মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ প্রতিদিন ও এ যুগের সাংবাদিকতা

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

বাংলাদেশ প্রতিদিন ও এ যুগের সাংবাদিকতা

এ যুগের সাংবাদিকতার কথা বললেই তা যে অন্য যুগ বা অন্য সময় থেকে ভিন্ন সেটি সহজে অনুমেয়। এ ভিন্নতাকে বহুমাত্রিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন- এ যুগের সাংবাদিকতা বহুমাধ্যমকেন্দ্রিক সাংবাদিকতা একটি সতত পরিবর্তনশীল পেশা। অন্য যে কোনো পেশা থেকে সাংবাদিকতা সময় ও সমাজ বাস্তবতা দ্বারা নির্ধারিত হয় বেশি। সমাজকে যদি একটি সিস্টেম হিসেবে ধরা হয় তাহলে এর অন্তর্গত বহুবিধ সাব-সিস্টেম সদা পরস্পর মিথস্ক্রিয়ারত থাকে। এ সাব-সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রযুক্তি, সাংস্কৃতিক অবস্থা, পরিবার ব্যবস্থা, স্থানীয় ও বৈশ্বিক অবস্থার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, পরিবেশ, জলবায়ু ইত্যাদি। এসবের মধ্যে একটি বিশেষ সমাজ বাস্তবতায় সাংবাদিকতার চর্চা হয় প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে।

তাই এ যুগের সাংবাদিকতার কথা বললেই তা যে অন্য যুগ বা অন্য সময় থেকে ভিন্ন সেটি সহজে অনুমেয়। এ ভিন্নতাকে বহুমাত্রিক দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। যেমন- এ যুগের সাংবাদিকতা বহুমাধ্যমকেন্দ্রিক। সাংবাদিকতার এ বহুমাধ্যমকেন্দ্রিকতা হঠাৎ করেই উদ্ভাবিত হয়েছে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। মূলত কালের পরিক্রমায় উদ্ভাবিত সাংবাদিকতার বিভিন্ন কাঠামোকে ধারণ করেই আজকের সাংবাদিকতা বহুমাধ্যম বৈচিত্র্য অর্জন করেছে।

সাংবাদিকতার আদিরূপ এক মাধ্যমকেন্দ্রিক ছিল যাকে আমরা সাংবাদিকতার মুদ্রণ মাধ্যম যুগ বলতে পারি। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, পেমফ্লেট ইত্যাদিকে আমরা এ গোত্রভুক্ত করতে পারি। মুদ্রণ মাধ্যম সাংবাদিকতাকে আমরা প্রথমত দুই ভাগে দেখতে পারি। যেমন- হস্তলিখিত মুদ্রণ মাধ্যম ও প্রযুক্তিবাহিত মুদ্রণ মাধ্যম। প্রাচীন আমলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের রাজ-রাজড়া বিশেষ করে লেখক-নবিসদের মাধ্যমে হস্তলিখিত সংবাদপত্র প্রস্তুত করে তা রাজন্যবর্গকে বিতরণ করতেন। সাধারণ মানুষের জন্য সেগুলো রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টাঙিয়ে রাখা হতো। পনেরো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ ব্যবস্থায়ই কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে জার্মানির গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করলে সংবাদপত্র তা দ্রুত গ্রহণ করে এবং মুদ্রিত সংবাদপত্রের যুগ শুরু হয়। মুদ্রণ মাধ্যমের এ একক সাংবাদিকতার যুগকে আমরা মোটা দাগে তিন পর্বে বিভক্ত করে দেখতে পারি। শিল্পবিপ্লব পূর্বকাল, শিল্পবিপ্লব-উত্তর কাল ও বিশ্বায়ন কাল।

শিল্পবিপ্লব পূর্বকালে মুদ্রণ সাংবাদিকতা ছিল অনেকটা পারিবারিক পরিসরে। অনেকটা কটেজ ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এর তুলনা করা যায়। পরিবারের সদস্যরাই বিভিন্ন ভূমিকা পালন করতেন। যেমন- কেউ সম্পাদক, কেউ রিপোর্টার, কেউ আবার নিউজ ম্যানেজার। এ পর্বে সাংবাদিকতার ‘অডিয়েন্স’ তথা সংবাদের ‘পাঠক’ আজকের বিবেচনায় ‘বাজার’ ছিল সীমিত। অল্প সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ে স্থানীয় মানুষের তথ্য চাহিদা মেটানোই ছিল এ সময়ের সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য। শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপে কুটির শিল্পের সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে বৃহৎ শিল্পে রূপ লাভ করে। শিক্ষা ও পুঁজি বিকাশের ফলে বড় পাঠক সমাজ তৈরি হয়। শিল্পবিপ্লব পর্যায়ের সাংবাদিকতায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত সংবাদপত্র উৎপাদন ও পাশাপাশি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মিথস্ক্রিয়ায় সাংবাদিকতার বাজার সম্প্রসারিত হয়। মূলত বিংশ শতকে এসে সাংবাদিকতা বহুমাধ্যম বাহিত পেশায় রূপ লাভ করতে থাকে। রেডিও, টেলিভিশনের আবিষ্কার এবং সাংবাদিকতায় এ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় বহুমাধ্যম বা মাধ্যম বৈচিত্র্য যুগের সূচনা ঘটে।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠকগোষ্ঠী তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের যে সুযোগ পায় তাতে আমরা লক্ষ্য করি যে, বহু বৈচিত্র্যময় চিন্তা-চেতনার মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত যেমন অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, ঠিক তেমনি গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় ভিন্ন জনমতের প্রতিফলন ঘটবে এটাও স্বাভাবিক। একটি সংবাদ মাধ্যমের পথচলায় ১২ বছর খুব দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠাকালীন পর্বে প্রথম ১২ বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। ... পত্রিকাটি ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, এর বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনার পরিধি কতটা বিস্তৃত হবে, স্বাধীন মতপ্রকাশে পত্রিকাটি কতটুকু ঝুঁকি নেবে, সংবাদকর্মীরা কতটা নিবেদিত থাকবেন, মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক কতটা নিরপেক্ষভাবে পত্রিকাটি পরিচালনা করবেন এ বিষয়গুলো সম্বন্ধে পাঠককুল সম্যকধারণা লাভ করে এর সূচনা পর্বে।

এ পর্যায়ে এসে বিশ্বায়নের ফলে সাংবাদিকতার চিরায়িত স্থানীয় চরিত্রের পরিবর্তন শুরু হয়। ধীরে ধীরে সাংবাদিকতা একটি বৈশ্বিক রূপ লাভ করতে থাকে। বিশ্বায়নের লম্বা সময়ে সাংবাদিকতা সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনের ক্ষেত্রে বিশেষায়িতভাবেই চর্চিত হতে থাকে। একবিংশ শতকের গোড়া থেকে মূলত সাংবাদিকতা প্রাযুক্তিক প্রভাবে মাধ্যম বহুমাত্রিকতার পাশাপাশি চর্চায় বহুমাত্রিক রূপ পেতে থাকে। এ যুগের সাংবাদিকতায় যেসব চরিত্র পরিলক্ষিত হয় তার মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার ও বহু-আধেয়ভিত্তিক চর্চাই অন্যতম। এক সময় সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির ব্যবহার বলতে ছাপাখানা বা প্রিন্টিং প্রেসকে বোঝানো হতো। রেডিও, টেলিভিশনের ক্ষেত্রে স্টুডিও থেকে ট্রান্সমিশন কৌশলকে বোঝাত। কিন্তু এ যুগের সাংবাদিকতা প্রতিটি স্তরেই প্রযুক্তিনির্ভর।

মোটা দাগে সাংবাদিকতা প্রক্রিয়ার পাঁচটি পর্যায় রয়েছে। যেমন- ১। সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, ২। সংবাদপত্র বা সম্প্রচারের জন্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করা, ৩। সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনা, ৪। সংবাদ মুদ্রণ অথবা যোগাযোগ উপগ্রহ কিংবা অন্তর্জাল উপযোগীকরণ, ৫। নিউজ ডেলিভারির লক্ষ্যে বিতরণ/প্রচার/সম্প্রচার অথবা অন্তর্জালের সঞ্চালনা।

সব মাধ্যমের সাংবাদিকতা চর্চায়ই উল্লিখিত প্রতিটি পর্যায়ে প্রযুক্তি আজ অপরিহার্য নিয়ামক। সমাজে যারা প্রবীণ তারা যৌবনে দেখেছেন সংবাদকর্মীরা প্রতিবেদনের ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহের জন্য এ অফিসে, সে অফিসে যাতায়াতে বহু সময় ব্যয় করছেন। উপরন্তু প্রাপ্ত তথ্য তাদের হাতে লিখে নিতে হতো। সেজন্য বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকরা সাঁটলিপি ব্যবহার করতেন। কিন্তু এ যুগের সাংবাদিকতায় তথ্য সংগ্রহের সেকেলে অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক প্রতিবেদনের ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটেরিয়াল এখন ঘরে বসে ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। তাড়াহুড়া করে হাতে লিখে নোট নেওয়ার পরিবর্তে তথ্য রেকর্ড করার বিভিন্ন ডিভাইস এখন সহজলভ্য। এসবের ব্যবহার জানা ছাড়া এখন সাংবাদিকতার চিন্তাই করা যায় না। এমনকি স্মার্টফোনভিত্তিক কনভারজেন্স টেকনোলজির ফলে এখন উন্নত, অনুন্নত সব দেশেই গড়লড় বা ‘মোবাইল জার্নালিজম’ সাংবাদিকতার প্রযুক্তিনির্ভর সাংবাদিকতার স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।

সংবাদ প্রতিবেদন সম্পাদনায় বেশ পরিবর্তন এসেছে। হার্ড কপির ওপর সম্পাদনার যুগ আর এখন নেই। ইলেকট্রনিক সাবিং ও এডিটিং অনেক আগেই উন্নত বিশ্বে শুরু হয়েছে। ২০০০-এর পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশেও সংবাদ সম্পাদনায় আগের সেই অশ্ব-খুরাকৃতির টেবিলের পরিবর্তন ঘটে গেছে। নিজ নিজ ডেস্কে বসে সহসম্পাদকরা এখন ল্যানযুক্ত কম্পিউটার টার্মিনালে থেকে ইলেকট্রনিক সাবিং ও এডিটিংয়ের কাজ করছেন।

প্রিন্টিং প্রযুক্তির পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে ইন্টারনেট বা অন্তর্জাল সুবিধার আওতায় সংবাদপত্র মুদ্রণে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। প্রযুক্তিগত সুবিধার কারণেই বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা আজকাল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মুদ্রিত হয়ে স্থানীয় পাঠকের কাছে দ্রুত পৌঁছে যায়। আমরা জানি, নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম সাময়িকীসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রিন্ট মাধ্যম স্থানীয়ভাবে মুদ্রিত হয়, যা অতীতে কল্পনাও করা যেত না। বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা থেকে প্রকাশিত অনেক সংবাদপত্রই ঢাকা থেকে মুদ্রিত হয়ে স্থানীয় বাজারে প্রবেশ করে। এসবই সম্ভব হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি তথা অযুত-নিযুত ডাটা বাহনে ও প্রকৃত সময় সঞ্চালনা বা রিয়েল টাইম ট্রান্সমিশনে সক্ষম অন্তর্জাল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে।

নিউজ ডেলিভারিও আমূলভাবে বদলে গেছে। রেডিও, টেলিভিশন নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংবাদ পরিবেশনের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার রিয়েল টাইম কাভারেজ দিচ্ছে। ঘটনার সংবাদভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছে। প্রযুক্তিকেন্দ্রিক অনলাইন সাংবাদিকতা স্বতন্ত্র সাংবাদিকতা ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলাদেশে অসংখ্য নিউজ পোর্টাল রয়েছে। দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিকতা এখন আর ২৪ ঘণ্টার টাইম ফ্রেমে বন্দী নেই। সংবাদপত্রসহ সব গণমাধ্যমেরই এখন নিউজ ওয়েবসাইট রয়েছে। যেখানে প্রতিটি ঘটনার তাৎক্ষণিক আপডেট পাওয়া যাচ্ছে। এভাবেই এ যুগের সাংবাদিকতা পূর্বকাল থেকে নবতর রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময়ে সাংবাদিকতা মূলত বহুমাধ্যম বাহিত সমকেন্দ্রমুখী (পড়হাবৎমবহপব) প্রযুক্তিনির্ভর একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা।

গণতান্ত্রিক বিশ্বে ‘নিউজপেপার অব রেকর্ড’ বলে একটি কথা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা ১৯১৩ সালে এই অভিধায় অভিহিত হয়েছে। বিশ্ব বাস্তবতায় এ পত্রিকাটি এখন ‘নিউজপেপার অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমার প্রত্যাশা বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি বাংলাদেশে ‘নিউজপেপার অব রেকর্ড’ হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করবে। বাঙালি পাঠকদের উদ্দেশে আমার বক্তব্য থাকবে বাংলাদেশ প্রতিদিন আমাদের অবশ্য পাঠ্য, পৃথিবীর যে প্রান্তেই আমরা থাকি না কেন। সব জনমত সমগুরুত্ব দিয়ে প্রত্যক্ষ যুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিদিন যেভাবে সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয় তাতে এ আশা আমরা করতেই পারি।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাঠকগোষ্ঠী তাদের স্বাধীন মতামত প্রকাশের যে সুযোগ পায় তাতে আমরা লক্ষ্য করি যে, বহু বৈচিত্র্যময় চিন্তা-চেতনার মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে ভিন্নমত যেমন অতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, ঠিক তেমনি গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় ভিন্ন জনমতের প্রতিফলন ঘটবে এটাও স্বাভাবিক। একটি সংবাদ মাধ্যমের পথচলায় ১২ বছর খুব দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠাকালীন পর্বে প্রথম ১২ বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। কারণ পত্রিকাটির ভিত রচিত হচ্ছে এ সময়েই। পত্রিকাটি ভবিষ্যতে কী রূপ নেবে, এর বৈচিত্র্যময় উপস্থাপনার পরিধি কতটা বিস্তৃত হবে, স্বাধীন মতপ্রকাশে পত্রিকাটি কতটুকু ঝুঁকি নেবে, সংবাদকর্মীরা কতটা নিবেদিত থাকবেন, মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক কতটা নিরপেক্ষভাবে পত্রিকাটি পরিচালনা করবেন এ বিষয়গুলো সম্ব^ন্ধে পাঠককুল সম্যকধারণা লাভ করে এর সূচনা পর্বে।

একটি সংবাদমাধ্যমের অনন্তকালের যাত্রাপথে এ বিশ্বাসযোগ্যতাকে ভিত্তি ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাসযোগ্যতা কোনো বিমুক্ত বস্তু নয়। বিশ্বাসযোগ্যতায় অন্তর্ভুক্ত আছে সম্পাদক-প্রকাশকের বিশ্বাসযোগ্যতা, কর্মরত সাংবাদিকদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সর্বোপরি উপস্থাপিত প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও অন্যান্য ‘কনটেন্টে’র এমনকি বিজ্ঞাপনের বস্তুনিষ্ঠতা ও যথার্থতা। এ কারণেই প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম তা সম্প্রচার বা মুদ্রণ মাধ্যম যাই হোক না কেন তাদের পরিচালনায় নিয়োজিত প্রত্যেক পেশাজীবীকেই বস্তুনিষ্ঠতার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে কাজ করতে হয়। মুহূর্তের অসাবধানতার কারণে কখনো কখনো বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধস নামার আশঙ্কা থাকে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ প্রতিদিন সে পরীক্ষায়ও সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে বলে মনে করি। গণজীবনকে কলুষমুক্ত করা, জনরুচির উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটানো ও সমাজে মানবতাবোধের প্রতিষ্ঠা করাও সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দেশের প্রথিতযশা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে শোকাহত হয়ে ১৯৬৯ সালের ৯ জুন তারিখে স্মৃতিচারণমূলক যে নিবন্ধ দৈনিক ইত্তেফাকে লিখেছিলেন, তাতে বলেছিলেন- ‘অহংকারের বাহুল্য চমকতার বিষয়বস্তু কোনো দিন আবৃত করতে পারেনি। জনগণের কথা বলার জন্য মানিক মিয়া লেখনী হাতে নিয়েছেন। জনগণের ভাষায় তিনি কথা বলতেন, তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল গণমুখী। তিনি নিজে সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন সাংবাদিক ভাষা। কঠিন তাত্ত্বিক আলোচনার মাঝে রসালো গ্রামীণ গল্প ও সর্বজন পরিচিত কাহিনি সংযোগ করে তিনি তাঁর রচনাগুলোতে প্রাণসঞ্চার করতেন। শব্দ সংগ্রহ ও প্রয়োগে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক ও সিদ্ধহস্ত। তাঁর ব্যবহৃত শব্দগুলো অনেক সময় নিজস্ব আভিধানিক অর্থ ছড়িয়ে নতুন অর্থ ব্যক্ত করত। তিনি ছিলেন উঁচু দরের গাল্পিক।’ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সেই সময়ে ইত্তেফাকের সম্পাদকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু যে কথাগুলো বলেছিলেন তাতে আজকের দিনে সব সংবাদপত্রের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও প্রত্যক্ষভাবে ছাত্রজীবন থেকে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও বন্ধুরা সেই সময় প্রথিতযশা সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিক মহলে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা, ঘনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা আমাদের সব সময় অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু সর্বদাই গণমানুষের সঙ্গে গণমাধ্যমের সক্রিয় সংযোগে প্রভূত ভূমিকা রেখেছেন এবং সেখানে ছিল বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব ও বিশ্বস্ততা।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই শুভক্ষণে আমরা আশা করব বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ও গণমানুষের সার্বিক ক্ষমতায়নে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে ১৬ কোটি মানুষের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ প্রতিদিন। ভারত উপমহাদেশে আনুমানিক ২৫০ বছরের সংবাদপত্র সংস্কৃতিতে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনন্তকালের যাত্রাপথে ব্যতিক্রমী অধ্যায় রচনা করবে-এই বিশ্বাস আমাদের আছে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা।

সর্বশেষ খবর