শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ঠেকাতে ষড়যন্ত্র হয়েছিল

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ঠেকাতে ষড়যন্ত্র হয়েছিল

আজ বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রমনা ময়দানে পাকিস্তানের সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ভারতের পূর্বাঞ্চলের সেনানায়ক জগজিৎ সিং অরোরার কাছে ৯১ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সেই সঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি দেশের সংযোজন হলো। এর আগে ৯ মাস ধরে বাঙালি নিধন যজ্ঞে নেমে পড়েছিল এই নিয়াজি-ইয়াহিয়া বাহিনী। সরকারি হিসাবমতো, বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা দোসর করে নিয়েছিল একদল বাঙালি-বিদ্বেষী বাঙালিকে। এরা পরিচিত ছিল রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস নামে। আর বাঙালিদের খুন করার জন্য এদের ভাড়া করেছিল পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। ৫১ বছর পরেও বাঙালি সে নৃশংস ঘটনার কথা ভুলতে পারেনি, কোনো দিন পারবেও না।

ঢাকায় ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বক্তৃতা, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। পাকিস্তান বাহিনীকে ভাতে মারব, পানিতে মারব। জয় বাংলা।’ সাড়ে ১৭ মিনিটের সেই বক্তৃতা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তৃতা মহম্মদ আলি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে (হিন্দু ও মুসলিম দুটি আলাদা জাতি) ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা আছে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। তাঁর দেশ যে স্বাধীন হয়েছে সে কথা সে সময় জানতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। কারণ তখন তিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেলে বন্দী। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানে লন্ডনে যাওয়ার পথে খবরের কাগজে তিনি প্রথম সে খবর পান। পরে লন্ডনে গিয়ে তাঁর বন্ধু তারাপদ বসু ও ব্রিটিশ সাংবাদিকদের কাছে বিশদে জেনেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাওয়ার কথা। এ কথা তিনি রমনা ময়দানের বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন। তিনি সেই বক্তৃতায় আরও বলেছিলেন, ‘আমার দেশ, আমার সরকারের সঙ্গে এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। আপনারা সবাই সাবধানে থাকবেন।

মনে রাখবেন, আমার ‘দিদি’, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমার দেশের ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আপনারা কেউ তাঁর সঙ্গে বেইমানি করবেন না।’ এবার একবার চোখ বোলানো যাক, এই ১৬ ডিসেম্বরের আগে কী ঘটেছিল। তাজউদ্দীন সাহেব ভারতে ঢুকেই দিল্লিতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে পরামর্শ দেন, ‘আপনি একটি সরকার গঠন করুন। সেই সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবে। আর সেই সরকারকে সাহায্য করবে ভারত সরকার। ৫০ বছর পরে বাংলাদেশে এখন চলছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষসহ নানা অনুষ্ঠান। ইন্দিরার সঙ্গে তাজউদ্দীনের বৈঠকের পর ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় পাঠালেন তাঁর নীতি-নির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান কাশ্মীরি পন্ডিত ডিপি দার-কে। সঙ্গে ছিলেন প্রধান সচিব পি এন হাকসার, বিদেশ সচিব টি এন কল, বিএসএফের প্রধান রুস্তমজিসহ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বাঘা বাঘা অফিসার। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে সংসদের উভয় কক্ষে দাবি ওঠে। লোকসভায় এই দাবি তুলেছিলেন অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি, ত্রিদীপ চৌধুরী। রাজ্যসভায় দাবি তোলেন ভূপেশ গুপ্তসহ অনেক বাঙালি সদস্য। ইতিমধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ১ কোটি মানুষের অস্থায়ী আস্তানা গড়ে তোলা হয়। ইন্দিরা নিজেও সেসব শিবিরে সফর করেন, শরণার্থীদের সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলেন। প্রতিটি সফরেই আমি তাঁর সঙ্গী ছিলাম। আর ছিলেন তখনকার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি আবদুস সাত্তার। ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, কেন তাঁরা এখানে এসেছেন, কারা তাদের ওপর অত্যাচার করছে ইত্যাদি। তখন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখার্জি ও কংগ্রেসের বিজয় সিং নাহারের কোয়ালিশন সরকার। তিনি দিল্লি ফিরে গিয়েই এই কোয়ালিশন সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করেন। আর ত্রাণের ব্যাপারে দায়িত্ব দেন তাঁর মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো ত্রাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় রামকৃষ্ণ মিশন ও ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। বিভিন্ন জেলা শাসকদের পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে যে ১ কোটি মানুষ এসেছিল তাদের খাওয়া-পরা, ওষুধ বণ্টন করেছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোই, কিন্তু তার সরবরাহ করেছিল কেন্দ্র।

নয় মাস এভাবে চলার পর ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। সেদিন ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়। সেদিন ময়দানের ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তাঁর জনসভা। জনসভায় তিনি পাকিস্তানকে কড়া ভাষায় নিন্দা করেন। আমরা যারা সাংবাদিক জনসভার সামনে বসেছিলাম তারা খবর পেয়েছিলাম পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে। এখন আমাদের মধ্য থেকে বসুমতীর সাংবাদিক রণেন মুখার্জি বললেন- মিটিং তো অনেকক্ষণ চলবে আমরা ইন্দিরা গান্ধীকে ধরতে পারব না। চল গিয়ে রাজভবনের গেটে দাঁড়াই, মিনিট ১৫-এর মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী রাজভবনে ঢুকলেন। তার মুখ্যসচিব নির্মল সেনগুপ্ত একগুচ্ছ টেলেক্স নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীকে ওই টেলেক্সগুলো হাতে দিতেই তিনি বললেন, তুমি পড়ে যাও, তিনি পড়ে গেলেন পাকিস্তান গত রাত থেকে শ্রীনগর, জম্মু, পাঠানকোট, দিল্লিসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বোমা ফেলেছে, পাশে দাঁড়ানো সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে তাঁর ডাক নামে ডেকে বললেন- মানু আমি আর রাজভবনের ওপরে যাব না। তুমি আমার সঙ্গে বিমানবন্দরে যাবে? বিমানবন্দরে চলো। আমরাও পেছনে পেছনে বিমানবন্দরে গেলাম। বিমানবন্দরে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে বিমানে ওঠার সময় আমরা তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন করলাম পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে, তিনি মুখ ঘুরিয়ে হাত জোড় করে আমাদের বললেন, তোমরা আমাকে ৩ ঘণ্টা সময় দাও। দিল্লি ফিরে মন্ত্রিসভার বৈঠক করে ভারতসহ বিশ্ববাসীকে রেডিওতে জানাব। আমরা সবাই রাতে রেডিও খুলে শুনলাম ইন্দিরা গান্ধীর কণ্ঠস্বর। আপনারা গুজবে কান দেবেন না। আমি পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেব। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতের এবং বিশ্বের সব সংবাদপত্রে বেরুল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছে। ছয় বছরের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুবের আমলে ভারত আক্রমণ হয়। সেই যুদ্ধে ভারত জয়ী হয়েছিল। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। পূর্ব ভারতে সেই যুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হয়নি কারণ পূর্ব পাকিস্তানে তখন বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাদের স্বাধিকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল। ৯ মাসের ঘটনার কোনো বিরাম ছিল না প্রতি মুহূর্তেই খবর ছিল। ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তান হারাল তাদের একটি অংশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে নাম হলো বাংলাদেশ। ওই ১৩ দিনের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার যৌথ বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে চুরমার করে দিয়েছিল, এর আগে ওই ৯ মাসে ভারতীয় ফৌজ ও তাজউদ্দীনের মুক্তিফৌজের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তাতে স্থির হয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একসঙ্গে লড়াই করবে আর তা করেও ছিল।

অপরদিকে ওয়াশিংটন, বেইজিং, রাওয়ালপিন্ডি একই সুরে ভারত পাকিস্তান ভাঙছে বলে প্রতিদিন বিবৃতি দিতে থাকে। তা বিশ্ববাসী বিশ্বাস করেনি। বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে দেশে ফেরার পথে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো সফর করেন এবং পাকিস্তানের অত্যাচারের নির্মম কাহিনি তাদের বিশদভাবে বুঝিয়ে এসেছিলেন। পূর্ব রণাঙ্গনের দায়িত্বে ছিলেন ‘ইস্টার্ন কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা, জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল ডোলা সরকার, জেনারেল শওগত সিং। এক একটি জায়গা দখলদার খানসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে পরের দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে সামরিক বাহিনীর গাড়িতে সেসব জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো। প্রথমে শত্রুমুক্ত হয় সাতক্ষীরা, বেনাপোল প্রায় যশোরের কাছাকাছি বিভিন্ন এলাকা। ওই সব জায়গায় রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখেছি সাধারণ মানুষের মধ্যে কী উল্লাস। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা এলেন যশোরে। আমরাও গেলাম। হাজার হাজার লোক আমাদের ঘিরে ধরল। যশোরে লুঙ্গি পরিহিত, লম্বা দাড়িওয়ালা বেশ কয়েকজন আমরা বাংলায় কথা বলছি দেখে আমাদের ঘিরে ধরে বললেন, ‘আপনারা কোথা থেকে আইছেন’, তারা বলল, ওই জওহর লাল নেহরুর মাইয়া ‘ইন্দিরা আর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও অল ইন্ডিয়া রেডিও। পাশে দাঁড়িয়ে যুগান্তরের চিফ রিপোর্টার অনিল ভট্টাচার্য বললেন, তোমরা অমৃত বাজারের নাম শোনোনি? এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে অমৃতবাজার গ্রাম। আর ওই গ্রামের নামে অমৃতবাজার পত্রিকা, তোমরা তার নাম শোনোনি, ওরাও তোমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে। অনিল দা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আমাকে এখানেও মেরে দিলি। কষ্ট কল্পিত হলেও এ ধরনের কিছু কিছু ঘটনা আমার মনে পড়ে। আমরা গিয়েছিলাম দর্শনা-চুয়াডাঙ্গায়। আমাদের সঙ্গে কিছু আমেরিকান সাংবাদিক ছিল।

ইজ ইট ইস্ট পাকিস্তান, পিটিআইয়ের রিপোর্টার দীপক বসাক বললেন, ‘নো, দিস ইজ বাংলাদেশ, এ নিয়ে দীপক ও ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আমেরিকার সাংবাদিকদের বেশ কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল। দীপক চিৎকার করে বলল, সাহেব Mustard flower চেনো, চোখে ঘষে দেব। যাই হোক, আর যারা ছিল তারা দীপককে থামিয়ে দিল। ৬ ডিসেম্বর অফিসে ফিরে শুনলাম সংসদে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি ঘোষণা করেছেন। আর শহরজুড়ে মাইকে বাজানো হচ্ছে আমার ‘সোনার বাংলা...।’ আর একটি জনপ্রিয় গান ছিল ‘একটি মুজিবের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবের কণ্ঠ...।’ সেদিন রাতেই থিম্পু থেকে ভুটান সরকার বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি ঘোষণা করল। ১২ কী ১৩ তারিখ সঠিক আমার মনে নেই, পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তানি কমান্ডার জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে যোগাযোগ করা হয়। নিয়াজি তাদের ঢাকায় যেতে বলেন। জেনারেল ডোরা, জেনারেল শওগত সিং, জেনারেল জ্যাকব ও জেনারেল ডোলা সরকার- সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নামেন। এই জেনারেলরা নিয়াজিকে বলেন, আপনি ও আপনার ফৌজ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। কারণ বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ এলাকা এখন আমাদের দখলে। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আপনি, আপনার পরিবার ও আপনার ফৌজকে আমরা সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেব। নিয়াজি নাছোড়বান্দা, নিয়াজি পাল্টা প্রস্তাব দেয়- ‘যুদ্ধবিরতি, আত্মসমর্পণ নয়’। এ নিয়ে ওদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা-কাটাকাটি হয়। জেনারেল জ্যাকব নিয়াজিকে বলেন, আপনি পাশের ঘরে যান, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলুন। আমরা আর বেশি সময় দিতে পারব না। আমাদের সন্ধ্যার মধ্যেই কলকাতা ফিরে যেতে হবে। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলে এসে নিয়াজি হাত তুলে দিয়ে বললেন, আত্মসমর্পণ করলাম। কলকাতা ফিরে এসে সন্ধ্যার পর সাংবাদিক বৈঠক ডেকে পূর্ব রণাঙ্গনের পাকিস্তানের সামরিক প্রধানের আত্মসর্পণের সিদ্ধান্তের কথা জানান। সেই বৈঠকে ছিলেন ভি.পি দার, পি.এন হাকসার ও জেনারেল মানেকশ। রাতের দিকে দক্ষিণ কলকাতার এক হোটেলে গিয়ে দেখি তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঢাকা শহরের একটি মানচিত্র দেখিয়ে ভারতীয় সেনাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কোথায় কোথায় ঘনবসতি আছে, সেখানে যেন বোমা ফেলা না হয়।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে একটি দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু সেই স্বাধীনতা কীভাবে এলো তা আমরা শুধু রিপোর্ট করিনি, চোখেও দেখেছি। যখন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আমার মনে আছে তৎকালীন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাবু জগজীবন রাম কলকাতার প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন। সেই সাংবাদিক বৈঠকের দুই দিন আগে ওয়াশিংটন থেকে ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য তারা পাকিস্তানে সত্বর যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে (7th Fleet)। এ ব্যাপারে বাবুজীকে প্রশ্ন করা হলে নিরুত্তাপ বাবুজী একটু হেসে বললেন, ‘ভারতকে লিয়ে সোভিয়েটসে অষ্টম নৌবহর আ চুকা, উনকো আনে দো, উচিত শিক্ষা দিয়ে দেব।’ যুদ্ধের পরে বাবুজী ঢাকায় গিয়েছিলেন। তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন কেটেছে কলকাতায়। তিনি বাংলায় কথা বলতেন। আমাকে তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন তাঁর কলকাতার প্রেস ক্লাবের সেই উক্তি।

তা যাই হোক, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তান যে ষড়যন্ত্র করেছিল তার একটি উল্লেখ করছি। সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাজউদ্দীন সরকারের বিদেশমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাঁর সচিব মাহবুবুল আলম চাষী, সাংবাদিক তাহেরউদ্দীন ঠাকুর ও চার-পাঁচজন মিলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে তারা ভাষণ দেবেন এবং সেখানে তাঁরা বলবেন, আমরা এই স্বাধীনতা চাই না, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চাই, এই ভাষণটির খসড়া তৈরি হয়েছিল রাওয়ালপিন্ডিতে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে সেই খসড়াটি পৌঁছে যায়। ভারতের গোয়েন্দারা তখন ওঁতপেতে থাকেন। আমার মনে আছে, এমনই একদিন সকাল থেকে যুদ্ধসংক্রান্ত খবরের সূত্রগুলোতে বারবার ফোন করি, কিন্তু কেউ আমার ফোন ধরেনি। অফিসে বসেছিলাম। হঠাৎ বিএসএফের জয়েন্ট ডিরেক্টর শরদীন্দু চট্টোপাধ্যায় খুব আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, খবর যদিও চাও তবে একজন ফটোগ্রাফার নিয়ে ৫টার মধ্যে বিমানবন্দরে এসো। আর বিমানবন্দরে প্রচুর পুলিশ ঘেরা। কী হচ্ছে আমি বুঝতে পারিনি, শরদীন্দু আমাকে ইশারায় বললেন, কাউন্টারের দিকে যেতে। সেখানে গিয়ে দেখি খন্দকারের সচিব মাহবুবুল আলম চাষী কাউন্টারে টিকিটগুলো দিয়ে নিউইয়র্কের বোর্ডিং পাস নিচ্ছিল, তখনই ভারতীয় গোয়েন্দারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সব টিকিট কেড়ে নিলেন আর বললেন, আপনারা এত বড় দেশদ্রোহী! চলুন, পুলিশের গড়িতে উঠুন। তাদের আর সেদিন নিউইয়র্কে যাওয়া হয়নি। তাদের সরাসরি কড়া নিরাপত্তার সঙ্গে সুন্দরী মোহন এভিনিউয়ের বাড়িতে যেখানে তারা থাকত সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই জিয়া মোশতাককে ক্ষমতায় বসিয়ে নিলেন।  মোশতাকের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়ায় মুক্তিবাহিনী এবং বাংলাদেশের নেতারা এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তারা মোশতাক ও মাহবুবুল আলমকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ভারত সরকার তাদের নিরস্ত করেছিল।

৯ মাসের খবরের অভাব ছিল না আর ঘটনারও বিরাম ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে সম্ভবত আমিই প্রথম একটি বই লিখেছিলাম- ‘মিডনাইট ম্যাসাকার ইন ঢাকা’। জিয়া সেই বইটি শুধু নিষিদ্ধই করেনি, যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন আমার বাংলাদেশে ঢোকাও নিষিদ্ধ করেছিলেন। ৯ মাসের সব ঘটনা এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশে থাকাকালীন যেসব ঘটনা নিজের চোখে দেখেছি ও রিপোর্ট করেছি, তার সব লিখতে গেলে বোধহয় একটা মহাভারত হয়ে যাবে।

যাই হোক, পরিশেষে একটা কথাই বলব। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, দিল্লি হয়ে ঢাকায় পৌঁছানোর পর রমনা ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি তাঁর দেশের মানুষ ও সরকারের প্রতি ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন।  তাঁর সেই আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে স্বাধীনতার চার বছরের মাথাতেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে।  বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্য, তাঁর আদর্শ, নীতি ও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা-চিন্তাকে বাস্তব রূপ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন তারই সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনা। আজ হাসিনার নেতৃত্বেই সগৌরবে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’।

লেখক :  ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর