মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

একাত্তরকে নতুন প্রজন্ম স্মরণ করবে কীভাবে

মহিউদ্দিন আহমদ

একাত্তরকে নতুন প্রজন্ম স্মরণ করবে কীভাবে

আমরা উদযাপনপ্রিয় জাতি। আমাদের আছে বিশেষ বিশেষ দিবস ও মাস। ওই মাসগুলোর এক বা একাধিক দিনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো নিয়ে আমরা স্মৃতিকাতর হই। মাস পেরোলে আমরা ভুলে যাই। জানুয়ারি হলো গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হওয়ার মাস। জানুয়ারির দিনগুলোতে আমরা ফিরে যাই ১৯৬৯ সালে। ফেব্রুয়ারি হলো ভাষার মাস। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে নানা আয়োজন থাকে মাসজুড়ে। মার্চ হলো স্বাধীনতার মাস। একাত্তরের এ মাসে আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। আগস্টজুড়ে আমরা পালন করি শোকের মাস। স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর। ১৬ ডিসেম্বর এ দেশ হানাদারমুক্ত হয়েছিল, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। এ মাস হলো বিজয়ের মাস।

এ বছর বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপিত হবে। থাকবে নানারকম আনুষ্ঠানিকতা। একদিকে চলবে আনন্দ-উৎসব, অন্যদিকে আমরা স্মরণ করব দীর্ঘ ২৩ বছরের ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রাম ও এর চূড়ান্ত পর্বে মুক্তিযুদ্ধে যাঁদের হারিয়েছি, তাঁদের কথা। যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাদের দীর্ঘশ্বাসে এখনো বাতাস হয় ভারী। আলোকসজ্জার আড়ালে শহীদদের আর্তনাদ আর অবরুদ্ধ দেশের লাঞ্ছিত মানুষদের দুঃসহ স্মৃতি ঢাকা পড়ে না।

আমাদের স্বাধীনতা এক দিনে আসেনি। আমাদের বিজয় কারও দয়ার দান নয়। এ ছিল এক অভিনব উদ্ভাসন, যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন কোটি কোটি মানুষ। স্মরণকালের ভয়াবহতম গণহত্যা আর জনযুদ্ধের বিজয়-এ নিয়েই আমাদের একাত্তরের গল্প। যে গল্পটি আজও আমরা সবটা জানি না। প্রয়াত কবি-সাংবাদিক মাশুক চৌধুরীর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

 

“ইতিহাসের বুকের ওপর

হাজার বছরের পুরোনো একটা পাথর ছিল

সেই পাথর ভেঙে ভেঙে

আমরা ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতা

এই ইতিহাসটুকু আজও লেখা হয়নি।”

 

আমাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্ণধাররা দায়িত্ব নেওয়ার সময় শপথবাক্যে বলেন-‘কোনো অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হইয়া আমরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করিব।’ এ শপথ তাঁরা কতটুকু মেনে চলেন, তা নিয়ে আছে বিরাট এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তাঁদের কথায়, কাজে, আচরণে ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা অহরহ শপথ ভঙ্গের উদাহরণ পাই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায়ও আমরা দেখি তার প্রতিফলন, অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে নানান বয়ান। ৫০ বছরেও আমরা এক মোহনায় এসে মিলতে পারিনি।

এ দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রচণ্ড হুঙ্কার তুলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ ভারতে চলে গেল। প্রায় ১ কোটি লোক নানান লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়ে প্রাণ বাঁচাতে শেষমেশ ঘর ছেড়ে সীমান্তের ওপারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। অবরুদ্ধ দেশে পড়ে থাকল ৭ কোটির মতো অসহায় মানুষ। কীভাবে তাদের দিন কেটেছে, তা যাঁরা দেখেননি, তাঁরা কখনো যুদ্ধ ও নৃশংসতার ভয়াবহতার মাত্রা বুঝতে পারবেন না। তাঁদের কিছু গৎবাঁধা কথাবার্তা আছে- ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত, ঘরবাড়ি পোড়ানো ইত্যাদি। এর পাশাপাশি আছে কোটি কোটি অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু আর সাধারণ ঘরের তরুণদের উজ্জ্বল-সাহসী প্রতিরোধের লড়াই।

এ দেশের তরুণরা নিজের বা পরিবারের জন্য যুদ্ধ করেননি। তাঁরা যুদ্ধ করেছেন দেশের সব মানুষের জন্য। তাঁদের আশ্রয় দিতে গিয়ে তাঁরা সর্বস্ব হারিয়েছেন। গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য না করলে এ দেশটা কখনোই স্বাধীন হতো না। এই যে ত্যাগ, তার জন্য তাঁরা কিছু প্রত্যাশা করেননি। আমরা যারা দেশের ভিতরে সশস্ত্র প্রতিরোধের লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলাম এবং আমাদের যাঁরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, আমাদের তখন একটাই মন্ত্র ছিল-জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন।

একাত্তরের এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সূত্র টেনে আমরা অনেকেই স্বাধীনতার চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করি-সাম্য, মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার। আমরা এ ঘোষণাপত্র একাত্তর সালে পড়িনি, দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার কীভাবে চলত, তা আমাদের জানা ছিল না। আমরা থাকতাম গ্রামে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতাম। শহরগুলো ছিল প্রতিক্রিয়ার দুর্গ। গ্রামগুলো ছিল স্বাধীন। সমাজপতিরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করে স্থানীয় প্রশাসন চালাতেন। চুরি-ডাকাতি ছিল না বললেই চলে। ফ্ল্যাশব্যাকে মনে হয়, আমরা একাত্তরে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ছিলাম। কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে আমরা যারা এ লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম একটা সুন্দর দেশ হবে।

আমরা আসলে কী চেয়েছিলাম? একাত্তরের এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সূত্র টেনে আমরা অনেকেই স্বাধীনতার চেতনাকে সংজ্ঞায়িত করি-সাম্য, মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচার। আমরা এ ঘোষণাপত্র একাত্তর সালে পড়িনি, দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার কীভাবে চলত, তা আমাদের জানা ছিল না। আমরা থাকতাম গ্রামে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতাম। শহরগুলো ছিল প্রতিক্রিয়ার দুর্গ। গ্রামগুলো ছিল স্বাধীন। সমাজপতিরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করে স্থানীয় প্রশাসন চালাতেন। চুরি-ডাকাতি ছিল না বললেই চলে। ফ্ল্যাশব্যাকে মনে হয়, আমরা একাত্তরে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ছিলাম।

কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে আমরা যারা এ লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম একটা সুন্দর দেশ হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এখন যেসব তত্ত্ব বা আর্টিকুলেশন হয়, তখন এ রকম ছিল না। একটা ভাসা-ভাসা স্বপ্ন ছিল-বিদেশিদের শোষণ-নির্যাতন থাকবে না, সমাজে বৈষম্য থাকবে না, আমাদের সবার জীবনে সমৃদ্ধি আসবে। এটুকুই চাওয়া। তাই দেশটা ভালো চললে আমরা খুশি হই। ঠিকমতো না চললে আমাদের হতাশা বাড়ে। তখন মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের এ আত্মত্যাগ কি বৃথা গেল?

ছবি : রঘু রায় (মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১)

ডিসেম্বর এলেই আমরা স্মৃতিকাতর হই। শুধু ৯ মাসের প্রতিরোধ পর্বের নয়, ৫০ বছরের একটা ব্যালান্স শিট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেখানে দেখি প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির, বীরত্ব আর বিশ্বাসঘাতকতার, অর্জন আর স্খলনের পরিসংখ্যান। ডিসেম্বরে ক্রোড়পত্রে ছেয়ে যায় গণমাধ্যম। টেলিভিশনে লাগাতার চলে রিচুয়াল, নানান কেচ্ছাকাহিনি। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী আর বাক্যবাগীশদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর তাত্ত্বিক আলোচনার আড়ালে চাপা পড়ে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হাহাকার, আর্তনাদ ও অশ্রুপাতের কথা।

একটি জাতির জীবনে ৫০ বছর অনেকটা সময়। আবার মহাকালের প্রেক্ষাপটে দেখলে এটি ক্ষণস্থায়ী একটি পর্ব মনে হয়। বাংলার দখল নিয়ে তুর্কি-মোগল-পাঠান-ইংরেজের লড়াই এখন ইতিহাস। ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪০ কিংবা ১৯৪৭-এর কথা আমরা বইয়ে পড়ি। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্ম একাত্তরের পর। তাঁরা যা শোনেন তা থেকেই একটা চিত্রকল্প মনে মনে ঠিক করে নেন। যেটুকু আবেগ এখনো আছে, একাত্তরের প্রজন্ম চোখের সামনে থেকে সরে গেলে আবেগের আবরণটাও সরে যাবে।

একাত্তরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম স্মরণ করবে কীভাবে? এ জন্য দরকার ওই সময়ের মানুষদের গল্পগুলো জানার, তাদের ন্যারেটিভ তৈরি করা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে কিংবা ওই সময়টি না দেখে খুব সহজেই একটি তাত্ত্বিক উপসংহার টেনে ফেলা যায়। এখানে ব্যক্তির ইচ্ছা, দৃষ্টিভঙ্গি আর পক্ষপাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে-আমি কী মনে করি কিংবা আমার মনে হয়, এ ধাঁচের কথাবার্তা। কারও কিছু মনে করার বা বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস তৈরি হয় না।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্ব^র পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাসের একটি পর্ব শেষ হয়েছে। আমরা প্রবেশ করেছি নতুন একটি পর্বে। এ সময়ের আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা চলছে, চলবে। হয়তো একদিন একটি প্রামাণ্য ইতিহাস তৈরি হবে। সেটা কখন হবে, বলা মুশকিল। এটি পরবর্তী প্রজন্মের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো, যারা ‘অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী না হইয়া’ একাত্তরের ব্যবচ্ছেদ করবে। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে তাদের জন্য উপাদান রেখে যেতে পারি। এখনই মুক্তিযুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া তৈরি করে ফেললে তা কত দিন টিকবে, বলা মুশকিল।

১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্ব^র বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে একটি জাতীয় দৈনিকের ক্রোড়পত্রে ‘এ বিজয় কার’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলাম। আজও এ প্রশ্নের উত্তর পাইনি। এ দিনটির কথা মনে রেখে বছর বিশেক আগে লিখেছিলাম :

দুশো ছেষট্টি দিনের যুদ্ধ, এটা ছিল

সমতটে প্রলম্বিত এক প্রসবের ক্ষণ

কালের আঁতুড়ে জন্ম নিতে এই দেশ।

অবরুদ্ধ ঢাকা উৎসবে জেগে ওঠে,

হাঁপ ছেড়ে শ্বাস নেয় ধাড়ি মধ্যবিত্ত

চতুর কলমবাজ নকল সিপাহি

সব ঝেড়ে নেমে পড়ে গোছাতে আখের।

যারা ঘরে ফেরে নাই তাদের নিঃশ্বাসে

বাতাস হয়েছে ভারী, সব কোলাহল

থেমে গেছে, গ্রামগুলো নীরব শ্মশান।

পাঁচ দশক পরও কেন জানি মনে হয়, আমাদের বিজয় ছিনতাই হয়ে গেছে।

লেখক : গবেষক।

সর্বশেষ খবর