শিরোনাম
মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর কৃষিবিপ্লবের পাঁচ দশক

ড. আতিউর রহমান

বঙ্গবন্ধুর কৃষিবিপ্লবের পাঁচ দশক

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের কৃষির অভাবনীয় রূপান্তর ঘটেছে। যদিও চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কভিড-১৯ সংকটের কারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই, বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানি আমদানিকারী দেশসমূহে খাদ্যমূল্য বাড়ন্ত এবং খুবই অস্থিতিশীল, তবুও বাংলাদেশের খাদ্য মজুদ যথেষ্ট আছে বলে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। তবে ভোজ্যতেল, গম, সারের দামের ওপর এ যুদ্ধের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এ তিনটি পণ্যই আমরা ইউক্রেন, বেলারুশ এবং রাশিয়া থেকে ব্যাপক হারে আমদানি করি। বর্তমানে মজুদ থাকলেও আগামী দিনের সরবরাহ চেইনে এ যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব যে পড়তে পারে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আশা করছি আত্মঘাতী এ যুদ্ধের সমাপ্তি টানবে রাশিয়া। কেননা রাশিয়ার অর্থনীতিও ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে বিধিনিষেধের আওতায় পড়ে গেছে। তাদের অর্থনীতিও টালমাটাল। সেদেশেও মানুষের আয়-রোজগারে বড় সংকট দেখা দিয়েছে। কভিড সংকটে বেশ খানিকটা ভাটা পড়েছে। এ সময়টায় সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত। মূল্যস্ফীতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর ঠিক এ সময়টায় এই যুদ্ধ আসলেই মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন বাড়ছে, নিম্ন আয়ের মানুষের হাপিত্যেশে আকাশ ভারি হয়ে উঠছে। তবে সরকার এক কোটি এমন মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। পুরোটা কভিডকালেই এরকম সামাজিক নিরাপত্তা সমর্থন দিতে সরকার যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান হারিয়ে অনেকেই গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। গ্রাম তাদের নিরাশ করেনি। স্থিতিশীল খাদ্যমূল্য এবং অকৃষি খাতে আয়-রোজগারের সুযোগ থাকায় এসব মানুষ ঠিকই বেঁচে বর্তে ছিলেন। শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ ফের বাড়ছে। তারা তাই গ্রাম ছেড়ে শহরে ফিরছে। আবার তারা গ্রামে মোবাইলে অর্থ পাঠাতে শুরু করেছে।

এসব কিছুই সম্ভব হচ্ছে গত ৫০ বছরে বদলে যাওয়া গ্রাম-বাংলার রূপান্তরের ফলে। আর এ রূপান্তরের বড় নায়ক আমাদেরই গতিময় কৃষি খাত। কৃষির এ সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় শক্তি জুগিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেই ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে তিনি নিজেকে সঁপে দেন। তখন তিনি তরুণ রাজনৈতিক নেতা। সারা বাংলাদেশ ঘুরে ঘুরে মুসলিম লীগের বিকল্প একটি গণমুখী দলের ভিত্তি স্থাপনে ব্যস্ত। এ সময়েই ‘দাওয়াল’ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সরকারের কর্ডন প্রথার কারণে এ কৃষি শ্রমিকরা তাঁদের নিজ জেলায় প্রাপ্য খাদ্য নিতে পারছিলেন না। তাই তাদের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলে কৃষির উন্নয়নে বন্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব নিয়ে তিনি কথা বলতে শুরু করেন। খাদ্য নিরাপত্তার দাবিও করেছেন। চুয়ান্নর নির্বাচনী প্রচারে তিনি কৃষকদের এসব স্বার্থের কথা জোরেশোরে বলতেন বলেই বিপুলভাবে তাঁর দল এবং যুক্তফ্রন্ট বিপুলভাবে বিজয়ী হয়েছিল। তাই যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্বল্পস্থায়ী কৃষি ও সমবায়মন্ত্রী হিসেবে সমবায় অধিদফতরের পক্ষে বিশেষ বরাদ্দ দেন এবং কৃষকদের স্বার্থে কাজ করার নানা উদ্যোগ নেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৬ সালে শিল্প, বাণিজ্য ও দুর্নীতি দমন মন্ত্রী হিসেবেও বাঙালি উদ্যোক্তাদের জন্য নানা নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাট ও কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসারে মনোযোগী হন। এ ছাড়া ১৯৫৫ সাল থেকে পাকিস্তান গণপরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে কৃষকদের দুরবস্থা নিয়ে দিনের পর দিন কথা বলেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগের জন্য দাবি তোলেন। পাশাপাশি চা বোর্ডের সভাপতি হিসেবেও বঙ্গবন্ধু চা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক এবং উদ্যোক্তাদের স্বার্থে নানমুখী উদ্যোগ নেন।

১৯৫২ সালে তিনি শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য চীনে গিয়েছিলেন। সম্মেলন শেষ করে আরও বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি কৃষি সংস্কার এবং সংগঠিত কৃষকদের কর্ম তৎপরতা নিজের চোখে দেখার জন্য বিভিন্ন কৃষি ফার্ম পরিদর্শন করেন। পরবর্তী সময়ে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ে তিনি যেসব আন্দোলন করেছেন, (যার মধ্যে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল অন্যতম) সেসবের দাবি-দাওয়ার মধ্যেও কৃষক মুক্তির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে যুক্ত করেছেন। এসব দাবি-দাওয়ার নির্যাস ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগ দিয়ে তাঁর নির্বাচনী রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে বিস্তারিতভাবে ওঠে এসেছে। ১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবরে দেওয়া তাঁর ভাষণে একদিকে সামন্ত ভূস্বামীদের বিলাসী জীবন এবং অন্যদিকে পরিশ্রমী কৃষকদের জীবনচলার সংগ্রামের কথা তিনি তুলে ধরেন। আরও সুস্পষ্ট করে প্রস্তাব করেন যে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হবে, জমির মালিকানায় ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হবে, প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য গ্রামে গ্রামে সমবায় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে এবং কৃষির উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তিসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ বিনা অথবা সাশ্রয়ী মূল্যে প্রদান করা হবে। তিনি কৃষি বলতে শুধু ফসল চাষবাসের কথা বলতেন না। তাঁর কৃষিতে গবাদিপশু, মুরগি, মাছ এবং বনজসম্পদও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বঙ্গবন্ধু কৃষিতে সবুজ বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সফরে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি তাঁর প্রস্তাবিত সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করার জন্য উপযুক্ত কৃষি শিক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জনসম্পদ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষি স্নাতকদের প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি দেবার অঙ্গীকারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন কৃষি ছাত্ররা যেন ফুল প্যান্ট ছেড়ে হাফ প্যান্ট পরে গ্রামে গিয়ে তাদের বাবা বা ভাইদের পাশে থেকে কৃষির আধুনিকায়নে অবদান রাখে। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি দেশ পরিচালনা করেছেন। এই সময়ে কৃষির আধুনিকায়নে কত কিছুই না করে গেছেন। প্রথম বছরেই তিনি বিনামূল্যে অথবা সাশ্রয়ী মূল্যে ১৭,০০০ টন উন্নত বীজ কৃষকদের সরবরাহ করেন। ১০ লাখ কৃষকের সার্টিফিকেট মামলা তুলে নেন।

আর তাই তো ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেই তিনি বলেছিলেন, “এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি সকলের খাদ্য নিশ্চয়তা না দিতে পারি।” আর এই বাক্যের মাঝেই কৃষির উন্নতির কথা সুস্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। একই বছর ৯ মে রাজশাহী মাদরাসা ময়দানেও তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। ‘মানুষ পেট ভরে ভাত খাক’- এ কথাটি তাঁর হৃদয়ের গহিনতম তলদেশ থেকে তিনি সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, ১০০ বিঘার বেশি জমির মালিকানা কারও থাকবে না। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা নেওয়া হবে না। তিনি দেশ গড়ার শুরুর দিনগুলোতে কৃষির ওপর এতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত: কৃষি আপামর জনসাধারণকে আহার জোগাবে। দ্বিতীয়ত: দেশের বেশিরভাগ মানুষের কর্মসংস্থান দেবে। তৃতীয়ত: শিল্পের কাঁচামাল ও চাহিদা জোগাবে কৃষি। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কৃষির এ গুরুত্ব বুঝানোর জন্য মোট বিনিয়োগ বরাদ্দের ২৪% রেখেছিলেন এ খাতের জন্য।

বঙ্গবন্ধু কৃষিতে সবুজ বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সফরে গিয়েছিলেন। সেদিন তিনি তাঁর প্রস্তাবিত সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করার জন্য উপযুক্ত কৃষিশিক্ষার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জনসম্পদ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষি স্নাতকদের প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি দেওয়ার অঙ্গীকারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কৃষি-ছাত্ররা যেন ফুলপ্যান্ট ছেড়ে হাফপ্যান্ট পরে গ্রামে গিয়ে তাদের বাবা বা ভাইদের পাশে থেকে কৃষির আধুনিকায়নে অবদান রাখে। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি দেশ পরিচালনা করেছেন। এ সময়ে কৃষির আধুনিকায়নে কত কিছুই না করে গেছেন। প্রথম বছরেই তিনি বিনামূল্যে অথবা সাশ্রয়ী মূল্যে ১৭ হাজার টন উন্নত বীজ কৃষকদের সরবরাহ করেন। ১০ লাখ কৃষকের সার্টিফিকেট মামলা তুলে নেন। সাড়ে তিন বছরে তিনি ৪০ হাজার লো-লিফট পাম্প, দুই হাজার ৯০০ ডিপ টিউবওয়েল এবং তিন হাজার শ্যালো টিউবওয়েল সরবরাহ করেন কৃষকদের মাঝে। কৃষকদের জন্য ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার ব্যবস্থা করেন। অনেকগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প হাতে নেন। তিনি রাষ্ট্রকে গ্রামীণ মানুষের স্বনির্ভর করার সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখতে আগ্রহী ছিলেন। তাই ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্র কৃষককে ঋণ, উপকরণ এবং সেচের ব্যবস্থা করে দেবে। কৃষকদের আধুনিক চাষের জন্য সমবায় ব্যবস্থায় শরিক হওয়ার জন্য তিনি সেদিন জোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের অংশ হিসেবেই তিনি এসব কথা বলেছিলেন। তারও কয়েক দিন পরে (২১ জুলাই, ১৯৭৫) তিনি নবনিযুক্ত জেলা গভর্নরদের জনগণকে সংগঠিত করতে বলেছিলেন। তারা যদি সেচ পাম্প জোগাড় করতে পারেন, তাহলে ভালো। না পারলে ছোট ছোট বাঁধ গড়ে তুলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। পানির দেশে সেচের কেন অসুবিধা হবে- সে প্রশ্ন তিনি সেদিন রেখেছিলেন।

অন্তর্র্ভুক্তিমূলক সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিন ‘মানুষের স্বপ্ন খুন হয়েছিল/স্বপ্নের লাশ পড়েছিল উদোম আকাশের নিচে।” (বাবলু জোয়ারদার)। যে পর্যায়ে মাথাপিছু আয় (২৭৩ ডলার যা ছিল ৯৩ ডলার) বাহাত্তরে রেখে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাতে ফের পৌঁছুতে ১৩ বছর লেগেছিল বাংলাদেশের।

বঙ্গবন্ধুর কৃষিচিন্তা আর তাঁর দেখানো পথেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত নীতি সমর্থনের ফলে আজ বাংলাদেশের কৃষি এক নয়া উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। আমরা দেখেছি গভীর করোনা সংকটকালে কৃষি হতে পেরেছে আমাদের রক্ষাকবচ। আমরা স্বাধীনতার পর পরই এক মেট্রিক টনের মতো খাদ্য উৎপাদন করতাম। আজ তা প্রায় চার লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। চাল উৎপাদনে আমরা এখন বিশ্বে তৃতীয়, মাছ ও সবজিতেও তৃতীয় এবং আমে সপ্তম। ধান চাষে প্রায় শতভাগ যান্ত্রিকীকরণ ঘটে গেছে। সেচে সোলার বিদ্যুৎ ব্যবহারে নয়া উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। কৃষি বিজ্ঞানীরাও অসাধ্য সাধন করে যাচ্ছে। তারা ১০৯টি জলবায়ু সহায়ক বীজ উদ্ভাবন করে লবণাক্ত উপকূলে কৃষকদের কৃষি উৎপাদনে নতুন করে আশার বীজ বুনেছেন। সম্প্রতি ছত্রাকমুক্ত আলু চাষেও নয়া বীজ উদ্ভাবনে তারা তাদের উদ্ভাবনী শক্তির প্রমাণ রেখেছেন। এ আলুর চাহিদা বেশি। বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি বার্ক, বিরি, ব্রি, বিনা, এফআরআইসহ নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশের কৃষির রূপান্তরে অবিস্মরণীয় সব কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের কৃষি স্নাতকেরাও কৃষি সম্প্রসারণের পক্ষে গ্রামে গ্রামে আধুনিক কৃষির বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং কৃষি-সম্পর্কিত নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে আমার এ প্রত্যয় জন্মেছে যে বাংলাদেশের বিদ্বান ও বিজ্ঞানীরা কৃষির সমৃদ্ধির পেছনে বিরাট অবদান রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার জুরি বোর্ডের আমি একজন সদস্য। এ যাবৎ যারা বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক পেয়েছেন এবং যারা শর্ট লিস্টেড হয়েছিলেন তাদের সবাইকে তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত করে আরও মর্যাদা, নীতি সহায়ক ও ঋণ সমর্থন দিতে পারলে নিশ্চই তারা কৃষির রূপান্তরে ‘চেঞ্জ এজেন্ট’ হিসেবে অভাবনীয় অবদান রাখার সক্ষমতা রাখেন।

প্রধানমন্ত্রী বরাবরই কৃষকদের কল্যাণে নিবেদিত। এ করোনাকালে তিনি ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা তাদের দিয়েছেন। গ্রামের ৫০ লাখ পরিবারকে (যাদের বেশির ভাগই কৃষক) নগদ সহায়তা দিয়েছেন। ২০ হাজার কোটি টাকার সস্তায় ঋণ ক্ষুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ করেছেন। এদের বিরাট অংশ কৃষি ও গ্রামীণ উদ্যোক্তা। তা ছাড়া, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও ঘূর্ণায়মান কম সুদের পুঁজি সরবরাহের ব্যবস্থাও এ প্রণোদনা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও ব্যাংকের সক্ষমতা ও সদিচ্ছার ঘাটতির কারণে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি খানিকটা শ্লথ হতে দেখা গেছে, তবুও এ কথা মানতেই হবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এসব কিছুই নিয়মিত মনিটর করে যাচ্ছে।

ভোক্তা পর্যায়ে নিঃসন্দেহে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদকরা সর্বদাই খুব ভালো দাম পাচ্ছেন সে কথাও বলা যাবে না। এ অসংগতির কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। তবে আসার কথা, যে ভোগ আমাদের প্রবৃদ্ধির ৬৩% জোগানদাতা তার বৈষম্য আয় বৈষম্যের চেয়ে অনেকটাই কম। বেশিরভাগ মানুষই এখন খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন। ঋতুভিত্তিক দারিদ্র্য বা উত্তরবঙ্গের ‘মঙ্গা’ আজ ইতিহাসের বিষয়। কৃষির অর্থায়নে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নয়া কৃষি ঋণ নীতিমালা সেই ২০০৯ সালেই চালু করেছে। এমনকি বিদেশি ও স্বদেশি ব্যক্তি খাতের ব্যাংকও এখন কৃষি ঋণ দিচ্ছে। এমএফআই-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেও তারা কৃষি ঋণ দিচ্ছে। তাই ১৯৮২ সালে যেখানে ৬৭৮ কোটি টাকা কৃষি ঋণ দেওয়া হতো, ২০২০ সালে তা ২৪ হাজার ৫০০ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। এমএসএমই খাতে ক্ষুদ্র ঋণ ও ব্যাংক ঋণের গতি বাড়ায় নয়া কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। মোবাইল ব্যাংক ও এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমেও কৃষকরা ঋণ পেতে শুরু করেছেন। মোবাইল ব্যাংক ও ব্যাংক মিলে যে ডিজিটাল ন্যানো ঋণ শুরু করা হয়েছে তার সুফল যেন গ্রামের উদ্যোক্তা ও কৃষকরাও পান সেদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও নজর রাখতে হবে। নিমিষেই ঋণ পাওয়ার এ সুযোগটি কৃষকের পাওয়ার পূর্ণ অধিকার আছে বলে আমি মনে করি।

কৃষিমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, এখন সময় এসেছে কৃষকদের দেশি এবং রপ্তানি বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ার। তাদের প্রয়োজনে গ্রুপে গ্রুপে নয়া বাজার ব্যবস্থায় ডিজিটালি যুক্ত নিশ্চয় করা সম্ভব। তিনি আরও বলেছেন, উচ্চমূল্যের নন-ট্র্যাডিশনাল কৃষিপণ্য উৎপাদনে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া উচিত। এজন্য এনজিও ব্যক্তি খাতের সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়তেও সরকার প্রস্তুত রয়েছে বলে তিনি সম্প্রতি এক লেখায় জানিয়েছেন। এসবই আধুনিক কৃষির জন্য সুখবর। সরকার, বিজ্ঞানী এবং ব্যক্তি খাত মিলেই তো গত ৫০ বছরে কৃষিতে অসাধ্য সাধন করেছেন। প্রখ্যাত কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবদুস সাত্তার ম ল সম্প্রতি জানিয়েছেন, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল নাগাদ মাথাপিছু আবাদি জমি ২৮ ডেসিমেল থেকে কমে ১০ ডেসিমেলে নেমে এসেছে। অথচ এ সময়ে মাথাপিছু চালের উৎপাদন ১৪০ থেকে বেড়ে ২৪০ কেজি হয়েছে। মাছ ১১ কেজি থেকে ২৫ কেজিতে উঠেছে। মাংস তিন কেজি থেকে ৪৪ কেজিতে উঠে গেছে। ডিম ১৫টি থেকে ১০১টিতে উন্নীত হয়েছে। দুধ ছয় কেজি থেকে ৫৮ কেজিতে উঠে গেছে। এসবই সম্ভব হয়েছে আমাদের দেশজ সমাধান বা ‘হোমগ্রোন সলিউশন’-এর মাধ্যমেই। সহায়ক সরকারি নীতি, মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মীদের কাজ, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনীমূলক ব্যক্তিখাতের অবদানেই কৃষি উৎপাদনে সাফল্য এসেছে। আমাদের এ অর্জন এখন বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে আফ্রিকা ও এশিয়ার নানা দেশে পৌঁছে গেছে। গত বছর নভেম্বরে ‘প্যারিস পিস ফোরাম’-এ  এক সংলাপে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা এ সাফল্যের কথা শেয়ার করেছেন।

এ বাস্তবতায় আমরা সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই কৃষির সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ বাস্তবেও দেখতে চাই। সেজন্য আগামী দিনগুলোতে করণীয় হিসেবে নিচের বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে :

এক. আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। তাই জমির সাশ্রয়ী ও টেকসই ব্যবহার অপরিহার্য।

দুই. ঊর্ধ্বমুখী কৃষিসহ জলবায়ুবান্ধব আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর (ইন্টারনেট অব থিংস, গ্রিনহাউস ফার্মিং, মাল্টি-স্টোরিড ক্যাটল ফার্মিং, ছাদকৃষি ইত্যাদি) কৃষির দিকে ঝুঁকতে হবে।

তিন. নয়া কৃষির জন্য নয়া উপকরণ (যেমন- গরুর খাবারের ঘাস) উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে।

চার. ফরওয়ার্ড লিংকেজের অংশ হিসেবে কৃষিকে বর্তমানে আমদানিনির্ভর খাদ্যশিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে।

পাঁচ. গতিময় ও কৃষকবান্ধব আধুনিক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে (শিক্ষিতি তরুণরা ই-কমার্স হিসেবে কৃষকদের নগরের ভোক্তাদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারেন)।

ছয়. কৃষিপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য মনিটরিং এবং সাপ্লাই-চেইন মসৃণ রাখার মতো নীতি সহায়তা ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

সাত. ডিজিটাল ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সেন্টারগুলো ব্যবহার করে কৃষি সংবাদ সংগ্রহ এবং ইলেক্ট্রনিক বাজার কাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে।

আট. কৃষি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ আরও বাড়াতে হবে। যান্ত্রিকীকরণের গতি আরও বাড়াতে হবে।

নয়. শিক্ষিত তরুণদের কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রচলিত নীতি সহায়তার (যেমন স্টার্ট-আপ তহবিল, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ) একটি বিশেষ অংশ তাদের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত হবে।

দশ. গবাদি ও মাছ চাষে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কৃষি গবেষণায় ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ‘ক্রস-সাবসিডিয়ারি’র সুযোগও সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় হবে।

এগার. সারা দেশে উন্নত জাতের গবাদিপশুর উৎপাদন বেড়েছে। এখন গ্রাম পর্যায়ে জৈবসার উৎপাদনে নয়া উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ বেড়েছে। এদের জন্য অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা কাম্য।

বারো. সবজি সংরক্ষণের চ্যালেঞ্জ এখনো তীব্র। পরিবহনের খরচও বেশি। তাই গ্রাম পর্যায়ে ছোট আকারের ‘কোল্ড স্টোরেজ’ এবং সস্তায় রেল পরিবহনের সুযোগ বৃদ্ধির দিকে নজর কাম্য।

তের. কৃষিকে জলবায়ুবান্ধব করার জন্য কৃষিশিক্ষা, গবেষণা, উদ্যোক্তা তৈরি এবং বাজার উন্নয়নের বিষয়ে আরও নীতি মনোযোগ প্রত্যাশিত।

চৌদ্দ. কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাণিসম্পদ, খাদ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, শিক্ষা, বাণিজ্য, অর্থ ও পরিকল্পনার সমন্বয় খুবই জরুরি। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের (এফএও) সহযোগিতাও খুবই দরকারি বলে মনে হয়।

সবশেষে একথা বললে ভুল হবে না যে, চ্যালেঞ্জ থাকবেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেমনটি বলেছিলেন- আমাদের আছে মাটি, মানুষ ও পানি। তাহলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কৃষিকে কেন টেকসই ও আধুনিক করতে পারব না?

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক ও সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ খবর