শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রমজানের অতুলনীয় মর্যাদা

দীর্ঘ এক বছর অপেক্ষার পর মুমিনের দুয়ারে আসে মাহে রমজান। কোরআনের মাস, জান্নাতের মাস রমজান পেয়ে খুশিতে বাগবাগ মুমিনহৃদয়। শুধু জীবিত নয়, মৃতরাও খুশি হয় পবিত্র রমজান মাসের আগমনে। রমজানে বন্ধ থাকে কবরের আজাব। রমজানের সীমাহীন মর্যাদার কারণ আর কিছু নয়- মহিমান্বিত কোরআন। কোরআনের মহিমা রমজানকে দিয়েছে সব মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব। মাহে রমজানের মর্যাদা ও মহিমা নিয়ে রকমারির আজকের আয়োজন-

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রমজানের অতুলনীয় মর্যাদা

তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে!

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আমার বিশ্বাসী বান্দারা! তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। আশা করা যায় তোমরা আল্লাহসচেতন-পরহেজগার-মুত্তাকি হবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩।)

মুফাসসিরগণ বলেন, সব ইবাদতের মাধ্যমেই বান্দা মুত্তাকি হতে পারে। তবে সিয়াম এমন এক বিশেষ ইবাদত, যার ফলে অল্প পরিশ্রমেই বান্দা আধ্যাত্মিক উন্নতির সিঁড়ি পেয়ে যায়। তাই তো আল্লাহতায়ালা সিয়াম ফরজ করতে গিয়ে ‘ফুরিদা’ না বলে ‘কুতিবা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। আরবি ‘কুতিবা’ মানে হলো লিখে দেওয়া হয়েছে। ‘কুতিবা আলাইকুমুস সিয়াম’ মানে হলো ‘তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনার বিধান লিখিত চুক্তির মাধ্যমে ফরজ করা হয়েছে।’ মানুষের কাছে মুখের কথার চেয়ে লিখিত চুক্তির গ্যারান্টি বেশি। তাই আল্লাহতায়ালা সে ঢঙে বলেছেন, তোমাদের সঙ্গে আমার লিখিত চুক্তি হলো তোমরা সিয়াম সাধনা করবে, বিনিময়ে আমি তোমাদের মুত্তাকি হিসেবে কবুল করে নেব।

আমাদের জন্ম হয়েছে মানুষ হিসেবে। বুঝ হওয়ার পর যখন আল্লাহকে চিনেছি, আল্লাহর রবুবিয়াত তথা মমতাময় প্রতিপালন উপলব্ধি করেছি, অজান্তেই স্বীকার করে নিয়েছি- তুমিই আমাদের প্রেমময় মাবুদ, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই হে আল্লাহ! আদম সন্তান তথা মানুষ থেকে এবার আমরা মুমিন হয়েছি। মুমিন হওয়া মানে বিশ্বাসী হওয়া। বিশ্বাসী বান্দাকে মুত্তাকি এবং মুত্তাকি বান্দাকে ‘কালবে সালিম’ বা ‘নফসে মুতমাইন্না’র অধিকারী হতে হয়। অর্থাৎ ইমানের মাধ্যমে যে ক্লাসে আমরা ভর্তি হয়েছি, সে ক্লাসের পরের স্টেজ হলো মুত্তাকি। সিয়াম এসেছে মুমিনকে মুত্তাকি বানাতে। মুত্তাকি হওয়ার প্রথম সবকই হলো ত্যাগ করা। আরবি সিয়াম শব্দের অর্থও ত্যাগ করা। মন থেকে আল্লাহ ছাড়া যাবতীয় সব ধ্যান-ধারণা ত্যাগ করাই হলো হাকিকতে সিয়াম। আল্লাহ ছাড়া বাকি সব ধ্যান-ধারণাকে সুফিরা বলেছেন ‘তাগুত’। তাই সহজ কথায় তাগুতকে ত্যাগ করার নামই সিয়াম। তাগুতের অনেক ধরন রয়েছে। তবে হাদিসের পরিভাষায় সবচেয়ে বড় তাগুত হলো নফস তথা প্রবৃত্তি। একবার যুদ্ধ থেকে ফিরে রসুল (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘এতক্ষণ আমরা ছোট যুদ্ধে ছিলাম, এখন আমরা বড় যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছি।’ সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! বড় যুদ্ধ আবার কোনটা’? রসুল (সা.) বললেন, ‘নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’

মোটা দাগে বলা যায়, সিয়াম হলো নফসের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করার নাম। নফস বলছে, প্রচুর পিপাসা লেগেছে, এক ঢোক পানি খেয়ে নাও। রোজাদার বলে, কেউ না দেখলেও আল্লাহ দেখবেন। নফস প্ররোচনা দেয়, এ তোমার হালাল স্ত্রী, তার সঙ্গে মেলামেশায় বাধা কিসে? আবার রোজাদার বলে, এখন আমি রোজাদার। এবার নফস ভিন্নভাবে আক্রমণ করে। নফস বলে, ঝগড়া কর! গিবত কর! মন্দ কথা বল! রোজাদার এবারও বলে, আল্লাহ দেখছেন। এভাবে একটি মাস যখন বান্দা সব কাজকর্মে ‘আল্লাহ দেখছেন’ চর্চা করতে থাকে, একটা পর্যায়ে বান্দা মুুত্তাকি হয়ে যায়। সাধনার ফলে সাধারণ আদম সন্তান আল্লাহওয়ালা, আরেফবিল্লাহয় পরিণত হয়। এমন বান্দা সম্পর্কেই হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি তার হাত হয়ে যাই, সে যা ধরে আসলে আমিই তা ধরি। আমি তার কান হয়ে যাই, সে যা শুনে আসলে আমিই শুনি।’ (বুখারি।)

 

খুলে গেল জান্নাতের দুয়ার

হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন পশ্চিম আকাশে মাহে রমজানের বাঁকা চাঁদ হাসে, তখন আকাশের যত সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির দরজা আছে সব খুলে দেওয়া হয়।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মাহে রমজানের চাঁদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনাবিল আনন্দময় জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি চির কষ্টের আবাস জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি)। মুহাদ্দিসগণ বলেন, হাদিসে বলা হয়েছে আকাশের দরজা খুলে দেওয়ার অর্থ হলো বান্দার ওপর অনবরত রহমত বর্ষিত হতে থাকে। বান্দার আমলনামা সরাসরি আল্লাহর কাছে চলে যায় এবং বান্দা যে দোয়াই করুক না কেন তা আরশে আজিমে পৌঁছে যায়। আর জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়ার অর্থ হলো অনবরত রহমত বর্ষণ হওয়ার ফলে বান্দা বেশি বেশি নেক আমলের সৌভাগ্য লাভ করে এবং জান্নাতের চাবি তার হাতের মুঠোয় চলে আসে। একইভাবে জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার অর্থ হলো রোজাদার নেক আমল করতে করতে এমন স্তরে পৌঁছে যায় যে, তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং সে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। (ফালাসাফায়ে সিয়াম।)

 

ঘরে ঘরে ইফতারের আনন্দ

ইফতারের আগের সময়টি রোজাদারের জন্য জান্নাতি চাদরে ঘেরা এক মুহূর্ত। ইমানি চেতনায় সিক্ত হওয়ার মুহূর্ত; জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের মুহূর্ত। আল্লাহর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়ার মুহূর্ত। কারণ এ মুহূর্তে রোজাদারের অনুভূতি থাকে সমর্পিত; অন্তর থাকে স্বর্গীয় অনুভূতিতে আন্দোলিত। হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ আছে। একটি দুনিয়ায়, অন্যটি আখেরাতে। দুনিয়ার আনন্দ হলো ইফতারের আনন্দ। আখেরাতের আনন্দ হলো দিদারে ইলাহি তথা প্রেমময় প্রভুর প্রেম দর্শনের আনন্দ।’ (বুখারি শরিফ।) সত্যি! ইফতারের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। রসুল (সা.) ইফতারের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ইফতার যেমন রোজাদারের জন্য আনন্দময় ও সওয়াবে ভরপুর নেয়ামত, একইভাবে ইফতারের জন্য অপেক্ষার সময়টুকুও রোজাদারের আমলনামায় অফুরন্ত সওয়াব লেখেন ফেরেশতারা।’ শুধু তাই নয়, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ইফতারের সময় এতই মূল্যবান, এ সময় বান্দা আল্লাহর কাছে যা চাইবে, তাই কবুল করবেন।’ (কিতাবুস সিয়াম।)

ইফতার যথাসম্ভব দ্রুত করা উচিত। হাদিসে বড় কল্যাণের কারণ বলা হয়েছে এ কাজকে। তিরিমিজি ও আবু দাউদ শরিফের হাদিসে এসেছে, ‘নবীজি বলেছেন, তোমরা ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের সঙ্গে থাকবে যতদিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করবে।’ আরেকটি হাদিসে নবীজি বলেছেন, ‘আমি ওই উম্মতকে ভালোবাসি, যে দ্রুত ইফতার করে। তারপর নবীজি বলেন, পূর্ববর্তী সব নবীর সুন্নত ছিল দ্রুত ইফতার করা।’ (আবু দাউদ।)

অন্যকে ইফতার করানোর সওয়াব সম্পর্কে নবীজি বলেন, কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে রোজাদারের সমান সওয়াবও তাকে দেওয়া হবে। এ জন্য কারও সওয়াব কমানো হবে না। এমন লোভনীয় সওয়াবের কথা শুনে সাহাবিরা খুবই খুশি হলেন। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, নবীজি! আমাদের মধ্যে এমন অনেক দরিদ্র সাহাবি আছেন, যারা অন্যকে ইফতার করানোর সামর্থ্য রাখেন না। নবীজি বললেন, তুমি চাইলে তোমার ভাইকে এক ঢোক পানি কিংবা একটি খেজুর দিয়ে ইফতার করিয়েও সওয়াব অর্জন করতে পার। (কিতাবুস সিয়াম।)

 

দুনিয়া আখেরাতের ঢাল রোজা

হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আসসাওমু জুন্নাহ। অর্থ রোজা হলো ঢাল তথা সেল্ফ প্রোটেক্ট।’ অর্থাৎ নিজেকে বাঁচানো অস্ত্র। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেন, প্রথমত রোজা আপনাকে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকার যোগ্য করে তোলে। দ্বিতীয়ত. রোজা রোজাদারকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার নিশ্চয়তা দেয়। এ সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজা এবং কোরআন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে শাফায়াত করবে। রোজা বলবে, হে আল্লাহ! আমি তাকে খাওয়া এবং কামনা থেকে বেঁচে থাকতে বলেছি, সে আমার কথা শুনেছে। তাই তার ব্যাপারে আমার শাফায়াত কবুল কর। কোরআন বলবে, হে আল্লাহ! সারা দিনের ক্লান্তি শেষে তোমার বান্দা রাতে আমাকে তেলাওয়াত করেছে। আমাকে নিয়ে গবেষণা করেছে। দিনের প্রতিটি মুহূর্তে আমার বলে দেওয়া পথে সে নিজেকে চালিয়েছে। তার ব্যাপারে আমার শাফায়াত কবুল কর। রসুল (সা.) বলেন, রোজা এবং কোরআনই দুজনের সুপারিশই কবুল করা হবে।’ তৃতীয়ত. রোজা বান্দাকে সব ধরনের পাপ কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এ সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদার অবশ্যই মিথ্যা-গিবত, ঝগড়া থেকে বেঁচে থাকবে। তার সঙ্গে কেউ ঝগড়া করতে চাইলেও সে এ বলে পাশ কাটিয়ে যাবে, ভাই! আমি রোজাদার। রোজা আমাকে সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে বলেছে। তাই তুমি যতই চেষ্টা কর, আমাকে ঝগড়ায় জড়াতে পারবে না।’ (বুখারি।)

 

রোজার সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না

রোজা এমন এক বরকতময় ইবাদত, যার সঙ্গে অন্য কোনো ইবাদতের তুলনাই হয় না। রোজাদারের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে রয়েছে বিশেষ পুরস্কার এবং মর্যাদা। এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় রসুল (সা.)-এর হাদিস থেকে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘একবার রসুল (সা.) রমজানের চাঁদ দেখার পর সাহাবিদের সামনে বড় আবেগঘন ভাষায় ভাষণ দেন। ভাষণে নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মাঝে এক বরকতময়-কল্যাণময় মাস এসেছে। যারা কল্যাণ লাভ করতে চাও দৌড়ে এসো। এ মাসে একটি নফল আমল ফরজের মর্যাদা পায় এবং একটি ফরজ সত্তরটি ফরজের মর্যাদা পায়।’ (সুনানে বায়হাকি শরিফ।) অন্য বর্ণনায় রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে মানুষের আমল বা কাজ সাত রকমের। দুই রকমের কাজ এমন যে, তার দুটো অনিবার্য ফল রয়েছে। আর দুই রকমের কাজ এমন যে, তার ফল কাজের সমান। আর একরকমের কাজের ১০ গুণ সওয়াব রয়েছে। আর একরকমের কাজের সওয়াব ৭০০ গুণ। আর একরকমের কাজের সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। প্রথম দুটো হলো : যে ব্যক্তি একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করে, কাউকে তাঁর সঙ্গে সমকক্ষ করে না এবং এ অবস্থায় আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয়, তার জন্য জান্নাত অনিবার্য। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা অবস্থায় তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছে, তার জন্য জাহান্নাম অনিবার্য। যে ব্যক্তি কোনো খারাপ কাজ করে সে তার এক গুণ শাস্তি পায়। আর যে ব্যক্তি কোনো ভালো কাজ করার ইচ্ছা করে, কিন্তু কাজটি করে না- সে ওই কাজ করার এক গুণ সাওয়াব পায়। আর যে ব্যক্তি ভালো কাজ সম্পাদন করে, সে তার কাজের ৭০০ গুণ পর্যন্ত সাওয়াব পায়। আর রোজা আল্লাহর জন্য হয়ে থাকে। এর সওয়াবের পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউই জানেন না। (তাবারানি ও বায়হাকি।)

 

রমজানের শেষ রাতে ক্ষমার বৃষ্টি ঝরে

পবিত্র রমজান মাসে রোজাদারের জন্য মহান আল্লাহ তাঁর রহমত এবং নিয়ামতের অফুরন্ত ভান্ডারের দরজা খুলে দেন। এ সময় প্রতিটি সিয়াম সাধকের একান্ত কর্তব্য হলো প্রভুর এই অফুরন্ত ভান্ডার থেকে রহমত ও দয়া লুফে নেওয়া। যদিও সিয়াম সাধনা প্রতিটি নবীর উম্মতের ওপরই ফরজ ছিল, তবে উম্মতে মুহাম্মদি হওয়ার কারণে আল্লাহপাক আমাদের বিশেষ কিছু সুবিধা দিয়েছেন। রসুলেপাক (সা.) বলেছেন, রমজান মাসে আমার উম্মতকে পাঁচটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কোনো নবী কিংবা নবীর উম্মতকে দেওয়া হয়নি। প্রথমটি হলো, রমজানের প্রথম রাতে আল্লাহতায়ালা যার দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন তাকে কখনো শাস্তি দেন না। দ্বিতীয়ত. সন্ধ্যার সময় তাদের মুখ থেকে যে দুর্গন্ধ বের হয়, তা আল্লাহতায়ালার কাছে মেশকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। তৃতীয়ত. রমজানের প্রত্যেক দিনে ও রাতে ফেরেশতারা রোজাদারদের জন্য দোয়া করে। চতুর্থত. আল্লাহতায়ালা তাঁর বেহেশতকে বলেন, তুমি আমার বান্দার জন্য সুসজ্জিত ও প্রস্তুত হও। আমার বান্দারা অচিরেই দুনিয়ার দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে আমার বাড়িতে ও আমার সম্মানজনক আশ্রয়ে এসে বিশ্রাম নেবে। পঞ্চমত. রমজানের শেষ রাতে আল্লাহতায়ালা তাদের সব গুনাহ মাফ করে দেন। এক ব্যক্তি বলল, এটা কি লাইলাতুল কদর? রসুলপাক (সা.) বললেন, না, তুমি দেখনি, শ্রমিকরা যখন কাজ শেষ করে তখনই পারিশ্রমিক পায়। (শুআবুল ইমান।)

 

শৃঙ্খলা মেনে চলে শয়তানও

রসুল (সা.) বলেছেন, ‘রোজার মাসে শয়তানকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসা হয়।’ (বুখারি।) শয়তানকে বন্দি রাখার ব্যাপারে যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) লিখেছেন, ‘ইমাম ঈসা (রহ.) বলেন, এ মাসে কোরআন নাজিল হলে শয়তান আসমানে যাওয়া-আসা এবং ফেরেশতাদের গোপন কথাবার্তা শোনা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়। ফলে কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে শয়তানকে বন্দি করে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, এ মাসেই তোমার ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে এবং মানব জাতির হেদায়াতময় গ্রন্থ কোরআন নাজিল করা হয়েছে।’ (ফাতহুল বারি।) ভারতবর্ষের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভি (রহ.) বলেন, মাহে রমজানে শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার পরও মানুষ পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার দুটো কারণ হতে পারে। প্রথমত. শুধু শয়তানই মানুষকে পাপ কাজে প্ররোচনা করে না, নফসও মানুষকে গুনাহের দিকে টেনে নেয়। তাছাড়া এ হাদিসের একটি অর্থ এরকমও হতে পারে, বড় শয়তান অর্থাৎ ইবলিসকে আটকে রাখা হয় কিন্তু তার সৈন্যরা আগের মতোই মুক্ত থাকে। ফলে মানুষ শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পড়ে যায়। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ।) মুহাদ্দিসগণ আরেকটি অর্থও করেছেন। শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার অর্থ হলো রমজান মাসে ইবলিসকে দীনি পরিবেশ এবং খাঁটি মুমিন বান্দাদের কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না। ফলে দেখা যায়, পাপাচার সংঘটিত হয় যেসব স্থানে সেখানে ঠিকই শয়তানের যাতায়াত থাকে। এ কারণেই দেখা যায়, মাহে রমজানে যেসব স্থানে দীনি পরিবেশ বিরাজ করে ওইসব স্থানে অশ্লীলতা, পাপাচার তো দূরের কথা প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়া করতেও মানুষ ইতস্তত বোধ করে। একজন মুমিন তো অবশ্যই, একজন বেদীনও মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে দীনি পরিবেশ এবং দীনি সমাজে অসামাজিক ও গুনাহর কাজ থেকে বিরত থাকে। এটাই হাদিসে বলা শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার বাস্তব চিত্রের একটি। (ফালাসাফায়ে সিয়াম।)

 

হেলায় কাটিও না রোজা

বুখারি শরিফের বর্ণনায় এসেছে, এক দিন নবীজি (সা.) মিম্বরের সিঁড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠলেন আমিন। পরের সিঁড়িতেও পা রেখে বললেন, আমিন। আমিন বললেন, তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখেও। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এমন করুণ সুরে ব্যথা ভরা মনে আমিন আমিন বলার রহস্য কী- সাহাবিরা জানতে চাইলেন।

মলিন মুখে নবীজি বললেন, আমার প্রিয় সাহাবিরা! একটু আগেই জিবরাইল (আ.) এসেছেন আমার কাছে।

বড় বেদনার কথা বলে গেলেন তিনি। বললেন, হে আল্লাহর নবী! তিন পোড়া কপালের জন্য এখন আমি বদদোয়া করব, প্রতিটি দোয়া শেষে আপনি আমিন বলবেন। তারপর নবীজি বলেন, আমি যখন প্রথম সিঁড়িতে পা রাখি, জিবরাইল বললেন, বৃদ্ধ মা-বাবাকে পেয়েও যে জান্নাত অর্জন করতে পারল না তার জন্য ধ্বংস। আমি বললাম, আমিন।

দ্বিতীয় সিঁড়িতে যখন পা রাখি, জিবরাইল বললেন, যে আপনার নাম শুনবে কিন্তু দরুদ শরিফ পড়বে না, তার জন্য ধ্বংস। আমি বললাম, আমিন। আর যে রমজান মাস পাবে কিন্তু নিজের গুনাহ মাফ করিয়ে নিজেকে জান্নাতের উপযোগী বানাতে পারবে না, তার জন্যও ধ্বংস। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখার সময় এ দোয়া করলেন জিবরাইল। আমি বললাম, আমিন।

 

রোজার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ দেবেন

হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে একটি হাদিসে কুদসি বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেকটা কাজ তার নিজের জন্য। তবে রোজা ছাড়া। কেননা রোজা আমার জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দেব। আর রোজা হচ্ছে ঢালের মতো। কাজেই কেউ যখন রোজা রাখে, তখন সে যেন কোনো অশ্লীল কথা না বলে এবং ঝগড়াবিবাদ না করে। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে অথবা লড়াই করতে আসে, তবে সে যেন বলে, আমি রোজাদার।’ (বুখারি ও মুসলিম।) মুসলিম শরিফের অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আদম সন্তানের সব কাজের সওয়াব ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়, কিন্তু রোজার কথা ভিন্ন। কেননা রোজা আমারই জন্য এবং আমিই (আমার দিদারের মাধ্যমে) তার প্রতিদান দেব।’ (মুসলিম।) ড. তাহেরুল কাদেরি একটি চমৎকার উদহরণ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়, শহীদরা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দিদার পাবে। তারপর তারা জান্নাতে সবুজ পাখি হয়ে উড়তে থাকবে। আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন, তোমরা আর কী চাও আমার কাছে? জবাবে তারা বলবেন, হে আল্লাহ! আপনার দিদারের মতো প্রশান্তি! এত তৃপ্তি! আর কিছুতেই পাইনি। আপনি আমাদের আবার দুনিয়ায় পাঠান, আমরা আবার শহীদ হই এবং আপনার দিদারে ধন্য হই।’ তাহেরুল কাদেরি বলেন, ‘জান্নাতিরা আল্লাহর দর্শনের জন্য বারবার শহীদ হতে চাইবেন, আর আল্লাহ নিজে আগ্রহ করে সিয়াম পালনকারীদের দিদার দেবেন। সিয়ামের মর্যাদা তাহলে কত ওপরে ভেবে দেখুন!’ (ফালাসাফায়ে সিয়াম।)

 

গুনাহ মাফের এই তো সুযোগ!

রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতেছাবের সঙ্গে মাহে রমজানের রোজা পালন করবে, তার পূর্বের জীবনের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি।) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় পাকিস্তানের প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ড. তাহেরুল কাদেরি বলেন, ‘শুধু রোজা রাখলেই হবে না, হৃদয়ে ইমানও থাকতে হবে। আর ইমান হলো আল্লাহর রসুল (সা.) যা নিয়ে এসেছেন তা মনেপ্রাণে সত্য বলে মেনে নেওয়া। অসংখ্য বিধিবিধানের সঙ্গে রোজাও রসুল (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত হয়েছেন এবং রোজা রাখা আমার জন্য আবশ্যক, যখন বান্দার মনে এমন ধারণা গেঁথে যাবে এবং এ পবিত্র ধারণা নিয়ে সে রোজা রাখা শুরু করবে, তখনই সে হাদিসে বলা ‘ইমানের রোজা’ পালন করবে।’  ইহতেছাবের ব্যাখ্যায় ড. তাহেরুল কাদেরি বলেন, ‘ইহতেছাবের এক অর্থ হলো ইখলাস। অর্থাৎ বান্দা রোজা রাখবে আল্লাহর কাছে প্রতিদানের আশায় এবং নিজের ভিতরের খারাপ ও মন্দ অভ্যাসগুলো বর্জনের নিয়তে। এমন রোজার মাধ্যমেই নফস কাবু হবে এবং প্রভু খুশি হবেন। আর খুশির প্রতিদান হিসেবে বান্দার জীবনের পূর্বের সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (ফালাসাফায়ে সিয়াম।)

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর