শুক্রবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বসেরা মুসলিম অভিযাত্রী

সাইফ ইমন

বিশ্বসেরা মুসলিম অভিযাত্রী

নতুনকে জানার আগ্রহ মানুষের দীর্ঘদিনের। এই আগ্রহ নিয়েই সুদূর মরক্কোর তানজিয়ের থেকে পৃথিবী দেখার নেশায় ঘর ছেড়েছিলেন ২১ বছর বয়সের এক মুসলিম যুবক। তিনি ইবনে বতুতা। মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, ইরান, বসরা, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ঘুরে এসেছিলেন আমাদের বাংলায়ও। ইবনে বতুতার মতো আরও অনেক মুসলিম ইতিহাসবিদ ও পর্যটক ভ্রমণ করেছেন বিশ্ব।  এ রকম আলোচিত কয়েকজন পর্যটকের ভ্রমণ জীবন নিয়ে আজকের রকমারি-

 

মুহাম্মদ ইবনে বতুতা

এই মহান পরিব্রাজক অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে, তিনবার হজ করে তার জন্মভূমিতে ফিরেছিলেন ৩০ বছর পর

আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা ছিলেন মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ ও বিচারক। তিনি ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মরক্কোর তানজিয়েরে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এক ঐতিহাসিক নাম ইবনে বতুতা। বিশ্ববিখ্যাত এই ভ্রমণপিপাসু ঘুরে বেড়িয়েছেন আফ্রিকা থেকে ভারত উপমহাদেশ, ভারত থেকে তুরস্ক পর্যন্ত। এমনকি বাংলাদেশেও তাঁর পদচিহ্ন পড়েছিল। তিনি বিশাল এ পথ পাড়ি দিতে কখনো পেরিয়েছেন নদীপথ, কখনো উটের কাফেলায়, আবার কখনোবা হেঁটে। ২১ বছর বয়স থেকে তাঁর এ ভ্রমণ শুরু। এরপর প্রায় ৩০ বছর বিশ্বভ্রমণ করেছেন। অনেকে মার্কো পোলোকে তাঁর সমকক্ষ মনে করেন। তবে মার্কো পোলোর চেয়ে ইবনে বতুতা বেশি অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। এ কারণে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ইবনে বতুতাকেই বিশ্বের সেরা ভ্রমণকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বিশ্ব ভ্রমণের সময় তিনি জীবনের অনেকটা সময় কাজির চাকরি করেছেন, মন্ত্রীর মেয়ের পাণি গ্রহণ করেছেন। এমনকি কখনো রাষ্ট্রদূত, কখনো সেনাকমান্ডের দায়িত্বও পেয়েছেন। বেশির ভাগ ভ্রমণে ইবনে বতুতার সঙ্গে কাফেলা ছিল। তিনি নিজে একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা কাজির পেশায় ছিলেন। ফলে তিনি যে দেশে গেছেন সেখানেই রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছেন। নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিশেষ প্রয়োজনে তিনি কখনো কখনো পরিচয় গোপন করেছেন এবং কূটনৈতিক কারণে ভিন্ন নামও ব্যবহার করেছেন। চীনে তাঁর নাম ছিল শামসুদ্দিন এবং ভারতে তার নাম ছিল মাওলানা বদর উদ্দিন। ইবনে বতুতা সারা জীবন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন। পৃথিবী ভ্রমণের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি। প্রথম তিনি পবিত্র হজ পালন করার জন্য মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। জীবনের পরবর্তী ৩০ বছর তিনি প্রায় ৭৫ হাজার মাইল (১ লাখ ২০ হাজার কি.মি.) অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি সে সময়ের সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। সে সময়ের সুলতানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কথা লিখে গেছেন। তিনি যেমন মহান মুসলিম শাসকদের গুণগান করেছেন তেমনি অত্যাচারী শাসকদের বর্বরতার কথাও লিখেছেন। বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন। তার কিছুকাল আগে এমন দীর্ঘ ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ভেনিসের ব্যবসায়ী এবং পরিব্রাজক মার্কো পোলো। কিন্তু তিনি মার্কো পোলোর চেয়েও তিন গুণ বেশি পথ সফর করেছেন। ভ্রমণকালে তিনি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সুফি, সুলতান, কাজী এবং আলেমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৩০ বছরে প্রায় ৪০টি দেশ ভ্রমণ করে নিজ দেশ মরক্কোয় ফেরার পর মরক্কোর সুলতান আবু ইনান ফারিস তাঁর ভ্রমণ কাহিনির বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন সচিব নিয়োগ করেন। এই ভ্রমণ কাহিনির নাম ‘রেহলা’। এটিকে ১৪০০ শতকের পূর্ব, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। বর্তমান বাংলাদেশ তৎকালীন বাংলা সম্পর্কে তিনি বলেন, টানা ৪৩ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে আমরা বাংলায় পৌঁছলাম। সবুজে ঘেরা বিশাল এক দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্যসব জিনিসও এত সস্তায় সে দেশে পাওয়া যায়  যে, এরকম আর কোথাও দেখিনি। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য ছিল হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর পথিমধ্যে দুই দিনের দূরত্বেই দুজন শিষ্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইবনে বতুতার। তাদের কাছে নির্দেশ ছিল, পশ্চিম থেকে যে পর্যটক হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন তাঁকে যেন স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ ইবনে বতুতার সঙ্গে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর আগে থেকে কোনো পরিচয় ছিল না কিংবা ইবনে বতুতা তাঁর আগমনের কোনো খবরও দেননি। ইবনে বতুতা তাঁর গ্রন্থে নিজের সম্পর্কে যতটুকু লিখে গেছেন তার চেয়ে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি। এই মহান পরিব্রাজক অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে, তিনবার হজ করে তাঁর জন্মভূমিতে ফিরেছিলেন ৩০ বছর পর। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন, ‘হজ পালন ও মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের আকাক্সক্ষা নিয়ে আমি যেদিন জন্মভূমি তানজিয়ের ছেড়ে মক্কার পথে যাত্রা করলাম, সেদিন ছিল ৭২৫ হিজরির ২ রজব (১৪ জুন ১৩২৫, বৃহস্পতিবার)। সেই হিসাব মতে তখন আমার বয়স ২২ বছর (২১ বছর ৪ মাস)।  পথে সঙ্গী হিসেবে কাউকে না পেয়ে বা কোনো কাফেলার খোঁজ না পেয়ে আমি একাই বেরিয়ে পড়ি। তখন আমার মা-বাবা বেঁচে ছিলেন।  তাদের ছেড়ে আসার পর্বটা খুবই কঠিন ছিল। বিদায়ের সময় ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সবার।

 

ইবনে বতুতা ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে আলাদা

ইবনে বতুতা ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে আলাদা একজন। বিশ্ব ভ্রমণই ছিল তাঁর মনের গহিন কোণে। মাত্র ২০-২১ বছরেই তিনি ভ্রমণে বের হলেও অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ কিশোর বয়স থেকে বিশ্বকে জানার তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয় তাঁর মনে। অবশেষে এক দিন পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ১৩২৫ সালের ১৪ জুন মরক্কোর তানজিয়ের থেকে হজের উদ্দেশে তিনি উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রতীর ঘেঁষে হেঁটে মক্কা রওনা দেন। এই পথে তিনি আব্দ-আল-ওয়াদিদ এবং হাফসিদ সাম্রাজ্য, তিমসান, বিজাইরা এবং তিউনিস হয়ে মক্কায় পৌঁছেন। যাত্রাপথে তিনি তিউনিসে দুই মাস অবস্থান করেন। আরব বেদুইনদের থেকে নিরাপদ থাকতে এবং অন্যান্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কাফেলার সঙ্গে এই পথ অতিক্রম করেন। পথিমধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি দুজন ধার্মিক তপস্বীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি কায়রোয় পৌঁছেন। কায়রোয় প্রায় এক মাসের মতো অবস্থান করার পর তিনি মক্কার উদ্দেশে রওনা করেন। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। তাকে আবার কায়রোতেই ফেরত আসতে হয়। কারণ তিনি মক্কা যাওয়ার অন্যতম পথগুলো রেখে নীল নদ পার হয়ে আইদাব বন্দর দিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। এবার তিনি একজন সুফি সাধকের সাক্ষাৎ পান। তাঁর নাম শেখ আবুল হাসান আল সাদিদি। তিনি ইবনে বতুতাকে পথ বাতলে দেন।  তিনি মদিনাগামী একটি কাফেলার সঙ্গে যোগ দেন। মদিনায় হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করে চার দিন পর তিনি মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন। মক্কা পৌঁছে হজ পালন করে তিনি তানজিয়ে ফিরে যাওয়ার বদলে মধ্য এশিয়ার দিকে যাত্রা করেছিলেন।

 

জীবন্ত ইতিহাস যেন রেহলা

ইবনে বতুতার লিখিত ‘রেহলা’ গ্রন্থ হলো ইতিহাসকে জানার অন্যতম প্রধান উৎস। ৩০ বছরে চল্লিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করা এই পর্যটক তার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন এই বইয়ে। আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক,  কাজাখস্তান, আফগানিস্তান,   পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন। এই গ্রন্থটি ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বাংলার ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উৎস। ইবনে বতুতা তার ৩০ বছরের বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। তবে ইবনে বতুতা তার অভিজ্ঞতার বিবরণ নিজে লিপিবদ্ধ করেননি বলে জানা যায়। যতদূর সম্ভব ইবনে জুজাই নামক এক পন্ডিত, যিনি মরক্কো সুলতানের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন। তিনিই সুলতানের নির্দেশে শ্রুতি লিখন পদ্ধতিতে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন। ১৩৫৫ সালের ৯ ডিসেম্বর মৌখিক বর্ণনা শেষ হলে ‘রেহলা’ নামক বইটি লিপিবদ্ধ করার কাজ শেষ হয়। রেহলা কথাটির সারমর্ম হলো ‘মুসলিম সাম্রাজ্য, সৌর্য, শহর এবং এর গৌরবান্বিত পথের প্রতি উৎসাহীদের জন্য একটি দান’। এ রেহলা গ্রন্থে আফ্রিকা, মিসর, চীনসহ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবরণ অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলার ইতিহাসে ‘রেহলা’ গ্রন্থের ভূমিকা অনবদ্য। সফর শেষে মরক্কোর ফেজ নগরীতে গিয়ে ইবনে বতুতা সুলতান আবু ইনান ফারিজ এবং তার সভাসদদের কাছে তার সব ভ্রমণ কাহিনি খুলে বলেন। তখনই সুলতান নিজের একান্ত সচিবদের একজন ইবনে জুজাইকে তার ভ্রমণের বিস্তারিত লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

 

 

সব মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ

প্রায় সব মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেছিলেন ইবনে বতুতা। হজ পালনের পরই তিনি পৃথিবীর মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। মক্কা থেকে তিনি ১৩২৬ সালের নভেম্বরের ১৭ তারিখ আরব সাগর হয়ে ইরাকের উদ্দেশে এক কাফেলার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এই কাফেলা তাঁকে নাজাফ শহরে নিয়ে যায়। নাজাফ শহরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে বতুতার কাফেলা ইরাকের উদ্দেশে রওনা দিলেও তিনি কাফেলার সঙ্গে না গিয়ে আরও দক্ষিণে টাইগ্রিস নদী পার হয়ে বসরা নগরীর দিকে রওনা করেন। ইবনে বতুতা মক্কায় তিন বছর অবস্থান করে ১৩৩০ সালে হজ পালন করেন। অবশ্য কেউ কেউ এই সময় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।

অনেকের মতে তিনি ১৩২৮ সালে হজ পালন করেন। ইবনে বতুতার সব মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ শেষে একটি দেশই বাকি ছিল। তা হলো নিগ্রোল্যান্ড। ১৩৫১ সালের এমনি এক বসন্তের সময় ইবনে বতুতা সাহারা মরুভূমির উত্তরে সিজিলমাসার উদ্দেশে ফেজ নগরী ত্যাগ করেন। সিজিলমাসা থেকে ১৩৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লবণের খনির শহর তাঘাজার উদ্দেশে রওনা দেন। তাঘাজা থেকে বিশাল সাহারা মরুভূমি পার হওয়ার পর নিগ্রোল্যান্ড থেকে ১৩৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মরক্কোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৩৫৪ সালের শুরুর দিকে তাঁর জন্মভূমিতে শেষবারের মতো পদার্পণ করেন। তাঁর দীর্ঘ সফরে মরুভূমির তপ্ত বালিতে উটের পিঠে চড়া, সমুদ্রে জাহাজডুবি থেকে ভিনদেশের সৈন্যদলের আক্রমণ সবই ছিল।

 

ইবনে জুবায়ের

তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে রয়েছে হজ যাত্রার বর্ণনা। যেখানে উঠে এসেছে সেসময়...

ইবনে জুবায়ের জন্মগ্রহণ করেন ১ সেপ্টেম্বর ১১৪৫ সালে। মৃত্যুবরণ করেন ১২১৭ সালে। তিনি ছিলেন আল আন্দালুসের একজন ভূগোলবিদ, পর্যটক ও কবি। তাঁর ভ্রমণ কাহিনিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল হজ যাত্রার বর্ণনা। যা তৃতীয় ক্রুসেডের কয়েক বছর পূর্বে ১১৮৩ থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত সে সময়ের নানা তথ্য সংবলিত করা হয়েছে। তাঁর বর্ণনায় মিসর ও লেভান্টে সালাউদ্দিনের শাসনের বর্ণনা রয়েছে। মক্কা যাওয়ার সময় তাঁকে এসব স্থান অতিক্রম করতে হয়। উপরন্তু তাঁর ফিরতি পথে তিনি খ্রিস্টান সিসিলির মধ্য দিয়ে যান।  এক শতাব্দী পূর্বে তা মুসলিমদের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়। সে সময়কার উন্নত-মিশ্র সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করেন।

 

আল-ইদ্রিসি

বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন যা দিয়ে বহু পর্যটক ভ্রমণ করেন...

আল-ইদ্রিসি। মুসলমান পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম একজন তিনি। তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ আল-ইদ্রিসি আল-কুরতুবী আল-হাসানী আস-সাবিত। এই পর্যটক ছিলেন একজন আরব মুসলিম ভূগোলবিদ, মানচিত্রাঙ্কনকার এবং মিসরতত্ত্ববিদ। যিনি কিছু সময়ের জন্য রাজা দ্বিতীয় রজারের শাসনামলে সিসিলির পালের্মোতে বসবাস করেছিলেন। মুহাম্মদ আল-ইদ্রিসি সেউতাতে জন্মগ্রহণ করেন তখন তা আলমোরাভিডদের অন্তর্গত ছিল। এই পর্য়টক বিখ্যাত তার তৈরি তাবুলা রোজেরিয়ানার জন্য।  এটিই ছিল মধ্যযুগীয় বিশ্বের অন্যতম উন্নত মানচিত্র। তিনি ১১৫৪ সালে সর্বপ্রথম বিশ্বের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন।

 

চীনা হুই মুসলিম চেং হো

চেং হো ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন ইতিহাসবিদ এবং পর্যটক। তিসি জন্মগ্রহণ করেন চীনের হুই মুসলিম সম্প্রদায়ে ১৩৭১ সালে। মৃত্যুবরণ করে ১৪৩৩ সালে মতান্তরে ১৪৩৫ সালে। এই চীনা হুই মুসলিম ছিলেন একাধারে নাবিক, পরিব্রাজক, কূটনীতিবিদ ও নৌসেনাপতি। তিনি ১৪০৫ হতে ১৪৩৩ এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, সোমালিয়া ও সোয়াহিলি উপকূলে ভ্রমণ করেন, যা একত্রে “চেং হো-র ভ্রমণ” নামে পরিচিত। ইয়োংল সম্রাটের প্রিয়পাত্র হওয়ার সুবাদে, যার সিংহাসন আরোহণে তিনি সহায়তা করেন। চেং হো সাম্রাজ্যে উচ্চাসন লাভ করেন এবং সাম্রাজ্যের দক্ষিণ রাজধানী নানচিঙের শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। যদিও এই পর্যটকের ভ্রমণগুলো বহুদিন আনুষ্ঠানিক চৈনিক ইতিহাসে অবহেলিত ছিল কিন্তু ১৯০৪ সালে লিয়াং ছিহাও এর “আমাদের দেশের মহান নাবিক চেং হো-র জীবনী” গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর চীন ও বহির্বিশ্বে তিনি পরিচিতি পান। এর কিছুদিন পরই শ্রীলঙ্কায় তাঁর রেখে যাওয়া একটি ত্রিভাষিক স্তম্ভ পাওয়া যায়।  পাশের ছবিতে সেই স্তম্ভই দেখানো হয়েছে।

 

ইবনে আলী আল মাসুদী

এই ইতিহাস এবং ভূগোলবিদকে অভিহিত করা হয় আরবের হেরোডোটাস নামে...

আল মাসুদী বিশ্বের সেরা ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম একজন। এই মুসলিম পর্যটক জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৮৯৬ সালে। আর মৃত্যুবরণ করেন ৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তিনি একাধারে ছিলেন একজন মুসলিম ইতিহাসবিদ এবং ভূগোলবিদ। তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে পারি সে সময়ের মিসর থেকে শুরু করে পুরো বিশ্ব সম্পর্কে। তিনি ধারণ করেছিলেন সময়কে। তাঁকে অনেক সময় আরবের হেরোডোটাস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কারণ তিনিও ইতিহাস ও অনুসন্ধান এ দুটি ধারণাকে সংযুক্ত করেন হেরোডোটাসের মতো। ফলে ইতিহাস পরিণত হয় বিজ্ঞানে, পরিপূর্ণভাবে হয়ে ওঠে তথ্যনির্ভর ও গবেষণার বিষয়। এ জন্য সবাই আল মাসুদীকে স্মরণ করেন অন্যমাত্রায়। হেরোডোটাসের মতো তিনি মনে করেন- ইতিহাস যা সত্যিকার অর্থে ছিল বা সংঘটিত হয়েছিল,  তা অনুসন্ধান করা ও লেখাই প্রকৃত কাজ।

 

আহমেদ ইবনে ফাদলান

তাঁর বর্ণনা থেকে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসছে। যেমন ভাইকিংদের কথাও উঠে এসেছে...

আহমেদ ইবনে ফাদলান তাঁর পুরো নাম ‘আহমেদ ইবনে ফাদলান ইবনে আব্বাস ইবনে রশিদ ইবনে হাম্মাদ’। তিনি ছিলেন ১০ম শতাব্দীর একজন আরব পর্যটক। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার তরফ থেকে ভলগা বুলগারের রাজার কাছে প্রেরিত দূত ছিলেন তিনি। এই আরব পর্যটকের লিখিত ভ্রমণ কাহিনি পৃথিবী বিখ্যাত। তাঁর বিবরণে ভলগা ভাইকিংদের বর্ণনা পাওয়া যায়। এতে নৌকাসমেত কবরস্থ করার দৃশ্যের বর্ণনা রয়েছে। তিনি অঘুজ, পেচেনেগ, বাশকির ও খাজারসহ আরও কিছু তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর বর্ণনা দিয়েছেন। ভাইকিংদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসও আমরা জানতে পেরেছি তাঁর ভ্রমণ কাহিনির মধ্য দিয়ে।  তিনি উল্লেখ করেন ভাইকিং যোদ্ধাদের বলা হতো প্রাচীন ইউরোপের ত্রাস ও সন্ত্রাস! প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর যোদ্ধা। এরকম অনেক বিষয় উঠে আসে আহমেদ ইবনে ফাদলানের লেখায়।

সর্বশেষ খবর