শুক্রবার, ৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

চট্টগ্রামে প্রাচীন ও নান্দনিক মসজিদ

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে প্রাচীন ও নান্দনিক মসজিদ

দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী। নান্দনিক অবয়ব। রুচিশীল কাজ। শক্ত-মজবুত গাঁথুনি। স্থাপনার বয়সও পার হয়েছে শত বছর। কিন্তু এখনো দেদীপ্যমান এর কাঠামো। এমন অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল শত বছর আগে। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি, স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ, ইবাদতের মানস কিংবা প্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও নির্মাণ করা হয়েছিল এসব প্রাচীন মসজিদ। এখনো আলো ছড়াচ্ছে অনেক মসজিদ। নতুনত্ব দেওয়া হয়েছে অনেক মসজিদকে। চট্টগ্রামের এমন আটটি মসজিদ নিয়ে এবারের রকমারি আয়োজন।

 

৪০০ বছরের পুরাকীর্তি বখশি হামিদ মসজিদ

বখশি হামিদ মসজিদ। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের ইলশা গ্রামে অবস্থিত এটি। ৪০০ বছরের ঐতিহ্য এবং প্রাচীন পুরাকীর্তির আধার বখশি হামিদ মসজিদটি। বঙ্গের পাঠান সুলতান সোলায়মান কাররানির রাজত্বকালে (১৫৬৫-৭২ খ্রিস্টাব্দে) বাঁশখালী থানার ইলসা গ্রামে পাকা মসজিদটি নির্মিত হয়। কালক্রমে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সেখানে মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে বর্তমান মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন বখশি হামিদ। এর দেয়ালে সুলতানি আমলের শিলালিপিটি পুনঃস্থাপন করা হয়। ১৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ১২ ইঞ্চি প্রস্থের এ শিলালিপিতে আরবি ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘এই পবিত্র মসজিদখানি জাতি এবং ধর্মের স্তম্ভ মহান সুলতান সোলায়মানের সময়ে নির্মিত হয়। আল্লাহ তাঁকে সব আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করুন। তারিখ ৯৭৫ হিজরির ৯ রমজান (১৫৬৮ সালের ৮ মার্চ)।’ ১৯৬২ সালে দুষ্পাঠ্য শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল করিম। বখশি হামিদ মুঘল শাসনামলে বখশি বা সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর পূর্ব-পুরুষ ও বখশি হামিদ নিজে যোগাযোগের বিষয়টি লক্ষ্য রেখে ইলশা গ্রামে মসজিদ স্থাপন এবং তাদের বসতি নির্বাচন করেন বলে ধারণা করা হয়। পাকিস্তান আমলের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন সুপারিনটেন্ডেন্ট (পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক) ড. মুহাম্মদ আবদুল গফুর ১৯৬৪ সালের দিকে মসজিদের গঠনশৈলী পরীক্ষা করে মত দেন, ‘মসজিদটি মূলত প্রাক-মুঘল রীতিতে তৈরি। সংস্কারের সময় এটি মুঘল রীতিতে পুনর্নির্মাণ করা হয়। মসজিদের যে শিলালিপি বিদ্যমান রয়েছে, তা সুলতানি আমলের।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আবদুল করিম তাঁর ‘বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘সোলায়মান কররানি ১৫৬৪ থেকে ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার সুলতান ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জয় করে দক্ষিণ চট্টগ্রামে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেন। এ সময় বাঁশখালী থানার ইলসা গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। বখশি হামিদের সময় ওই মসজিদ নষ্ট হওয়ায় তিনি নিজে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন বা নষ্টপ্রায় মসজিদটি মুঘল রীতিতে ব্যাপকভাবে সংস্কার করেন। ভগ্নপ্রায় মসজিদটি সংস্কার করার পর শিলালিপিটি পুনঃস্থাপন করেন। শিলালিপি এবং মসজিদটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পুরাকীর্তির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। মুঘল আমলের মুসলমানদের শিল্পানুরাগের কীর্তিও বহন করছে মসজিদটি।

স্থাপত্যশৈলী

ইটের তৈরি মসজিদের দেয়ালগুলো সরু চ্যাপ্টা এবং দেয়ালের উপরিভাগ পলেস্তারা করা। পলেস্তারার ওপর রয়েছে কারুকাজ। সংস্কারের অভাবে যা অনেকটা খসে পড়েছে। মসজিদটি আয়তাকার এবং এর চারকোণে চারটি ছোট মিনার রয়েছে। উপরে তিনটি গম্বুজ-মধ্যখানের গম্বুজটি বড়, বাকি দুটি ছোট। প্রত্যেক গম্বুজের শীর্ষদেশে পদ্ম ও কলস বসানো হয়েছে। ছাদের কিনারা বরাবর পাঁচিলে নিয়মিত লাইনে পলেস্তারা করা ঝুঁটি বা শিখা বসানো হয়েছে। পূর্বদিকে রয়েছে তিনটি খিলানের দরজা। মধ্যবর্তী খিলানের দরজায়ও পলেস্তারাযুক্ত ঝুঁটি রয়েছে।

মসজিদের সামনের দেয়াল বেশ বৈচিত্র্যময় ও কারুকার্যময়। মুঘল স্থাপত্যরীতি অনুসারে এখানে মধ্যবর্তী খিলানের বেশির ভাগ অংশেই কারুকাজ করা এবং উভয় পাশে দেয়ালের সঙ্গে মিনার রয়েছে। বেশ কয়েকটি আয়তাকৃতি কাঠামোর সাহায্য খিলানটি নির্মিত হয়েছে। এই খিলানের ঠিক উপরেই শিলালিপিটি বসানো হয়েছে। মসজিদের সামনে ইটের সুরকি দিয়ে ঢালাই করা প্রাঙ্গণ। চারপাশে ইটের তৈরি মোটা প্রাচীর। প্রাচীরের পূর্বপাশে চার কোনাকৃতি খিলানের তোরণ। তোরণের ওপর আজান ঘর। তবে সংস্কারের অভাবে জীর্ণ হয়ে পড়েছে প্রাচীন মসজিদটি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেয়ালের দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য।

 

ঐতিহ্য প্রেমের স্মারক মালেকা বানু মসজিদ

মালেকা বানু চৌধুরী মসজিদ। মসজিদের পরতে পরতে আছে ঐতিহ্য, শিল্পনৈপুণ্য ও স্থাপত্যশৈলী। সঙ্গে স্মৃতিস্মারক হয়ে আছে প্রেম, ভালোবাসার। তাই মালেকা বানু মসজিদটি ঐতিহ্য ও প্রেমের স্মারক হয়েছে আছে সবার কাছে। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নে এর অবস্থান। মালেকা বানু চৌধুরীর জন্মস্থান বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নে। এখানেই অবস্থিত মালেকা বানু চৌধুরী মসজিদটি।

মুঘল শাসনামলের শেষ দিকে মালেকা বানু চৌধুরীর পিতা জমিদার আমির মোহাম্মদ চৌধুরী মসজিদটি নির্মাণ করেন। এক সময় মসজিদের পূর্ব পাশেই ছিল বিশাল এক দীঘি। সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে দীঘিটা। এক চোখের পথই ছিল এই মালেকা বানুর দীঘি। দীঘির পশ্চিম পাশে ঐতিহ্যের স্মারক স্বরূপ মালকা বানুর মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে এখনো আছে। মসজিদের দেয়ালের পূর্ব পাশে ফরাসি ভাষায় খোদাইকৃত একটি শিলালিপি ছিল। সেখানে মালেকা বানু চৌধুরী মসজিদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ ছিল। তবে ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে এটি হারিয়ে যায়। ফলে শত শত বছরের প্রাচীন ইতিহাসের স্মৃতিবহ মসজিদটির বিস্তারিত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। জানা যায়, মালেকা বানুর পিতা আমির মোহাম্মদ চৌধুরী তৎকালীন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। তাঁর আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা মালেকা বানু চৌধুরী। তাঁর বাবার জীবদ্দশায় মালেকা বানু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন চট্টগ্রামের আনোয়ারার আরেক জমিদারপুত্র মনু মিয়ার সঙ্গে। মনু মিয়া জমিদার বংশের পুত্র হলেও মালেকা বানু ছিলেন বাঁশখালী থানার সরল গ্রামের বিখ্যাত এক সওদাগর আমির মোহাম্মদের কন্যা। মনু মিয়া একদিন পাইক পেয়াদা (সঙ্গী-সাথী) সঙ্গে নিয়ে জমিদারি তদারকি করতে বাঁশখালীর সরল গ্রামের সওদাগর বাড়িতে পৌঁছে সাময়িক বিশ্রাম নেন। এ সময় মনু মিয়ার অপূর্ব সুন্দরী সওদাগর কন্যা মালেকা বানুকে কাজীর মক্তবে অধ্যয়নরত অবস্থায় দেখতে পান। তখন থেকেই মালেকা বানুর প্রেমে পড়েন মনু মিয়া। এরপর প্রেমের টানে মনু বারবার ছুটে যেতেন মালকা বানুর বাড়িতে। অবশেষে কাজীর মাধ্যমে মালেকার বাবার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন মনু। মালেকার বাবা সওদাগর রাজি হলেও মালেকা বানু বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কারণ হিসেবে মালেকা মনুকে বলেছিলেন, সাম্পানযোগে নদী পার হতে তার ভয় করে। কারণ শঙ্খ নদীর এপারে মনু মিয়ার বাড়ি, ওপারে মালেকার বাড়ি। তাই বধূ সেজে মনু মিয়ার বাড়ি যেতে হলে উত্তাল শঙ্খনদী পাড়ি দিতে হবে। মালেকার মুখে এ কথা শুনে মনু মিয়া স্থির করলেন শঙ্খের বুকে বাঁধ নির্মাণ করবেন। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। মনু মিয়া শঙ্খ নদীর বুকে নির্মাণ করলেন বিশাল এক বাঁধ। তারপর বধূ সাজিয়ে সড়কপথে মনুর রাজপ্রাসাদে এনে তুললেন মালেকাকে। জনশ্রতি আছে, মালেকা বানু ও মনু মিয়ার বিয়ে হয়েছিল খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে। একমাস ধরে চলেছিল তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠান। তাদের সংসারে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। তবে পরে মালেকা বানু স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে পিতৃবাড়িতে চলে আসেন। সাত পুত্র সন্তান ও এক কন্যার জনক আমির মোহাম্মদের আদরের একমাত্র দুলারী মালেকা বানুর স্মরণে বাঁশখালীর সরলে একটি মসজিদ ও দীঘি নির্মাণ করেন। যা ইতিহাসে মালেকা বানুর মসজিদ ও দীঘি নামে পরিচিত। মালেকা বানু মনু মিয়ার প্রেম উপাখ্যান ইতিমধ্যে লোকগাথা, যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। 

 

শৈল্পিক স্থাপত্যে চন্দনপুরা মসজিদ

দৃষ্টিনন্দন, নান্দনিক ও শৈল্পিক-এ জাতীয় সব বিশেষণের সমাহার চট্টগ্রামের চন্দনপুরা মসজিদ। স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শনটি মুঘল আমলেই তৈরি। মসজিদের কারুকাজের কারণে ব্যাপক খ্যাতি আছে দেশ-বিদেশে। শৈল্পিকতার ছোঁয়ায় এখনো দেদীপ্যমান। মসজিদের সুউচ্চ মিনার, দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই শৈল্পিকতার সূক্ষ্ম কারুকাজ।  

১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁর সেনাবাহিনী আরাকান মগরাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রাম মুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন মুঘল শাসন। তখন শাহি ফরমান বলে বিজিত অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ নির্মিত হয়।

এর মধ্যে চন্দনপুরা মসজিদ, হামজা খাঁ মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, অলি খঁঁ মসজিদ অন্যতম। মুঘল শাসনামলে এ স্থাপত্যশিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কয়েকশ’ বছর মসজিদটি মাটি ও টিনশেডের ছিল। এটির প্রথম সংস্কারক ছিলেন মাস্টার হাজী আব্দুল হামিদ। পরে ১৯৪৭ সালে তাঁর পুত্র আবু সৈয়দ দোভাষ মসজিদটি নতুন করে সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এটি তৈরিতে ভারতের লখনৌ থেকে আনা হয় মুঘল ঘরানার কারিগর, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনা হয় নান্দনিক নানা উপকরণ। মসজিদের কাজ শেষ হয় ১৯৫০ সালে। স্থাপত্যশিল্পে তাক লাগানো তিন গণ্ডা আয়তনের মসজিদটির সংস্কার কাজে ব্যয় হয়েছিল প্রায় চার লাখ টাকা। নান্দনিকতা বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ১৫টি গম্বুজ। জনশ্রুতি আছে, সবচেয়ে বড় গম্বুজ নির্মাণে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১০ টন পিতল। এক সময় পিতলে নির্মিত সুউচ্চ গম্বুজটি সূর্যালোকে ঝলমল করত। সত্তরের দশকেও এ মিনারে উঠে আজান দিতেন মুয়াজ্জিন। এ ধরনের দুটি মিনার এখনো আছে। মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদের গম্বুজের চারপাশে আছে আহলে বায়াতে রসুলসহ দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম লেখা। মসজিদটির খ্যাতি আছে দেশ-বিদেশে। চট্টগ্রামের আইকনিক ছবি হিসেবে মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকাশনায়। জাপানের এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয় মসজিদটির ছবি।

প্রতি ওয়াক্তে প্রায় ৩০০ এবং জুমার দিন প্রায় হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করেন। প্রতি মাসে ১৫-২০ জন পর্যটক মসজিদটি দেখতে আসেন। সৌন্দর্য রক্ষায় প্রতি চার বছর অন্তর এটির রং করা হয়।

 

ঐতিহ্যের স্মারক হাম্মাদিয়ার মসজিদ

সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় অবস্থিত প্রাচীনতম হাম্মাদিয়ার মসজিদ। ১৫৩৩ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বাংলার শেষ হোসেন শাহী বংশের সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৫৩৩-১৫৩৮) সুলতানী আমলে ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারকে মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত। মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। বলা হয়, এটি চট্টগ্রাম জেলার দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ। যা হাম্মাদিয়া দীঘির পাশে অবস্থিত। পরে মসজিদের নামেই গ্রামের নামকরণ হয়। অধ্যাপক আবদুল করিমের গবেষণা সূত্রে জানা যায়, গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়কালের চট্টগ্রামের শাসক হামিদ খান এই মসজিদ নির্মাণ করেন। নির্মাতা হামিদ খানের নামে মসজিদের নাম ছিল হামিদিয়া মসজিদ, পরবর্তীতে স্থানীয়ভাবে বিকৃত হয়ে হাম্মাদিয়ার মসজিদ নামটি হয়েছে। মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইমারত। বাইরের দিকে এর প্রতিবাহু ৬ দশমিক ৩৪ মিটার এবং বাইরের চারকোণায় আছে চারটি সংযুক্ত চোঙ্গাকৃতির গোলাকার বুরুজ। প্রত্যেকটি বুরুজ অভিক্ষিপ্ত ভিতসহ ছয় মিটার উঁচু। এর গায়ে রয়েছে খুদিত বুটি দ্বারা অলংকৃত দুটি বন্ধনী, যা বুুরুজটিকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছে। মসজিদটির ছাদ ক্রমানুযায়ী বক্রাকারে তৈরি এবং উপরে স্থাপন করা হয়েছে কন্দাকৃতির একটি বড় গম্বুজ। গম্বুজটি মূলত চারদিকে চারটি স্কুইঞ্চের সাহায্যে নির্মিত অষ্টভুজের উপর স্থাপিত। মসজিদের পূর্ব দেওয়ালে তিনটি খিলান দরজা এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালের প্রত্যেকটির মাঝে একটি করে জানালা। প্রতিটি দরজার বাইরে-ভিতরে রয়েছে দুটি সূচ্যগ্র পাথরের খিলান-ফ্রেম এবং এ দুয়ের মধ্যে আছে টোলের মতো খিলান ছাদ।

 

আরও যত প্রাচীন মসজিদ

নান্দনিক কারুকার্যের উকিল বাড়ির জামে মসজিদ

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কাঞ্চননগর উকিলবাড়ি গ্রামে নির্মিত হয়েছে উকিলবাড়ি জামে মসজিদ। মসজিদটি নির্মাণ করেন মুঘল আমলে তৎকালীন জমিদার মনোহর আলী প্রকাশ বোচা উকিল। দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যে নির্মিত মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। এক গম্বুজ বিশিষ্ট উকিলবাড়ী জামে মসজিদ সম্মুখে একটা বহুকাল পুরনো দীঘি আছে। জনশ্রুতি আছে, ২০০-৩০০ বছর আগের পুরনো ফকির মসজিদে জিনেরা নামাজ আদায় করেছিলেন। তবে জিনপরীরা বেশি দিন এখানে থাকতে পারেননি। জানা যায়, মুঘল আমলে বোচা উকিল সাহেব মসজিদটি নির্মাণ করেন। ভুজপুরের জমিদার কাজী সাহেব উনার এলাকায় বাকলিয়ার তারাকা মিস্ত্রির মাধ্যমে মসজিদটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। লোহা ও সিমেন্ট ছাড়া চুনা ইট ব্যবহারের মাধ্যমে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর উপরে ছোট-বড় ২০টি মিনার আছে। পুরো মসজিদটিই দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত। পাশে নির্মাণ করা হয় মুসাফিরখানা ও নোঙরখানা। পরবর্তীতে উকিল সাহেব এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মুসাফিরখানা পরিচালনায়, বছরে তিনটি মেজবান দিতে মসজিদটির নামে শতাধিক একর জমি ওয়াকফ করে গেছেন। মসজিদটি জমিদার বংশের স্বত্বাধিকারীরা পরিচালনা করছেন।

 

অপরূপ ফকিরপাড়া গায়েবি মসজিদ

প্রায় সাড়ে তিনশত বছর আগে, মুঘল আমলে ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন তখনকার কিছু আলেম। ওই আলেমরা একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। সময়ের বিবর্তনে এটি সবার কাছে ফকিরপাড়া গায়েবি জামে মসজিদ নামে পরিচিত।

এটি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী ফকিরপাড়া এলাকার হারুয়ালছড়ি চৌধুরী বাড়ির পাশে অবস্থিত। তবে এটির প্রতিষ্ঠার সময় কিংবা ব্যয় নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানা যায়নি।  স্থানীয়দের পূর্ব পুরুষদের কাছে এটি গায়েবি হিসেবে পরিচিতি। মসজিদটি দৃষ্টিনন্দন। ছিল কারুকাজ। তিন দফা এর পুনঃনির্মাণ করা হয়। ২০১৪ সালে সবশেষ মসজিদটি ভেঙে মালয়েশিয়ার একটি সুদৃশ্য মসজিদের নকশার অনুকরণে পুনঃনির্মাণ করা হয়। একটি মিনারসহ মসজিদটিতে এক সঙ্গে দুই হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় দুই কোটি টাকা। বহু দূর থেকেও এই মসজিদের নামাজ পড়তে আসেন মুসল্লি। বিশেষ করে জুমার দিন মুসল্লির ভিড় বেশি।

 

মুঘল স্থাপত্যের স্মারক নায়েবে উজির জামে মসজিদ

মোহাম্মদ খান ছিদ্দিকী (রহ.) নায়েবে উজির জামে মসজিদ। মসজিদটি মুঘল আমলে নির্মিত। আয়তাকার আকৃতির মসজিদটিতে আছে তিনটি বড় গম্বুজ। গম্বুজে শোভা পাচ্ছে শৈল্পিক স্থাপনার নিদর্শন। মসজিদের উত্তর পাশে আছে দীঘি, পূর্ব পাশে আছে পুকুর। এ মসজিদে এক সঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন সাতশত মুসল্লি। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের মল্লিক ছোবহান চৌধুরীপাড়ায় মসজিদটির অবস্থান। কালের পরিক্রমায় এটি আজ যুগের সাক্ষী। মুঘল স্থাপত্যের অনন্য মুসলিম নিদর্শন। মসজিদ লিপি অনুযায়ী, এটি নির্মিত হয় ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে। এটি এলাকায় ছোট্ট মসজিদ বা কেরানি মসজিদ হিসেবে পরিচিত। জনশ্রুতি আছে, মোহাম্মদ খান ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের নায়েবে উজির। তিনি তাঁকে মহাস্থানগড় গৌড় রাজ্যের অধিপতি নিযুক্ত করেন। পরে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর মামা শায়েস্তা খানকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। এতে মোহাম্মদ খান অভিমান করে মহাস্থানগড়ের অধিপতি ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। মোহাম্মদ খানের পরবর্তী বংশধররা এখনো এই এলাকায় আছেন এখনো এই এলাকায় আছেন।

 

তাজমহলের আকৃতিতে নির্মিত মসজিদ

চট্টগ্রামের তাজমহল, তবে সেটা আল্লাহর ঘর মসজিদ। নাম আসগর আলী চৌধুরী জামে মসজিদ। এর ছাদে আছে বড় আকারের তিনটি গম্বুজ। আছে ২৪টি মিনার। চারপাশ সাজানো হয়েছে নান্দনিক নকশায় পোড়ামাটির রঙে। কেবল বাইরের দেয়াল নয়, ভিতরের দেয়াল ও পুরো অবকাঠামোজুড়ে আছে মুঘল আমলের স্মৃতিচিহ্ন। শোভা পাচ্ছে নানারকম নকশা। তবে এই মসজিদে নেই কোনো জানালা। চট্টগ্রাম নগরের বড়পুল উত্তর হালিশহর এলাকার চৌধুরীপাড়ায় এটি অবস্থিত। এখনো মসজিদটি দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। জানা যায়, ১৭৯৫ সালে মুঘল স্থাপত্য নকশায় চুন-সুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এটি নির্মাণ করেন হালিশহরের সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের প্রয়াত আজগর আলী চৌধুরী। ১০ শতক জায়গায় নির্মিত মসজিদটির সামনে আছে ১০০ শতক জায়গাজুড়ে বিশাল আকারের পুকুর। মসজিদের দক্ষিণে ২০ শতক জায়গায় আছে কবরস্থান, উত্তরে ২৬ শতক জায়গায় আছে চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত উত্তর হালিশহর সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়। ২২৬ বছর আগে নির্মিত মসজিদটি প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তাই গত চার বছর আগে দুর্লভ ঐতিহ্যের মসজিদটি সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুঘলদের নানা স্মৃতিবিজড়িত মসজিদকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা হয়। স্থানীয়রা পুরাতাত্ত্বিক নির্দশনটি না ভেঙে, এর পেছনে ৭০ শতক জায়গায় নতুন মসজিদটি নির্মাণ করেন চৌধুরী পরিবারের বংশধররা। নতুন মসজিদের নকশাও নজরকাড়া। এটি বানানো হয়েছে সংসদ ভবনের আদলে। এর তিন পাশেই রাখা হয়েছে জলাধার। ওপর থেকে দেখলে মনে মসজিদটি পানির উপর ভাসছে।

 

সর্বশেষ খবর