বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ

আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যে জাতীয়তাবাদ ছিল ভাষাভিত্তিক, তাকে আমরা বলি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এটা এখন পরীক্ষিত সত্য যে, ধর্ম নয়, ভাষাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি। আমাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে একটা স্বাভাবিকতা আছে কিন্তু তাই বলে এই রাষ্ট্রকে আমরা জাতিরাষ্ট্র বলব না। কেননা, এখানে ক্ষুদ্র আকারে হলেও অন্য জাতিসত্তার উপস্থিতি রয়েছে। বস্তুত, আধুনিক বিশ্বে এক জাতি এক রাষ্ট্র এটা আর সম্ভব নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্জনের দিক হলো এই, এটা এ দেশের মানুষকে ইহজাগতিক করে তুলেছে। রাষ্ট্রের পক্ষেও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া উচিত ছিল। যদিও রাষ্ট্র এখন তার ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে পারছে না। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে সে মেনে নিয়েছে। অথচ রাষ্ট্র যে প্রধান দুই দল পালাক্রমে পরিচালনা করছে তারা উভয়ই নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বভাবতই বাংলা স্বীকৃত হয়েছে। এটা কেবল বাংলাদেশের বাঙালিদের জন্য নয়, সারা বিশ্বের বাঙালিদের জন্যই এটি গৌরবের বিষয়। কেননা, এই প্রথম একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

প্রত্যাশিত ছিল বাংলাদেশে বাংলা ভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম, কেবল প্রাথমিক স্তরে নয়, সর্বোচ্চ স্তরেও। আদালতের ভাষাও বাংলা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উচ্চশিক্ষার মাধ্যম বাংলা হয়নি। উচ্চ আদালতেও বাংলার প্রচলন ঘটেনি। অন্যদিকে মান বাংলা আজ নানানভাবে আক্রান্ত। উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা কথাবার্তায় ইংরেজি শব্দ ও বাক্যাংশ বাংলার সঙ্গে মিশিয়ে অত্যন্ত স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেন। সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ও অশিষ্ট শব্দ ব্যবহারেও তাদের মনোভাব বেপরোয়া। অন্যদিকে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে নাটক ও বিজ্ঞাপনে মান ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে। আকাশ প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে ঘরের ভিতর হিন্দি ভাষা চলে এসেছে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এক সময় পাকিস্তানিরা বাংলার সঙ্গে ফার্সি ও উর্দু মেশানোর চেষ্টা করেছিল, আমরা তার প্রতিবাদ করেছি এবং বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আজ হিন্দির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ নেই। উর্দুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়েই আমরা ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলাম। ভাষা হিসেবে উর্দু কিন্তু হিন্দির চেয়ে নিকৃষ্ট নয়। এখন হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানিরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বলিউডের তারকাদের বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া করে এনে ব্যবসায়ীরা মুনাফা লাভের আয়োজন করছে। অন্যদিকে এফএম রেডিও যে ভাষা ব্যবহার করে সেটার মান বাংলা ভাষা থেকে অনেক দূরে। যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে, সেখানে জাতীয় সংসদে সদস্যরা যেসব বক্তৃতা দেন, সেগুলো অনেক সময় সাহিত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের এখানে সংসদীয় বক্তৃতাকে মান বাংলার বিকৃতি ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই। জনসভায়ও একই রকম বিকৃতি চলে। অথচ রাজনীতিবিদদেরই হওয়ার কথা পথপ্রদর্শক। তাদের আচরণ ও ভাষা ব্যবহার দেখেই সাধারণ মানুষ নিজেদের ভাষা ব্যবহারের মান ঠিক করবে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বাংলা ভাষা খুব ভালো অবস্থায় নেই। শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিত্তবান সন্তানরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে, গরিবরা যাচ্ছে মাদ্রাসায়। আর মধ্যবিত্ত বিদ্যায়তনে যে বাংলার চর্চা করে তাতেও ব্যাকরণ ও উচ্চারণ কোনোটার শুদ্ধতার ওপরই জোর দেওয়া হয় না।

শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, বইমেলায় প্রচুর বই বের হয় প্রতি বছর, কিন্তু বাংলা ভাষার অবস্থা যে ভালো নেই সেটা একটা মর্মান্তিক সত্য। ভাষা সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষা ব্যবহারের মধ্যে যেমন একজন মানুষকে চেনা যায়, ভাষার সাধারণ অবস্থা দেখেও দেশের সংস্কৃতির হালহকিকত সম্পর্কে টের পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে এখন প্রায় সব দিক দিয়েই নৈরাজ্য চলছে। বাংলা ভাষার অপব্যবহারও সেই নৈরাজ্যেরই অংশ। স্বাধীনতা মানে, যার যা ইচ্ছে করার সুযোগ বলে মনে করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে যতটা অকার্যকর, ভাষার ক্ষেত্রে তার চেয়ে অধিক দুর্দশাগ্রস্ত।

ভাষাকে কেবল উপর কাঠামোর অংশ ভাবলে ভুল করব। ভাষা আসলে সমাজের মূল কাঠামোরই অংশ। ভাষার মধ্য দিয়েই আমরা নিজেকে প্রকাশ করি এবং অন্যের সঙ্গে যুক্ত হই। ভাষার যোগাযোগ, যান্ত্রিক যোগাযোগের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। ভাষার দক্ষতা অন্য দক্ষতার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই হচ্ছে সবচেয়ে স্বাভাবিক গভীর ও স্থায়ী। শিক্ষায় মাতৃভাষার যথার্থ ব্যবহারে আমরা যে পরিমাণে ব্যর্থ হচ্ছি, আমাদের সমষ্টিগত অগ্রগতিও ততটাই পিছিয়ে পড়ছে। ভাষা মানুষকে সামাজিক করে। বাংলা ভাষার অযথার্থ ব্যবহার আমাদের সামাজিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটা বড় অন্তরায়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা। কিন্তু এখানে শিক্ষা যে তিন ধারায় বিভক্ত তাতে শ্রেণি বিভাজন আরও গভীর ও বিস্তৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা উপকার না করে বরং অপকারই করছে। আজকে বাঙালি বলে মানুষ যে কুণ্ঠা প্রকাশ করে, সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের সময় এটা ছিল অকল্পনীয়।

দুর্নীতিপরায়ণতায় পৃথিবীতে বাংলাদেশ এখন শীর্ষস্থানীয়। তার শেয়ারবাজার বিশ্বে নিকৃষ্টতম। সড়কগুলো চলাচলের চেয়ে দুর্ঘটনা সৃষ্টিতে অধিক উপযোগী। আমাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত ভয়াবহরূপে রক্তাক্ত, আমাদের সীমিত খনিজসম্পদ বিদেশিরা দখল করার জন্য তত্পর। আমরা আমাদের সমুদ্রসীমাকে চিহ্নিত পর্যন্ত করতে পারিনি। এসব ঘটনা আমাদের সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন। আমরা একে মেনে নিচ্ছি। আমরা একটা কোণঠাসা জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছি। বাংলা ভাষার যে অপ্রচলন ও বিকৃতি, তা এই সামগ্রিক সংস্কৃতিরই অংশ বটে।

সংস্কৃতির মূল কথাটা হচ্ছে, মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ানো। কিন্তু তা পারছে না। বাঙালি আগে যেমন, এখনো তেমনি একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবেই রয়ে গেছে। যদিও সংখ্যার দিক থেকে তার পরিমাণ ২৬-২৭ কোটিতে পরিণত হয়েছে। বাংলা, পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রাদেশিক ভাষা মাত্র। তাই বাংলা ভাষার জন্য ভরসার জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ বাঙালি এবং বাংলা ভাষাকে সে ভরসা দিতে পারছে না। এর জন্য দায়ী কে?

বাংলা চিরকালই জনগণের ভাষা। রাষ্ট্রীয় শাসকরা ছিল ভিন্নভাষী। তারা বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করবে, এটা প্রত্যাশা করা যায়নি। পাকিস্তানি শাসকরা তো বাংলাকে উচ্ছেদ করতে পারলেই খুশি হতো। কিন্তু এখন তো আমাদের শাসক শ্রেণি বাঙালি। তারা কেন বাংলার সঙ্গে শত্রুতা করছে?

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, বাংলার অপ্রচলন ও বিকৃতির জন্য দায়ী দেশের জনগণ নয়, দায়ী হচ্ছে দেশের শাসক শ্রেণি। তারা যে বাংলা ভাষার সঙ্গে শত্রুতা করছে, তার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, দেশ যারা শাসন করে তারা নিজেদের দেশের জনগণের থেকে কেবল ভিন্নতর নয়, উচ্চতর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিকৃত বাংলা ব্যবহার করে আমাদের শাসক শ্রেণি অতীতের শাসকের মতোই নিজেদের উচ্চতা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয়ত, তারা নিজেদের আন্তর্জাতিক ও স্মার্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তাদের যোগাযোগ পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে। বিশ্ব পুঁজিবাদের ভাষা বাংলা নয়। বর্তমান সময়ে প্রধানত ইংরেজি বটে। তাই মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে পুঁজিবাদের ভাষাকে গ্রহণ করতে তাদের এত আগ্রহ। তৃতীয়ত, শাসক শ্রেণি নিজেরাই বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তাই সন্তান-সন্ততি, বিষয় সম্পত্তি ও নিজেদের ভবিষ্যেক বিদেশে গচ্ছিত রাখতে চায়। সে কারণেও বাংলা ভাষার প্রতি তাদের অনীহা। আরেকটা কারণ হলো, বাঙালি পরিচয়টি এখন আর গৌরবের বিষয় নয়। তাই এ পরিচয় তারা দিতে আগ্রহী নয়। তাহলে প্রতিকারটা কী?

প্রতিকার হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, যে জাতীয় মুক্তি অর্জনের স্বপ্নকে সামনে রেখেছিল, সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। স্বপ্নটা ছিল কেবল জাতীয়তাবাদী নয়, একটি গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্র ও সমাজে জনগণের নেতৃত্ব নিয়ে আসা। যে জনগণ বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানে না, বাংলার মধ্য দিয়েই যারা বিশ্বকে চিনতে চায় এবং আকাঙ্ক্ষা রাখে বাংলাকে সঙ্গে নিয়েই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার।

সমাজ ও রাষ্ট্রের ওই মুক্তি না এলে বাংলা ভাষা বা বাঙালি কারোরই মুক্তি হবে না। সম্মানও বাড়বে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, বাংলা ভাষার অবস্থা ও অবস্থান দুটোই সে কথাটাকেই জানান দিচ্ছে। তাই যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, তাদের দায়িত্ব মুক্তির সে সংগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর সে যাত্রায় বাংলাই হবে সহযাত্রী।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক,

ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর