মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

আনন্দবাজারের সেই সময় এই সময়

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আনন্দবাজারের সেই সময় এই সময়

ভারতে সাংবাদিকতার পথ চলা শুরু হয়েছিল আজ থেকে ২৪২ বছর আগে, ১৭৮০ সালে, অগাস্টাস হিকির হাত ধরে। তার ৩৮ বছর পর, ১৮১৮ সালে শুরু হয় বাংলা সংবাদপত্রের প্রকাশনা। তিনটি বাংলা পত্রিকা প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়- দিগ্দর্শন, সমাচার দর্পণ এবং বাঙ্গাল গেজেটি। সেই হিসেবে বাংলা সংবাদপত্রের যাত্রাকাল দুই শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। আর এই যাত্রাপথকে আলোকোজ্জ্বল করেছেন শ্রী অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মনীষীরা। তাই বাংলা নবজাগরণ থেকে বাঙালি জীবনের প্রতি পদে মিশে গেছে বাংলা সংবাদপত্র। পরবর্তীকালে সংবাদপত্র থেকে জন্ম নিয়েছে নানা ধরনের সাময়িকী।

ইংরেজ আমলে প্রকাশিত দেশীয় সংবাদপত্রগুলোর অধিকাংশই ছিল ব্রিটিশবিরোধী। তাই ইংরেজ সরকার নানা অছিলায় সব কাগজকে সমস্যায় ফেলত, বহু সাংবাদিককে গ্রেফতার করে জেলে পুরত, কাগজ বন্ধ করে দিত। এভাবে লড়াই করতে করতে বহু কাগজ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া একটি মাত্র বাংলা সংবাদপত্রই আজও স্বমহিমায় বিরাজিত। সেটি হলো কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা। ১৯২২ সালে শুরু হওয়া এই সংবাদপত্র আগামী ১৩ মার্চ শতবর্ষ অতিক্রম করবে। আজও এই বাংলা সংবাদপত্রটি ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত আঞ্চলিক ভাষার দৈনিক। পাঠকের কাছে পূর্ণ দায়বদ্ধ এই সংবাদপত্র গোষ্ঠী প্রফুল্ল কুমার সরকার, অশোক কুমার সরকার, অভীক সরকার, অরূপ সরকারের হাত ধরে চার প্রজন্মের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। আরও একটি বাংলা সংবাদপত্র বহু বছর ধরে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছে। সেটি হলো বাংলাদেশের ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইত্তেফাক। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ৬৮ বছর পূর্ণ করেছে এই সংবাদপত্র।

আনন্দবাজার পত্রিকার জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালের ১৩ মার্চ, দোলপূর্ণিমার পুণ্যতিথিতে। তার এক দিন পর পথ চলা শুরু করে বাংলা সংবাদপত্র ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’। ঢাকা থেকে প্রকাশিত এই সংবাদপত্রটিও পাঠকের প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধতা বজায় রাখার শপথ নিয়ে আগামী মাসে ১৩ বছরে পদার্পণ করবে। এই কাগজের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেশ অদ্ভুতভাবে। ২০১০-১১ সাল নাগাদ এই কাগজের কার্যনির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিব দিল্লি এসেছিলেন। দিল্লি থেকে কোনোভাবে আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ফ্লুরিজ রেস্টুরেন্টে ওঁকে আসতে বলি। সেখানে ওঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে আমার লেখা বই ওঁকে উৎসাহিত করেছিল। তা নিয়েও অনেক কথা হয়। পরদিন তিনি আমার বাড়িতে আসেন। এবং আমাকে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ কাগজে নিয়মিত লেখার কথা বলেন। এরপর আমি যখন ঢাকায় যাই, তখন আমার সেখানকার এক বন্ধু বলেন, ‘পীর হাবিব আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আজ আপনাকে ওঁরা মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেছেন।’ আমি এ কথা শুনে সেই বন্ধুর সঙ্গে গেলাম বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা দফতরে। সেখানে পীর হাবিব পরিচয় করিয়ে দিলেন পত্রিকার সম্পাদক নঈম নিজামের সঙ্গে। দুজনেই অত্যন্ত ভদ্রলোক। আলাপ আরও গাঢ় হতে বুঝতে পারলাম। তাঁরা দুজনেই খুব দক্ষ, সৎ এবং সাহসী মানুষ। সংবাদপত্র জগতে এমন মানুষের আজ বড়ই অভাব। যাই হোক, ওঁদের অনুরোধে এরপর থেকে আমি বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখতে শুরু করলাম। এভাবেই এই কাগজের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূত্রপাত। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে লেখা আমার বই প্রকাশিত হওয়ার পর আমি জিয়া সরকারের কোপে পড়েছিলাম। আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকেও ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে দেওয়া হয়। এত বছর পর পীর হাবিব এবং নঈম নিজামের হাত ধরেই বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং পাঠক সমাজের কাছে আমার পুনর্জন্ম হলো। এ জন্য আমি তাদের দুজনের কাছে চিরঋণী।

বছরখানেক আগে পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিব ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি হন। মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। ফের কয়েক মাস বাদে ভর্তি হন চিকিৎসার জন্য। সেবারও সুস্থ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ঢাকায়। পীর হাবিব আমায় অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ নিয়ে একটি বই লিখতে। সে কাজ আমি শেষ করে প্রকাশককে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। শিগগিরই বইটি প্রকাশিত হবে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, বইটি ছাপা হওয়ার আগে তিনি দেখতে পেলেও ছাপার অক্ষরে দেখে যেতে পারলেন না। আমি জানুয়ারির ৩ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় ছিলাম। সে সময় পত্রিকা দফতরে গিয়েছিলাম, কিন্তু পীর হাবিব অফিসে আসেননি। তাই আমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। শুধু ফোনে কথা হয়েছিল। আমি কলকাতায় ফিরে আসি। এরপর পীর হাবিব করোনায় আক্রান্ত হন এবং ৫ ফেব্রুয়ারি চিরদিনের জন্য কলম বন্ধ করে চলে যান না ফেরার দেশে।

এবার দেখা যাক, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অবক্ষয় ঘটছে কীভাবে। পাঠকদের সামনে স্বল্প পরিসরে সে চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

গত শতকের পাঁচের দশকে কলকাতার ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়ানোর প্রতিবাদে বামপন্থিরা যখন চৌরঙ্গীতে সভা করছিল, তখন পুলিশ সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ করে। বহু সাংবাদিক আহত হন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় নিজে হাসপাতালে গিয়ে সাংবাদিকদের দেখে আসেন এবং তাদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক সত্যেন মজুমদার প্রথম পাতায় সম্পাদকীয় লিখেছিলেন- ‘পুলিশ ব্রিটিশদের জারজ সন্তান’। তখনকার দিনে বহুল প্রচারিত আরেক বাংলা সংবাদপত্র ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন-‘পুলিশ জননীর গর্ভের লজ্জা’।

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা প্রথম শুরু হয় ১৯৭৫ সালের ২৪ জুন দেশে জরুরি অবস্থা জারির সময় থেকেই। সেই সময় সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ জারি করা হয়। দক্ষিণ ভারতের নামি সংবাদপত্র ‘দ্য হিন্দু’-এবং দিল্লি ও ১৮টি রাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সরকার বন্ধ করে দেয়।

আনন্দবাজার পত্রিকা বন্ধ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ও চেষ্টা করেছিলেন। একই চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ও। প্রায় নয় মাস ধরে আনন্দবাজার পত্রিকা অধিগ্রহণ করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। সে সময় কেন্দ্রের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী ছিলেন বিদ্যাচরণ শুল্কা। কেন্দ্রের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব মোস্তাক মুর্শেদ এ কথা জানতে পেরে তা জানিয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মন্ত্রী এবিএ গণি খান চৌধুরীকে। তিনি তখন সব কাজ ফেলে সেদিনই দিল্লি চলে যান। সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সব কথা খুলে বলেন। ইন্দিরা তাঁর পুত্র সঞ্জয়কে সংশ্লিষ্ট ফাইলটি আনতে বলেন। গণি খান উত্তেজিত হয়ে সে ফাইল ইন্দিরাজির সামনেই ছিঁড়ে ফেলেন। বলেন, এভাবে সংবাদপত্র অধিগ্রহণ করে পত্রিকা এবং সাংবাদিকদের অধিকার খর্ব করা যায় না। এভাবেই সে যাত্রা ভেস্তে গিয়েছিল আনন্দবাজার অধিগ্রহণের পরিকল্পনা। আর একবারের ঘটনা বলি, ইন্দিরা গান্ধী শান্তিনিকেতনে গেছেন সমাবর্তন উপলক্ষে। তার একদিন আগেই জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ ওঠেনি।

আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, ‘ম্যাডাম, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো, কিন্তু সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ এখনো তোলা হলো না কেন?’ এ কথা শুনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রবল আপত্তি জানালেন। ইন্দিরা গান্ধী কিন্তু বললেন, ঠিক আছে, আমি দিল্লি যাচ্ছি। গিয়েই সংবাদপত্রের ওপর থেকে সেন্সরশিপ তুলে নেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি।’ সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচারের আরও অনেক ঘটনা আছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় একবার তিন সাংবাদিক-তুষার পণ্ডিত, বরুণ সেনগুপ্ত আর আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। রাজ্য সরকারের এ কাজ করার এখতিয়ার নেই, তবু তারা করেছিলেন। যদিও শেষমেশ কারও পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা যায়নি।

সংবাদপত্র জগৎ ও সাংবাদিকদের এ লড়াইয়ের ছবিটা আজ অনেক পাল্টে গেছে। সংবাদ মাধ্যমকে আজ পয়সা ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে নিজেদের গোলাম করে রাখার চেষ্টা করছে সরকার। সাংবাদিকদের মধ্যেও বেশ কয়েকজন এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়েছেন। কলকাতারই এক সাংবাদিক গ্রেফতার হন বিভিন্ন দুর্নীতির দায়ে। তাঁর বাড়ি তল্লাশি করে নগদ ৩৫০ কোটি টাকা এবং কয়েক শ ভরি সোনা-রুপা-হীরা পাওয়া যায়। আরও অনেক সাংবাদিক ও সংবাদপত্র এমন অনৈতিকভাবে কাজ করে চলেছেন। সরকার তাদের যেমন বলছে, তারা তেমন লিখছে। ভারতের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতেন। শুধু এদেশ নয়, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র নেতাই সংবাদ মাধ্যমকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি জার্মানির অত্যাচারী শাসক, একনায়ক ও স্বৈরাচারী বলে ইতিহাস কুখ্যাত অ্যাডলফ হিটলারও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংও সাংবাদিকদের মান্যতা দেন। যাই হোক, সংবাদ মাধ্যমের যে ভূমিকা আগে ছিল বা আজও থাকা উচিত; তার অনেকটাই আজ আর দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা সাংবাদিকদের নিজেদের লোভের কারণে, আর কিছুটা সরকারের চাপে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে আখেরে গণতন্ত্রের ক্ষতি হবে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভকে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতেই হবে, যা ছিল নেহরুর স্বপ্ন। সম্পাদক নঈম নিজাম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলাদেশ প্রতিদিন-কে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁকে প্রশংসা করি। সুস্থতা ও কল্যাণ কামনা করি।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক (ভারত)।

সর্বশেষ খবর