স্থাপনা

সাইফ ইমন

ইসরায়েলে মুসলিম স্থাপনা

১৯৪৮ সালে আমূল পাল্টে যায় ফিলিস্তিনিদের জীবনের সব কিছু। ওই বছরের ১৪ মে বিশ্ব ইহুদি সংগঠনের প্রধান ডেভিড বেন গুরিয়ন ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। দিনটিকে ইসরায়েলিরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।  ১৫ মে দিনটিকে ‘নাকবা’ বা ‘মহাবিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে ফিলিস্তিনিরা। বিতাড়িত করা হয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের। আর যারা রয়ে যায় তারা বসবাস করছে ইসরায়েলি মুসলমান হিসেবে।  ইসরায়েলে মুসলিম স্থাপনা নিয়ে আজকের রকমারি...

 

মুসলমানদের প্রথম কিবলা

মসজিদ আল-আকসা

ইসলামের অন্যতম পবিত্র মসজিদ বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদ আল-আকসা। ইসরায়েলের চোখে এটি টেম্পল অব মাউন্ট। অসংখ্য নবী-রসুলের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক জেরুজালেম শহরে এই মসজিদ আল-আকসা অবস্থিত। বর্তমানে ইহুদিরা দখল করে রেখেছে এই পবিত্র মসজিদ। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আল-আকসা চত্বরে আজও অসংখ্য নবী-রসুলের সমাধি বিদ্যমান। মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেকেরই অজানা। ইসলাম ধর্মের নবী হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কর্তৃক পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর নাতি বনি ইসরাইলের প্রথম নবী হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ঐতিহাসিক শহর জেরুজালেমে মসজিদ আল-আকসা নির্মাণ করেন। ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী হজরত সুলায়মান (আ.) জিন জাতির মাধ্যমে এ পবিত্র মসজিদ পুনর্র্নির্মাণ করেন। ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি মুসলমানদের অধীনে আসে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এ মসজিদটি মুসলমানদের কিবলা হিসেবে ব্যবহার হয়েছিল। খলিফা ওমর (রা.) বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্র্র্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। এই সংস্কার ৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদের শাসনামলে শেষ হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্র্নির্মাণ করেন। পরে তাঁর উত্তরসূরি আল মাহদি এর পুনর্র্র্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতেমীয় খলিফা আলী আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে। বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদটিতে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙ্গিনা, মিম্বর, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো। ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করার পর মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং একই প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাত আস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম জয় করার পর মসজিদ  হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়।

 

১৭ মসজিদ এখন হোটেল-সিনেমা হল

ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পরই ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে নৃশংসতা আরও বাড়িয়ে দেয় ইহুদিরা। যাতে স্পষ্টভাবে সমর্থন দেয় ব্রিটেনসহ পশ্চিমারা। ওই সময় ফিলিস্তিনের অর্ধেক বাসিন্দা জীবন বাঁচাতে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এভাবেই চলে আসছে হতভাগ্য ফিলিস্তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জীবন। অথচ এক সময় ইসরায়েলের নানা স্থানে দৃষ্টিনন্দন নানা মসজিদ ছিল। যা একে একে বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার। সেখানকার ১৭টি মসজিদ তারা পরিণত করেছে হোটেল এবং সিনেমা হলে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের সূচনা ঘটে ১৯৪৮ সালে। তখন আমূল পাল্টে যায় ফিলিস্তিনিদের জীবনের সব কিছু। ওই বছরের ১৪ মে বিশ্ব ইহুদি সংগঠনের প্রধান ডেভিড বেন গুরিয়ন ফিলিস্তিনের ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেন। দিনটিকে ইসরায়েলিরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে। ১৫ মে দিনটিকে ‘নাকবা’ বা ‘মহাবিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে ফিলিস্তিনিরা। ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণার পরই ফিলিস্তিনিদের তাড়াতে নৃশংতা আরও বাড়িয়ে দেয় ইহুদিরা। যাতে স্পষ্টভাবে সমর্থন দেয় ব্রিটেনসহ পশ্চিমারা। ওই সময় ফিলিস্তিনের অর্ধেক বাসিন্দা জীবন বাঁচাতে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ফিলিস্তিনের অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের মতো টাইবেরিয়াসের বাসিন্দারাও সে সময় সিরিয়া, লেবাননে আশ্রয় নেন। কমিটি ফর আরব সিটিজেন অব ইসরায়েলের মুখপাত্র কামাল খতিব তুর্কি গণমাধ্যম আনাদোলুকে জানান, জায়াদানি পরিবারও সে সময় পার্শ্ববর্তী নাজারেথ শহরে চলে যায়। ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করে তাদের ঘরবাড়ি, সহায় সম্পত্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় ইহুদি দখলদাররা। যাতে অন্তর্ভুক্ত হয় বহু ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০টি মসজিদ ইসরায়েলিরা ধ্বংস করে দিয়েছে বা সেগুলোতে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। আরও ১৭টি মসজিদকে মদের দোকান, হোটেল, জাদুঘর, সিনেমা হলে পরিণত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, উত্তরাঞ্চলীয় সাফেদ শহরের আল আহমার মসজিদকে কনসার্ট হলে  রূপান্তর করা হয়েছে।

 

হাইফা কাবাবির দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

মাহমুদ মসজিদ ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা নির্মাণ করেছিল। মাহমুদ মসজিদ ইসরায়েলের হাইফা কাবাবি অঞ্চলের একটি মসজিদ। মাহমুদ মসজিদটি ১৯৩১ সালে বা ১৯৭০ এর দশকে কার্মেল পর্বতে নির্মিত হয়েছিল। প্রতিশ্রুত মসিহ মির্জা বাশির-উদ-দ্বীন মাহমুদ আহমদের দ্বিতীয় খলিফার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। তিনি ছিলেন আহমদিয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার পুত্র। তাকে ‘প্রতিশ্রুত সংস্কারক’ হিসেবেও অনেকে বলে থাকেন। মসজিদে দুটি সাদা মিনার রয়েছে যা ৩৫ মিটার লম্বা কাছাকাছি উপত্যকাগুলোতে আবাসিক প্রতিবেশগুলোর আকাশ লাইনে আধিপত্য বিস্তার করে। মসজিদটি নির্মাণের জন্য স্থানীয় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা সবাই একসঙ্গে অর্থায়ন করেছিলেন। পরবর্তীতে এই মসজিদকে ঘিরেই তাদের সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে। ১৯২৮ সালে বেশির ভাগ বাসিন্দা আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

 

জেরুজালেমে অবস্থিত ওমর মসজিদ

জেরুজালেমে অবস্থিত ওমর মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয় ১১৯৩ খ্রিস্টাব্দে। এটি চার্চ অব দ্য হোলি সেপালচারের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। মসজিদের মিনারটি চার্চ অব দ্য হোলি সেপালচারের প্রাঙ্গণেই। ৬৩৭ সালে আবু উবাইদাহ ইবনে আল-জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সেনাবাহিনী জেরুসালেম অবরোধের সময় পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস শুধু খলিফা ওমর (রা.) ছাড়া আর কারও কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানান। ওমর (রা.) এরপর জেরুসালেম আসেন ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তিনি চার্চ অব দ্য হোলি সেপালচার পরিদর্শন করেন। সফ্রোনিয়াস এ সময় তাঁকে গির্জার ভিতর নামাজ পড়ার আমন্ত্রণ জানালে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, এমনটা করলে এই উদাহরণ ভবিষ্যতে এই গির্জার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এর বদলে তিনি বাইরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নামাজ পড়েন। এখানে নবী দাউদ (আ.) নামাজ পড়েছেন বলে বিশ্বাস করা হয়। এখানেই নির্মাণ করা হয় মসজিদটি।

 

সুলাইমান পাশার তৈরি

শ্বেত মসজিদ

শ্বেত মসজিদ নামে খ্যাত এই মসজিদটি তৈরি করেন সুলতান সুলাইমান পাশা। ইসরায়েলের নাসরত অঞ্চলের প্রাচীনতম মসজিদ এটি। এর সূ² পেনসিল-আকৃতির মিনার, ক্রিম বর্ণের দেয়াল, সবুজ অলংকরণ এবং সবুজ গম্বুজ পুরো শহরজুড়ে উসমানীয় স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। মসজিদটি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে তৈরি হয়েছিল। এই মসজিদের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন হাই কমিশনার শেখ আবদুল্লাহ আল-ফাহুম। সুলাইমান পাশার পূর্বসূরি উসমানীয় প্রাক্তন গভর্নর জিজার পাশার শাসনের সমাপ্তি উপলক্ষে শেখ আবদুল্লাহ এই মসজিদটির নামকরণ করেছিলেন।

১৮০৪ থেকে ১৮০৮ সালের মধ্যে মসজিদটির নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। শেখ আবদুল্লাহর সমাধি মসজিদের প্রাঙ্গণেই রয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পরে মসজিদটির পরিচালনার দায়িত্ব শেখ আমিন আল-ফাহুমের ওপর ন্যস্ত করা হয়। বর্তমানে মসজিদটি আল-ফাহুম পরিবারের ওয়াকফের অংশ হিসেবে অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এটি শেখ আবদুল্লাহর বংশধর আতিফ আল-ফাহুম দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। শেখ আবদুল্লাহ নাসরতে বিশ্বাসীদের মধ্যে উপভোগ্য করে তোলার জন্য পবিত্রতা, আলো এবং শান্তির নতুন যুগের প্রতীক হিসেবে  সাদা রং বেছে নিয়েছিলেন।

 

সমুদ্রের পাশে দৃষ্টিনন্দন আল-বাহার মসজিদ

আল-বাহার মসজিদ। এর অবস্থান ইসরায়েলের জাপার অঞ্চলে। আল-বাহার মসজিদ নামকরণের অর্থ দ্য সি মসজিদ। এটি সমুদ্রসৈকতের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এই নামকরণ। মৎস্যজীবী ও নাবিকরা এ অঞ্চলের আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে নামাজ পড়েছিলেন। ইসরায়েল সরকার দখলের পর থেকে মুসলমানদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। নামাজের উদ্দেশ্যে বা পরিষ্কার রাখার জন্যও কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। ১৬ শতকের এই মসজিদটি ইসরায়েলের অন্যতম একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। ১৯৯৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিম তীর এবং গাজার আংশিক নিয়ন্ত্রণ পায় ফিলিস্তিনিরা। তবে তাদের স্বাধীনতার  স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে।

 

নতুন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার

নাম না জানা মসজিদ

ইসরায়েলের মরু এলাকায় ১ হাজার ২০০ বছরের পুরনো একটি মসজিদ আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এটিকে ইহুদি দেশটিতে আবিষ্কৃত সবচেয়ে পুরনো মসজিদ বলে ধারণা করা হচ্ছে। দক্ষিণ ইসরায়েলের নেগেব মরুভূমিতে ওই মসজিদ আবিষ্কারের ঘোষণা দেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। বিরল আবিষ্কারটি হয়েছে রাহাত অঞ্চলের বেদুইন শহরে। মসজিদটি খনন কাজের দায়িত্বে থাকা জন সেলিগম্যান ও শাহার জুর বলেছেন, ‘এটি একটি ছোট শহুরে মসজিদ। নির্মাণের সময় সপ্তম অথবা অষ্টম শতক হওয়ায় এটি পৃথিবীর মধ্যে বিরল আবিষ্কারের মধ্যে পড়তে পারে। নেগেব মরুভূমির সবচেয়ে বড় শহর বায়ের এলাকার উত্তরে এ ধরনের পুরনো স্থাপনা এর আগে আবিষ্কৃত হয়নি। চতুর্ভুজ আকৃতিতে নির্মাণ করা হয় ভবনটি। মক্কার দিকে ফেরানো মেহরাব দেখে এটিকে মসজিদ হিসেবে চিহ্নিত করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। তাঁরা মনে করছেন, ওই এলাকায় কৃষি খামার আবিষ্কৃত হওয়ায় কৃষকরাই মসজিদটি ব্যবহার করতেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গিদিওন আবনি বলেন, এটি বর্তমান ইসরায়েল এলাকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদগুলোর একটি। ৬৩৬ সালে এলাকাটি জয় করেছিলেন আরবরা। এর পরই সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। সে সময়ের অনেক মসজিদের কথা ইতিহাসে রয়েছে; যার একটি এই নাম না জানা পুরনো মসজিদটি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর