মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নাকি মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নাকি মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ

পৃথিবীর ইতিহাস আর যুদ্ধের  ইতিহাস প্রায় সমান্তরাল। আদিকাল থেকেই যুদ্ধ হয়ে আসছে, এখনো হচ্ছে এবং কেউ পছন্দ করুক আর নাইবা করুক, ভবিষ্যতেও যুদ্ধ হবে। স্থান, কাল আর পাত্র ভেদে পাল্টেছে যুদ্ধের ধরন, প্রভাব এবং বিস্তৃতি। শুরুতে বনের হিংস্র পশুর বিরুদ্ধে মানুষ যুদ্ধ করত নিতান্ত বাঁচার জন্য। এরপর এলো ব্যক্তিগত শৌর্য বা শক্তি সামর্থ্য প্রমাণের মাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং সবার মাঝে প্রভাব বিস্তারের পালা। গোত্রে গোত্রেও যুদ্ধ হয়েছে যুগের পর যুগ। রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালুর পর একদিকে রাষ্ট্রের প্রভাব আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তারে যুদ্ধ হয়েছে রাজায় রাজায়। জমিদারি রক্ষা ও বিস্তারেও এ সময় যুদ্ধ হয়েছে। কখনো ধর্মকে উপজীব্য করে যুদ্ধ হয়েছে। এরপর আসে উপনিবেশ তথা বিশ্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই। মারণাস্ত্র তথা অস্ত্র ব্যবসায়ীরা যুদ্ধকে উসকে দেয় বলেও অনেকের বিশ্বাস। যুদ্ধের ফায়দা নিতে অনেক ব্যবসায়ীও সুযোগ খোঁজে। দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং দীর্ঘদিনের স্নায়ুযুদ্ধের পর অনেকেরই ধারণা ছিল হয়তো প্রাণঘাতী যুদ্ধের বদলে অর্থনৈতিক যুদ্ধই হতে চলেছে আজ ও আগামীর বাস্তবতা। বিশেষত বড় যুদ্ধ বা তথাকথিত অস্ত্র প্রতিযোগিতার প্রতি তেমন আগ্রহ ছাড়া চীন বা জাপানের উন্নতিও বিশ্বময় কর্তৃত্ব যুদ্ধের ভবিষ্যতের প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। তবে বাস্তবতা হলো তারপরও যুদ্ধ হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। আদিকালে যুদ্ধে ইতিহাস রচনা এবং যোদ্ধা বিশেষত যুদ্ধের বিজয়ী নেতৃত্বদানকারী সেনাপতি, রাজা-মহারাজাদের বীরত্বগাথা রচনার জন্য যুদ্ধ ময়দানে দেখা যেত কবি, লেখক ও ইতিহাসবিদদের এমনকি চিত্রকর বা শিল্পীর তুলির আঁচড়েও যুদ্ধের বর্ণনা ফুটে উঠত। পরবর্তীতে সংবাদের আবির্ভাব এবং সংবাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহের কারণে আলোচনার পাদপ্রান্তে উঠে আসে যুদ্ধ ও মিডিয়ার সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিষয়টি। মিডিয়া শত্রু-মিত্র উভয় শিবিরে একাধারে আশা, নিরাশা, হতাশা, উত্তেজনা, অনুপ্রেরণা এমনকি বিদ্রোহ উসকে দেয়। অন্যদিকে মিডিয়াকে যুদ্ধসংবাদ সংগ্রহে বাধা দিলে সঠিক তথ্যের বদলে অতিরঞ্জিত, বিকৃত, অর্ধসত্য এমনকি আজগুবি তথ্য বা গুজব ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছিল ১১টি সেক্টর বা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক মুক্তিযোদ্ধারা। তবে একথা অনস্বীকার্য যে সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা একটি সেক্টর সমযোদ্ধাদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। এই বেতার কেন্দ্রের উদ্দীপনামূলক সংবাদ, গান, নাট্যাংশ ও আবৃত্তি প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করেছে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের। বিশেষত এম আর আক্তার মুকুলের রচনা ও পরিবেশনায় রম্যকথিকা ‘চরমপত্র’ যে কোনো বোমা বা বুলেটের মতোই পরম শক্তিশালী ছিল। বোমা বা অস্ত্রের সরবরাহ যেভাবে যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি চরমপত্রও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক সাহস, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বর্তমানে তথ্য এবং বিকৃত তথ্যের অবাধ প্রবাহের কারণে অনেকেই আর মূলধারার তথাকথিত সংবাদ বা প্রচার মাধ্যম তথা রেডিও, টিভি কিংবা সংবাদপত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে চায় না। টেবিল বা কোলে থাকা কম্পিউটার কিংবা হাতের তালুতে থাকা একটি স্মার্টফোনই সারা বিশ্বের সঠিক, অর্ধসত্য, বিকৃত কিংবা অস্তিত্বহীন সংবাদ বা তথ্য পরিবেশনের জন্য যথেষ্ট। তাই প্রশ্ন উঠেছে, আজ ও আগামীদিনে কি মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে? না মিডিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা যায়।

একটি আফ্রিকান দেশে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত ছিল একদল সেনা। এসব অঞ্চলেও এমনিতেই ত্রাণ প্রত্যাশী অভাবী মানুষের সংখ্যা বেশি থাকে। তদুপরি বন্যা সে সংকট বাড়িয়ে দেয়। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল সেনারা। ত্রাণের সীমাবদ্ধতার বিপরীতে প্রচুর ত্রাণ প্রত্যাশী দেখে এক সাংবাদিক একদল সেনাসদস্যের কাছে জানতে চাইলেন সবাইকে দেওয়ার মতো ত্রাণ তাদের গাড়িতে আছে কিনা? সেই সেনা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল-না নেই। তারপর সাংবাদিক জানতে চাইলেন এই যে এত মানুষ ত্রাণ না পেয়ে ফিরে যাবে, এ বিষয়টি তাঁর কাছে খারাপ লাগছে কিনা? উত্তর এলো স্বাভাবিকভাবেই, খারাপ তো লাগছেই সবাইকে ত্রাণ দিতে পারলেই তো ভালো হতো। পরদিন সরকারবিরোধী সংবাদপত্রের শিরোনাম হলো- ‘বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণের তীব্র সংকট : সেনাসদস্যদের মাঝে অসন্তোষ।’

একটি আফ্রিকান দেশে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত ছিল একদল সেনা। এসব অঞ্চলেও এমনিতেই ত্রাণ প্রত্যাশী অভাবী মানুষের সংখ্যা বেশি থাকে। তদুপরি বন্যা সে সংকট বাড়িয়ে দেয়। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল সেনারা। ত্রাণের সীমাবদ্ধতার বিপরীতে প্রচুর ত্রাণ প্রত্যাশী দেখে এক সাংবাদিক একদল সেনাসদস্যের কাছে জানতে চাইলেন সবাইকে দেওয়ার মতো ত্রাণ তাদের গাড়িতে আছে কিনা? সেই সেনা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল-না নেই। তারপর সাংবাদিক জানতে চাইলেন এই যে এত মানুষ ত্রাণ না পেয়ে ফিরে যাবে, এ বিষয়টি তাঁর কাছে খারাপ লাগছে কিনা? উত্তর এলো স্বাভাবিকভাবেই, খারাপ তো লাগছেই সবাইকে ত্রাণ দিতে পারলেই তো ভালো হতো। পরদিন সরকারবিরোধী সংবাদপত্রের শিরোনাম হলো-‘বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণের তীব্র সংকট : সেনাসদস্যদের মাঝে অসন্তোষ।’ এরপর সেনাবাহিনীতে শুরু হলো তোলপাড়। সদর দফতর থেকে কড়া নির্দেশ গেল কোনো সেনাসদস্য যেন মিডিয়ার সঙ্গে কথা না বলে। যা বলার সদর দফতর থেকেই বলা হবে। পরদিন আরেকদল মিডিয়াকর্মী সেনাদের কাছে বন্যা ও ত্রাণ পরিস্থিতি জানতে চাইল। সদর দফতরের আদেশ স্মরণ করে সেনারা কোনো কিছু বললেন না। কেন তারা কিছু বলছেন না, এ বিষয়েও তারা মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকেন। পরদিন সরকারবিরোধী ট্যাবলয়েড পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হলো-‘কিছুই বলব না; কেন বলব না : সেটাও বলব না।’ বিষয়টি হালকা হলেও এটাই মিডিয়া ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্কের বাস্তবতা।

অনেক কারণেই মিডিয়াকে এড়িয়ে চলে সামরিক বাহিনী। বিশ্বের বহু দেশ তাদের প্রশিক্ষিত গোয়েন্দাদের সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সাংবাদিক পরিচয়ে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দেয় গুপ্তচর বৃত্তির জন্য। যুদ্ধের ভয়াবহতার সঠিক কিংবা বিকৃত বর্ণনা সেনাসদস্যদের পরিবার ও পরিজনকে উৎকণ্ঠায় ফেলে, যার প্রভাব পড়ে যুদ্ধরত সেনাদের মনোজগতে। কেবল পরিবারের চাপেই যুদ্ধে না যাওয়া কিংবা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ ছিল বহুক্ষেত্রে। বাণিজ্যলোভী সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়াকর্মীরা কেবল পত্রিকার কাটতি বা দর্শক সংখ্যা বাড়ার প্রতি লক্ষ্য রেখে সংবাদ খোঁজে, এমনকি সংবাদ তৈরি করে। ২০১১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন লাইবেরিয়ার মানবাধিকারকর্মী ও নারী শিশুদের অধিকার রক্ষায় ব্যাপক অবদান রাখা লেইমাহ গবওই। দীর্ঘদিন ধরে লাইবেরিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধের সময় শিশু ও নারীদের ধর্ষণের প্রতিবাদে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি ব্যাপক পরিচিতি পাওয়ার আগে এক অপরিচিত সংবাদকর্মী তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি নিজে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন কিনা। উত্তরে ‘না’ বলায় তাকে ত্যাগ করে তাৎক্ষণিকভাবে ওই সংবাদকর্মী ধর্ষিত নারীর খোঁজে ছোটে। বিষয়টি তাকে এবং তার মতো আরও অনেককে কাঁদিয়েছে। আমেরিকার সেনাবাহিনীর যানবাহন ও সরবরাহ শাখায় দাফতরিক কাজ করতেন জেসিকা ডাউন লাইঞ্চ নামের এক সুন্দরী মার্কিন সেনা। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ ইরাকে মার্কিন অভিযানের সময় একটি কনভয় বা গাড়িবহরে ইরাকিদের হামলার শিকার হয়। এই বহরের একটি গাড়িতে ছিলেন জেসিকা। একটি রকেট জেসিকাকে বহনকারী গাড়িটিকে আঘাত হানলে মারাত্মক আহত হন জেসিকা। এক পর্যায়ে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেন। অচেতন জেসিকাকে একটি ইরাকি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ইরাকি সৈন্যরা। তার সঙ্গে চিকিৎসাধীন ছিলেন আহত আরও কিছু মার্কিন সেনা। জেসিকাসহ সব মার্কিন সেনাকে উদ্ধারে ১ এপ্রিল ২০০৩ তারিখে রাতে ঝটিকা বা কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে একদল সেনা। জেসিকা এবং হাসপাতালের হিমঘরে থাকা মার্কিন সেনাবাহিনীর মৃত সদস্যদের লাশ নিয়ে ফিরে আসেন এই কমান্ডোরা। পরবর্তীতে মিডিয়ার মুখোমুখি হতেই তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন কিনা-এই প্রশ্নই তাকে বারবার করা হয়। তিনি বারবার বলেছেন যে, তিনি অচেতন ছিলেন। কিন্তু অর্বাচীন কিছু মিডিয়াকর্মীর সব উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ধর্ষণকে ঘিরে। এ পরিস্থিতি আজও পাল্টায়নি বলেই ধারণা করা যায়।

অন্যদিকে শত্রু, তৃতীয় শক্তি, পঞ্চম বাহিনী বা নিজ দেশের স্বার্থান্বেষী মানুষের দ্বারা রচিত ও বিস্তৃত গুজব, অপপ্রচার এবং হতাশাব্যঞ্জক প্রচারণার যোগ্য প্রতিষেধক দিতে পারে একমাত্র মিডিয়া। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন সিনেটর হিরাম জনসন বলেছিলেন, ‘যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন প্রথম প্রাণ হারায় সত্য (ট্রুথ)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন। তার মতে, “যুদ্ধকালে সত্য (সঠিক তথ্য) এতই মূল্যবান যে তাঁকে ‘মিথ্যা’ নামক দেহরক্ষী দিয়ে নিরাপদ রাখতে হয়।” এই উক্তির মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য যেন কোনো অবস্থায় ভুল মানুষের হাতে পড়ে বিকৃত না হয়, সেদিকে জোর দেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের সময় দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে হয় এমন বন্দুকের কার্তুজে শূকর ও গরুর চর্বি থাকার মিথ্যা খবরে উত্তেজিত হয়ে উঠে হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় পরিকল্পিতভাবে সংবাদ ছড়ানো হয় যে, জার্মান সৈন্যরা শত্রু ও মিত্রবাহিনীর প্রাণ হারানো সৈন্যদের দেহ থেকে সাবান ও মারজারিন (এক ধরনের মাখন) তৈরির জন্য চর্বি সংগ্রহ করেছে। এই সংবাদ জার্মানদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের আক্রোশও সৈন্যদের ক্ষিপ্রতা বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। হিটলারবিরোধীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিওতে সংবাদ প্রচার করে যে যুদ্ধাহত জার্মান সেনাদের শরীরে পরিকল্পিতভাবে জীবাণুযুক্ত রক্ত দেওয়া হচ্ছে। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে জার্মান শিবিরে।

মূলত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিডিয়া তেমন প্রাধান্য পায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সংবাদকর্মীদের নির্ভর করতে হয় যুদ্ধরত সেনাকমান্ডারদের দেওয়া তথ্য বা তাদের দেখানো পরিস্থিতির ওপর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ২০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে শুরু হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধ যা শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। মিডিয়া ও যুদ্ধের সম্পর্কে নতুন মেরুকরণ ঘটে এই ভিয়েতনাম যুদ্ধে। প্রথমদিকে ভিয়েতনামে যুদ্ধরত মার্কিন সেনারা মিডিয়াকে তেমন প্রাধান্য দেয়নি। ১৯৬৪ সালে সর্বসাকুল্যে ২০-২২ জন সংবাদিক যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ ও প্রেরণ করতেন। এরা সবাই অনেকাংশেই সেনা নিয়ন্ত্রিত সংবাদ প্রেরণে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু কিছু দুঃসাহসী সাংবাদিক নানা বেশে এবং নানা কায়দায় যুদ্ধ সংবাদ প্রকাশ শুরু করলে টনক নড়ে মার্কিন সেনা কর্তৃপক্ষের।

দ্রুতই ইউএস মিলিটারি অ্যাসিসটেন্স কমান্ড ভিয়েতনাম (সংক্ষেপে এমএসসিভি) নামক সেনাকমান্ড দ্রুতই এগিয়ে আসেন মিডিয়াকর্মীদের সহায়তায়। এমনকি নির্দিষ্ট যানবাহনও নির্ধারণ করা হয় তাদের জন্য। এতে ১৯৬৮ সালের মধ্যেই সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধিতকৃত মিডিয়াকর্মীর সংখ্যা ৬০০ অতিক্রম করে। নানা দেশ এবং নানা হাত ও ধর্মের এই ৬০০ মিডিয়াকর্মীর পাশাপাশি আরও বহু সংবাদকর্মীর পেশাদারিত্বে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্রুতই সংবাদ পৌঁছে যেত বিশ্ববাসীর ড্রইংরুমে। বিশেষত; টেলিভিশন ফুটেজ ভিয়েতনাম থেকে জাপান হয়ে আমেরিকায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ত মার্কিন জনগণ। একপর্যায়ে এসব সংবাদে ভিয়েতনামে মার্কিন সেনাদের অসারতা, ক্ষয়ক্ষতি এবং অযৌক্তিক অবস্থানই ধরা পড়ে মিডিয়ার চোখে। ফলে মার্কিন সেনাদের ভিয়েতনাম থেকে সরে যাওয়ার দাবি উঠে, যা পরে বাস্তবায়িত হয়। মিডিয়ার অন্ধ সমর্থন এবং মিডিয়ার কল্যাণে জনসমর্থন না পাওয়াকে মার্কিন সেনাদের ভিয়েতনাম যুদ্ধে হারার অন্যতম কারণ বলে গণ্য করা হয়। তখন প্রবাদের মতো চাউর হয় যে, মার্কিন সেনারা প্রথমে ওয়াশিংটনে হেরেছিল, পরে ভিয়েতনামে। এর নেপথ্যের কারণ মিডিয়ার সমর্থন না পাওয়া, যা পরবর্তীতে মার্কিন নীতিনির্ধারকগণও স্বীকার করেন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ১৯৯০-৯১ এর উপসাগরীয় যুদ্ধে মিডিয়াকে প্রথম থেকেই কব্জা করে ফেলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর সেনারা। এ সময় ট্যাঙ্ক, যুদ্ধকালীন জিপ, কামানবাহী ট্রাক, গোলাবারুদ, জ্বালানি ও রশদ বহনের লরি প্রভৃতিতে চড়ে যুদ্ধ ময়দানের সম্মুখ ভাগে গমন, অবস্থান এবং সেখান থেকে সরাসরি যুদ্ধ সংবাদ প্রেরণের চিত্র আগ্রহ ভরে দেখেছে বিশ্ববাসী। এমনকি জ্বলন্ত তেলের খনি, ডিপো বা শোধনাগারের সামনে এবং নিকট দূরত্বে আকাশ থেকে বোমা পড়া অবস্থায়ও উভয় পক্ষের নিক্ষিপ্ত মিসাইল আকাশে একে অপরকে আঘাত করা অবস্থায় সরাসরি বা লাইভ সম্প্রচার করার অদম্য ও বুনো সাহস প্রদর্শন করে মিডিয়াকর্মীরা। এমনি করেই নানা টিভি চ্যানেল বিশেষত মার্কিন টিভি চ্যানেল ‘সিএনএ’ তখন এত প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ‘সিএনএন ইফেক্ট’ নামের একটি কথাও তখন চালু হয়। বস্তুত, যে কোনো সমর অধিনায়ককে একটি যুদ্ধ পরিকল্পনার জন্য বা অভিযান শুরুর আগে বেশ কিছু বিষয়কে সামনে রেখে এগুতে হয়। রণকৌশলের পুঁথিগত ভাষায় এ বিষয়গুলোকে যুদ্ধের ‘নিয়ামক শক্তি’ বা ফ্যাক্টর বলে গণ্য করা হয়। এসব ফ্যাক্টরের মধ্যে নিজ ও শত্রুর অবস্থান এবং পরিস্থিতি, উদ্দেশ্য, ভূমি বা যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব অবস্থা, আবহাওয়া, দিন-রাতের ঘণ্টা, চাঁদের আলো, জোয়ার-ভাটা, সময়ের হিসাব, কাজের ধারাবাহিকতা, সম্ভাব্য কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়া এবং সংক্ষিপ্ত অপারেশন প্ল্যান অন্যতম। তবে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর মিডিয়াকেও যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের একটি নিয়ামক শক্তি বা ফ্যাক্টর বলে গণ্য করে এ যুগের সমরবিদগণ।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৬০ মিডিয়াকর্মীর প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটে। তথাপি প্রকৃত ঘটনা ও সত্য উদঘাটনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার ১০ গুণ বেশি (৬০০) সাংবাদিককর্মী ছুটেছেন ভিয়েতনামের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে আমেরিকার জনপ্রিয় টিভি ও রেডিও নেটওয়ার্ক সিবিএসের সংবাদ উপস্থাপক বিশেষত সান্ধ্যকালীর সংবাদের প্রাণপুরুষ ওয়ালটার ক্রোন কাইট, আমেরিকার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তির তকমা পেয়েছিলেন। তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, খোদ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট (১৯৬৩-৬৯) লিয়ন্ডন বেইনস জনসন বলতে বাধ্য হন যে, আমি যদি ক্রোন কাইটকে (সংবাদ উপস্থাপন) হারাই, তবে আমি মধ্য আমেরিকাকেই হারাবো। আমরা কি আমাদের দেশে একজন ওয়ালটার ক্রোন কাইট প্রত্যাশা করতে পারি না? মিডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে কী ঘটতে পারে, তারও উদাহরণ আছে ভিয়েতনাম যুদ্ধে। এই যুদ্ধের সময় দিন শেষে বিকাল ৫টায় সংবাদ সম্মেলন করে জয়েন্ট ইউএস পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিস মিডিয়াকর্মীদের বিভিন্ন তথ্য, উপাত্ত ও অর্জনের খবর সরবরাহ করত। তবে এ তথ্যের বাইরে প্রকৃত তথ্য মিডিয়াকর্মীরা এমনভাবে তুলে ধরত যে, সেই বিকাল ৫টার সংবাদ ব্রিফিং দি ফাইভ ও-ক্লক ফলিস অর্থাৎ ‘৫টার গাধামি’ নামে আখ্যায়িত হয়। ছলেবলে কৌশলে মিডিয়ার মুখ বন্ধ করা কি তবে গাধামির শামিল?

লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর