ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

আজকের পত্রিকা

কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বীকৃতি দেওয়া হোক
হাফেজ মোহাম্মদ ওমর ফারুক

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের জন্য যারা মেহনত করেছেন, তার মধ্যে ১. কওমি মাদ্রাসা ২. দাওয়াত ও তাবলিগ ৩. হক্কানি পীর মুরিদের অবদান অগ্রগণ্য। দাওয়াত ও তাবলিগের মূলেও রয়েছে কওমি মাদ্রাসা। অধিকাংশ হক্কানি পীর মুরিদের মূলেও রয়েছে কওমি মাদ্রাসা। আর কওমি মাদ্রাসার মূল হচ্ছে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ। দারুল উলুম দেওবন্দ যে সব উলামায়ে কেরাম প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাদের সবারই এ বিষয়ের ওপর ঐকমত্য ছিল যে, এ মাদ্রাসা সম্পূর্ণ সরকারি অনুদান ও প্রভাবমুক্ত থাকবে। ভারত সরকার সে দেশের কওমি মাদ্রাসাকে উলামায়ে কেরামের দাবি অনুযায়ী স্বীকৃতি দিয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে যে, কওমি মাদ্রাসা সম্পূর্ণ সরকারি অনুদান ও প্রভাবমুক্ত থাকবে এবং সেভাবে আছেও। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশের হক্কানি উলামায়ে কেরামদের একাংশ কওমি মাদ্রাসার স্বীকৃতির ব্যাপারে সরকারের কাছে দাবি তোলেন। ২০০১ সালে শায়খুল হাদিস আল্লামা আযীযুল হক (র.) যে সব শর্তের ভিত্তিতে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনী জোট করেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি জোট সে শর্ত পূরণ করেনি। এখন বিএনপির অনেক নেতাই বলেন, জামায়াতের কারণে তারা উলামায়ে কেরামের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় যখন শেষ হয়ে এলো তখন শায়খুল হাদিস মাঠে নেমে পড়লেন। সে অবস্থায় কওমি মাদ্রাসাকে সরকার মৌখিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। উদ্দেশ্য ছিল, সামনের নির্বাচনে যেন আবারও ধমভীরু মানুষের ভোট পাওয়া যায়। অতঃপর আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে যখন সরকার গঠন করল উলামায়ে কেরামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়। এ উদ্দেশ্যে সরকার একটি কমিশন গঠন করে। যার চেয়ারম্যান হলেন আল্লামা আহমদ শফি আর কো-চেয়ারম্যান হলেন মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ, আর সদস্য সচিব হলেন মুফতি রুহুল আমীন। তখন অনেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললেন যে, কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ দুজন সদস্য সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তারা কার স্বার্থ রক্ষা করবেন? এ বিতর্কে সে কমিটি প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অতঃপর সরকার এ মেয়াদে এসে আবার স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী হয়ে পড়ে এবং সেই কমিটি বাদ দিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করে। আর তখনই আবার স্বীকৃতি নিয়ে শুরু হলো আলোচনা-সমালোচনা। এখানে একটি বিষয় সরকারকে গভীরভাবে চিন্তায় রাখতে হবে। বাংলাদেশের ৮৫% মানুষ কওমি মাদ্রাসার হুজুরদের মহব্বত করেন, ভালোবাসেন। ৮৫% মসজিদের ইমাম-খতিব হলেন কওমি মাদ্রাসাার হুজুর। আর এই কওমি মাদ্রাসায় যারা পড়ান বা পড়েন তাদের ৯০ ভাগই আবার অরাজনৈতিক। যেমন অধিকাংশ হুজুরই মাদ্রাসায় কিতাবাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। আবার অনেকে দাওয়াত ও তাবলিগ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আবার অনেকে পীর মুরিদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অল্প কিছু সংখ্যক উলামায়ে কেরাম যারা রাজনীতি করেন তারাও আবার সক্রিয় নয়। কিতাবাদি পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিষয় দিবস ভিত্তিক রাজনীতি করেন। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিতে হলে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্বীকৃতি দিতে হবে। ওলামায়ে কেরামদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের ফাটল না ধরে সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় কওমি মাদ্রাসাকে সরকারি প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। এ বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়ে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর চেয়ারম্যান-সচিব যারাই নিযুক্ত হবেন, কওমি মাদ্রাসার মধ্য থেকেই হবেন এবং সবার পরামর্শের ভিত্তিতে হবেন। এর মধ্যে সরকারি কোনো প্রভাব থাকবে না। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে যদি সরকার স্বীকৃতি দেয় তাহলে সরকারেরও লাভ এবং কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদেরও লাভ। সরকারের লাভ তারা বিশাল বড় এক জনগোষ্ঠীর সমর্থন অর্জন করবে। আর কওমি মাদ্রাসাওয়ালাদের লাভ হবে যে স্বীকৃতির জন্য তারা আন্দোলন করল এবং যাদের সঙ্গে জোট করল তাদের কাছ থেকে পেল না, পেল তাদের কাছ থেকে যাদের সঙ্গে কোনো জোট হয়নি এবং দাবিও ছিল না। আর সরকার যদি কওমি মাদ্রাসাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশে কলকাঠি নাড়ে এর ক্ষতি সরকার ও কওমি মাদ্রাসা উভয় পক্ষেরই হবে। সরকারের ক্ষতি হবে কারণ তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে না। তাদের ক্ষমতা চলে গেলে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় এলে কওমি মাদ্রাসার পুরো নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে চলে যাবে এবং সিলেবাস তারা তাদের মতো করে প্রণয়নের সুযোগ পাবে। বর্তমানে কওমি মাদ্রাসায় মওদুদিবিরোরী সিলেবাস পড়ানো হয়  তখন তা পড়ানো আর সম্ভব হবে না। এর দৃষ্টান্ত সরকার নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা। আলিয়া মাদ্রাসায় যারা পড়ালেখা করে তারা বেশির ভাগই কোন দলের কোন মতের তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। সরকার গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে বিষয়টি যাচাই করে দেখতে পারে। আর একটি বিষয় সরকারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমান জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সরকারকে কওমিওয়ালারা যেভাবে সহযোগিতা করেছে সেভাবে অন্যরা করেনি। আর কওমি ওলামায়ে কেরামদের কাছে আবেদন, যেহেতু সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে, সেহেতু স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বীকৃতি নেওয়া উচিত। তবে এটা আমাদের সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে জাতীয় স্বার্থে এবং দীন ও ইসলামের স্বার্থে।

লেখক : ইসলামী গবেষক।



এই পাতার আরো খবর