শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

হজের সেকাল ও একাল

সুমন পালিত

হজের সেকাল ও একাল

মুসলমানরা কাবা ঘরকে কেন্দ্র করে যে ইবাদত করেন তা হলো হজ। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ সৃষ্টির আগে ফেরেশতারা আল্লাহর ইবাদতের জন্য কাবা ঘর নির্মাণ করেন। দুনিয়ার প্রথম মানব হজরত আদম (আ.) কাবা ঘরের পুনঃনির্মাতা। বিশ্বাসীদের আদি পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এবং পরবর্তীতে মহানবী (সা.) এই পবিত্র গৃহ সংস্কার করেন। এ বছর রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি হজ পালন করছেন। যাদের অর্ধেকেরও বেশির বয়স ৫০-এর উপরে। বয়সের ভারে ন্যুব্জে পড়া হজযাত্রীর সংখ্যাও কম নয়। অথচ এক সময় হজযাত্রা ছিল যুদ্ধযাত্রার মতো। দলবদ্ধভাবে হাজার হাজার লোক দিনের পর দিন পাড়ি দিত বিভিন্ন প্রান্তর। ডাকাত ও লুটেরার দল হানা দেওয়ার চেষ্টা করত এসব হজ কাফেলায়। ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, আর্থিক দিক থেকে সংগতি আছে এমন সব মুসলমানের জন্য হজ ফরজ। এ ধর্মীয় নির্দেশ পালনে সেই মধ্যযুগেও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে পদব্রজে অথবা ঘোড়া বা উটের পিঠে মানুষ হজে যেত। হজ পালনের জন্য যাতায়াত বাবদই চলে যেত কয়েক মাস। বৃদ্ধ বা শারীরিক দিক থেকে কোনো দূরদেশীর পক্ষে হজ পালন ছিল একেবারে অসম্ভব। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত হজযাত্রীরা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজির হতেন ইরাকের বাগদাদ, সিরিয়ার দামেস্ক এবং মিসরের কায়রোতে। সেখান থেকে বিশাল কাফেলাসহ হজযাত্রীরা যেতেন মক্কা অভিমুখে। একেকটি দলে থাকত ৩০-৪০ হাজার হজযাত্রী। কায়রো থেকে যেসব হজ কাফেলা মক্কা অভিমুখে যেত তাদের সময় লাগত গড়ে ৩৭ দিন। হজযাত্রীরা মক্কায় যেতেন পারলৌকিক কল্যাণের লক্ষ্যে। স্রষ্টার নির্দেশের প্রতি নিজেদের আনুগত্যের প্রতিফলন ঘটাতে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি হজ কাফেলার সঙ্গে নেওয়া হতো অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ। কায়রো, দামেস্ক কিংবা বাগদাদ যে পথ ধরেই মক্কায় যাওয়া হতো না কেন পদে পদে ছিল বিপদের হাতছানি। হজ কাফেলাগুলোকে পাড়ি দিতে হতো দীর্ঘ মরুপথ। উট ছাড়া সে পথে পথচলা ছিল দুরূহ। যাত্রাপথে প্রায়ই হাজির হতো দুর্ধর্ষ বেদুইনরা। তারা অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ত হজযাত্রীদের ওপর। সব কিছু লুট করে নেওয়ার চেষ্টা করত। বাধা দিলে প্রাণ কেড়ে নিতেও কোনো কার্পণ্য করত না তারা। যাত্রাপথে ডাকাতদের হামলার আশঙ্কাও ছিল পদে পদে। যে কারণে হজ কাফেলা এগুতো একসঙ্গে হাজার হাজার লোক নিয়ে। অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মক্কা-মদিনা কর্তৃপক্ষ হজ কাফেলা যেসব পথ দিয়ে যাতায়াত করত সে পথের বিভিন্ন বেদুইন গোত্রের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। নিরাপদ হজ ভ্রমণের জন্য তারা চুক্তির শর্তানুযায়ী নিশ্চয়তা দিত। এর বিনিময়ে পেত নগদ অর্থ। এ যুগে কারও পক্ষে ১৫ দিনের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে গিয়েও পবিত্র হজের সব আনুষ্ঠানিকতা পালন করে নিজের ঠিকানায় ফিরে আসা সম্ভব। অথচ এক সময় আমাদের দেশ থেকে যারা হজে যেতেন তাদের সময় লাগত কমপক্ষে ৫-৬ মাস। কারও কারও জন্য এক বছরেরও বেশি।

সম্ভবত এই উপমহাদেশে মুঘল শাসন কায়েমের পর সমুদ্রপথে হজযাত্রা শুরু হয়। সে সময় সমুদ্রপথ ছিল শতগুণ ঝুঁকিপূর্ণ। জলদস্যুদের উৎপাত ছিল নিয়মিত ব্যাপার। ঝড়-ঝঞ্ঝার ব্যাপার তো ছিলই। পালতোলা জাহাজে সমুদ্র ভ্রমণও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সে তুলনায় স্থলপথে হজে যাওয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হলেও নানা কারণে এ দেশের হজযাত্রীদের জন্য তা সুখকর ছিল না। প্রথমত, হজ করতে যেতে হতো সেকালের পারস্য বা আজকের ইরান হয়ে। ইরানিরা ধর্মীয় বিশ্বাসে ইসলামের শিয়া সম্প্রদায়ের। অন্যদিকে বাংলাদেশ বা ভারতীয় উপমহাদেশের সিংহ ভাগ মুসলমান সুন্নি মতাবলম্বী। শিয়াদের বিরূপ আচরণের মুখে পড়তে হতো তাদের। মধ্যযুগে শিয়া ও সুন্নিদের বিরোধ এতটাই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছিল যে, এক পক্ষ অপর পক্ষের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব দেখানোকে পুণ্যের কাজ বলেও মনে করত। সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের হজযাত্রীদের কাছে আতঙ্ক বলে বিবেচিত হতো পর্তুগিজ জলদস্যুরা। ইউরোপে সে সময় পর্তুগিজরা কট্টর খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত ছিল। লুটপাটের পাশাপাশি ধর্মীয় তাগিদও অনুভব করত তারা হাজীবাহী জাহাজে হামলা করার ক্ষেত্রে। পরবর্তীতে অবশ্য হজযাত্রী জাহাজগুলো পর্তুগিজ জলদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতায় আসে। আর্থিক সুবিধা দিয়ে পাস দেওয়া শুরু করে পর্তুগিজ কর্তৃপক্ষ। এ উপমহাদেশে ইংরেজ বা ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আগে মুঘল সম্রাটসহ বিভিন্ন মুসলিম শাসক হজযাত্রীদের নানা ধরনের সহায়তা দিতেন। গরিবদের বিশেষ করে আলেমদের রাজকীয় খরচে হজে পাঠানো হতো। পুরুষদের পাশাপাশি মুঘল আমলে নারীদেরও হজে যাওয়া শুরু হয়। অবশ্য অভিজাত পরিবারের সদস্যরাই এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেত। সম্রাট আকবর নিজে ছিলেন দিন-ই ইলাহি নামের এক নতুন ধর্মের প্রবর্তক। নিজেকে ঈশ্বরের অবতার বলেও ভাবতেন তিনি। তবে এক সময় সম্রাট আকবর ছিলেন ইসলামের প্রতি নিষ্ঠাবান। আকবর তার এক বেগমকে হজ পালনে মক্কায় পাঠান। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমল থেকে মহিলাদের হজে পাঠানো শুরু হয়। সম্রাট হুমায়ুনের বোন অর্থাৎ সম্রাট আকবরের ফুফু গুলবদন বেগম ছিলেন সে সময়কার বিখ্যাত মহিলা হাজী। আকবরই তার হজ পালনের সব ব্যবস্থা করেন। মুঘল আমলে রাজকীয় যেসব হজযাত্রীর নাম জানা যায় তার অন্যতম বৈরাম খাঁ। কিশোর বয়সে আকবর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে বৈরাম খাঁ তার অভিভাবক নিযুক্ত হন। চারদিকের বিপদ থেকে মুঘল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন তিনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের কানকথায় সম্রাট আকবরের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বৈরাম খাঁকে দূরে রাখার জন্য সম্রাট তাকে একবার হজে পাঠান। সেবার চার বছর বৈরাম খাঁ ছিলেন মক্কা-মদিনায়। সেখান থেকে দেশে ফেরার পর আবারও তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হন। আকবর বৈরাম খাঁর চোখ তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন। তারপর সুস্থ হলে দয়া করে হজে পাঠান তাকে। কিন্তু হজে যাওয়ার পথে গুজরাটে মুঘলদের শত্রুর হাতে প্রাণ হারান বৈরাম খাঁ। শুধু বৈরাম খাঁ নয়, অসন্তুষ্ট ঘনিষ্ঠজনদের দূরে রাখার জন্য মুঘল সম্রাটরা হজে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন এমন বিশিষ্টজনের সংখ্যা কম নয়। অবশ্য সব ক্ষেত্রেই হজের খরচ দেওয়া হয়েছে রাজকীয় কোষাগার থেকেই।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর