শনিবার, ২৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

আরেক বিজয়ের দিন ২৫ জুন

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

আরেক বিজয়ের দিন ২৫ জুন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যেমন ছিল বাংলাদেশের কাছে আনন্দ ও উল্লাসের দিন, তেমনি ২৫ জুনও তাদের কাছে আরও একটি আনন্দ ও উল্লাসের দিন। পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, হাসিনার এই সাফল্য ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী মনে করেন, উভয় দেশেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচণ্ড প্রসার লাভ করবে। ফলে বেকার সমস্যা জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গ একধাপ এগিয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৭১ সালে হিলারির পূর্বসূরি হেনরি কিসিঞ্জার ঘোষণা করেছিলেন, পাকিস্তান ভাঙতে দেবে না। নাম না করে বলেছিলেন, ভারতের এক মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ মুজিবকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হবে। হিলারি ক্লিনটন কয়েক বছর আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাসিনা তার সঙ্গে দেখা করেননি। তিনি উড়ে আসেন কলকাতায়। লাল কার্পেট পেতে মমতা তাকে সংবর্ধনা জানান। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে হিলারি ও মমতার মধ্যে চার ঘণ্টা কথা হয়। তখন দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তিনি তিস্তা চুক্তি করতে ঢাকায় যাবেন। রাজনৈতিক মহলের অভিযোগ, হিলারি-মমতা বৈঠকে মমতাকে বলে যান, তুমি তিস্তা চুক্তিতে সই করবে না। সে আলোচনায় আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন। কলকাতায় আমেরিকার দূতাবাসের কনসাল জেনারেল ন্যান্সি পাওয়েল এবং মমতার একদা ঘনিষ্ঠ মুকুল রায়। মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে ওই গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন। সে কথা এখন কলকাতায় সবার মুখে মুখে ঘুরছে।

এপার বাংলায়ও পদ্মা সেতু নিয়ে বিশেষ উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। এই পদ্মার ওপর দিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় ঘুরে বেড়িয়েছেন
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, হিলারির ওই বিস্ফোরক মন্তব্যের পরেই মমতা ব্যানার্জি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যান। ন্যান্সি পাওয়েল ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে ছিলেন। সেখান থেকে কলকাতায় এসেই তৃণমূল নেতাদের ও কিছু সাংবাদিককে বলেছিলেন, আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ভারতে আর কমিউনিস্টদের দরকার নেই। মমতাকে শাসনে রেখে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে দেব। তিনি তা করেও দেখিয়েছিলেন। ওই সভায় কিছু সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন বণিক সংগঠন এবং চেম্বার আর কমার্সগুলোর কর্তারা মনে করেন, পদ্মা সেতু চালু হলে পাঁচ ঘণ্টায় বাণিজ্যিক শহর নারায়ণগঞ্জ পৌঁছানোর আশায় আছেন বেনাপোল স্থলবন্দরের ট্রাকচালকরা। নারায়ণগঞ্জ থেকে বেনাপোল বন্দরের দূরত্ব পদ্মা সেতু হয়ে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। কিন্তু পদ্মাপাড়ের বিড়ম্বনায় এক রাত তো লাগেই, প্রায় দুই দিনের বেশি সময় লেগে যায়। ট্রাকচালকরা জানান, মাঝেমধ্যে চার দিনেও পৌঁছানো যায় না। ঢাকা শহরে দিনে ট্রাক চলা নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রায়ই ভোরের দিকে পদ্মা পার হতে থাকলেও সারা দিন তাদের বসে থাকতে হয় রাতের অপেক্ষায়। তাই পদ্মা সেতু তাদের কাছে স্বপ্ন ধরার সমান।

তারা আরও জানিয়েছেন, যশোর অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন ছিল পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকায় যাবে। তাছাড়া বাংলাদেশের স্থলবন্দর বেনাপোলের গুরুত্ব আরও বাড়বে। ওই অঞ্চলের কৃষিপণ্য রাজধানীতে দ্রুত বাজারজাতকরণের ফলে কৃষক ঠিকঠাক দাম পাবেন বলেও আশা করা যায়। এ ছাড়া পদ্মা সেতুর ফলে যশোর অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে বলে প্রত্যাশা প্রায় সবারই। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট এবং শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টের সঙ্গে সংযোগকারী বাংলাদেশের স্বপ্নের প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা যাত্রী ও মালবাহী যানবাহনের জন্য যাত্রা সহজ করবে। ধীরে ধীরে সে দেশের জিডিপি বাড়িয়ে তুলবে।

পদ্মা সেতুর নকশা করা হয়েছে দ্বি-স্তরবিশিষ্ট স্টিল-ট্রাম কম্পোজিট কিপিং রোডের ওপরে। নিচের রেলপথটি বিশ্বের গভীরতম ভিত্তি সেতু। ২৫ জুন পূর্বদিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদীর অপর পাড়ে একটি বিশাল জনসভায় ভাষণ দেবেন।

পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।

গুজব ছড়ানো হয়েছিল যে সেতু তৈরি করতে মানুষের মাথা লাগবে। সরকারও দক্ষতার সঙ্গে তা মোকাবিলা করেছে। হাসিনার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে শুধু পদ্মা সেতুই নয়, মেট্রোরেল ও দেশের বৃহত্তম টানেলের কাজও প্রায় শেষদিকে। সেগুলো এ বছরই বাংলাদেশের জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে আরও মেগা প্রকল্পের কাজও চলছে।

প্রাথমিকভাবে পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ কম ছিল। কিন্তু পরে এটি কয়েক পয়েন্ট বাড়িয়ে ৩.৮৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। নির্মাণ সময় ও খরচ উভয়ই বৃদ্ধির ফলে খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও নির্মাণ ব্যয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবে সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হলো, সেতুটি সম্পন্ন হয়েছে।

সেতুটি রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ঘটনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সেগুলো নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। সেতুটি জুন মাসে চালু হলে দেশের অর্থনীতি এক ধাক্কায় অনেকটা বৃদ্ধি পাবে।

কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হবে। সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানীতে কৃষিপণ্য পরিবহনে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় তৈরি করবে। কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাবেন। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে। এপার বাংলায়ও পদ্মা সেতু নিয়ে বিশেষ উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। এই পদ্মার ওপর দিয়েই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজরায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই পদ্মা নিয়ে অসংখ্য কবিতা, গান রচনা করেছেন তিনি। ফলে এই সেতুটি যে নতুন করে আবার দুই বাংলাকে যুক্ত করতে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই।   

লেখক :  প্রবীণ  সাংবাদিক (ভারত)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর