বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সক্ষমতা বনাম দুর্বলতা

রোবায়েত ফেরদৌস

বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সক্ষমতা বনাম দুর্বলতা

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

ছোট্ট একটা তথ্য দিয়ে শুরু করি, গেল বছর জুন মাসে ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়ন পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বলা হয়েছে, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত লক্ষ্য সম্ভবত ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এবং সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণকে দারিদ্র্যমুক্ত করার কাজ চালিয়ে যাওয়াই হবে প্রথম অগ্রাধিকার। এ অতি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাংলাদেশের সব নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ প্রয়োজন এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজন দেশটির আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সমর্থন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্বেগজনক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ হতে পারে (প্রথম আলো, ১৪ জুন, ২০১৬)।

আমরা কি এই উদ্বেগ থেকে শিক্ষা নিচ্ছি? বরং বছরের পর বছর ধরে দলগুলোর ভিতরে ক্ষয়িষ্ণু গণতান্ত্রিক ধারাই কেবল লক্ষ করছি। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও তাই। এখানে একটি রাজনৈতিক শক্তি আরেকটি রাজনৈতিক শক্তিকে সহ্য করতে পারে না। এই যে ‘পলিটিক্স অব অ্যানিহিলেশন’ বা ধ্বংসের রাজনীতি— এ ভাবনা এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। একটি রাজনৈতিক শক্তিকে বিনাশ করে আরেকটি শক্তি টিকে থাকতে পারে না। বর্তমান অবস্থায় সেই চেষ্টা চলছে। সেটা শুধু বিএনপির জন্য নয়, সব বিরোধী চিন্তা ও রাজনৈতিক শক্তি ধ্বংস হলে কী হবে, একবারও কী ভেবে দেখা হয়েছে? রাজনীতিতে যে ভ্যাকুয়াম তৈরি হচ্ছে তার পরিণতি কী হতে পারে, সেটা কী ভেবে দেখা হয়েছে? জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ তো আকাশ থেকে পড়ছে না। দেশ পরিচালনা আর দেশেকে সাংস্কৃতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এক কাজ নয়। দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সমান্তরালে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। সবার কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। ভিন্নমত ও ভিন্ন মতাদর্শের তাদের কথা মূল্যায়নের সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই গণতন্ত্রের সঠিক রূপ আমাদের কাছে ধরা দেবে।

রিখটার স্কেল দিয়ে ভূতাত্ত্বিকরা পরিমাপ করেন ভূমিকম্পের মাত্রা কতটুকু; তাদের স্কেলের পরিসীমা ১ থেকে ১০; সংখ্যা যত বেশি ভূমিকম্পের মাত্রা তত জোরাল; কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য এমন গজকাঠি কি আছে যা দিয়ে গণতন্ত্র মাপা যায়? দেশে এখন কতখানি গণতন্ত্র বিদ্যমান কোন বাটখারা দিয়ে এর ওজন করব? ভূকম্পন একটি ‘পরিমাণগত’ বিষয়, একে তাই মাপা যায়, পক্ষান্তরে গণতন্ত্র একটি ‘গুণগত’ বিষয়, একে কি সংখ্যা দিয়ে মাপা সম্ভব? কিন্তু আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক গণিতজ্ঞ পিথাগোরাস বলেছিলেন, ‘বাবৎুঃযরহম পধহ নব রহঃবত্ঢ়ত্বঃবফ রহ ঃবত্সং ড়ভ হঁসনবত্ং’– অর্থাৎ ‘সবকিছুকেই সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা যায়’। গণতন্ত্র-গবেষকরাও তাই অনেকগুলো চলক বিবেচনায় নিয়ে একটি দেশে কী পরিমাণ গণতন্ত্র বিদ্যমান তা হিসাব কষার চেষ্টা করেন। চলকগুলো হতে পারে এরকম, ক. সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন খ. মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সম্মান ও পরমতসহিষ্ণুতা গ. আইনের শাসন ও বিচার পাবার অধিকার ঘ. কার্যকর সংসদ ঙ. সরকারের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা চ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংগ্রহণ ইত্যাদি।

গণতন্ত্র কেবল একটি সরকার ব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্র একটি মূল্যবোধের নাম, গণতন্ত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি জীবন-ব্যবস্থা— কমপ্লিট কোড অব লাইফ; যে মূল্যবোধের মূল কথা টলারেন্স, পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যের মতকে সম্মান দেওয়া; দেশে সেটা কতটুকু আছে? প্রতিদিন আমরা দেখছি গালাগালি আর দোষারোপের রাজনীতি; কুরুচি, চরিত্রহননকর আর অশ্লীল বাক্যবাণ। অথচ দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’— এর চেয়ে ভালো করে গণতাািন্ত্রক মূল্যবোধের কথা, আমার মনে হয়, আর কেউ বলতে পারেননি; তো সেই ভলতেরিয়ান ফিলসফি থেকে আমাদের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি কত দূরে? দেশ স্বাধীনের পর অল্প কিছু দিনপরই আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সভাপতি কিংবা চেয়ারপারসন কী কোনো দিন পরিবর্তন হবে? তার মানে এই নয় যে দুই দলে আর কোনো যোগ্য লোক নেই। মূল ব্যাপারটা হলো দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা। দলের মাঝে গণতন্ত্রের চর্চা না করে দুই দল দেশের মাঝে গণতন্ত্র চর্চা করতে চায় কীভাবে? একটি মৌলিক প্রশ্ন বটে। গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের কথা বলে। সেই অবস্থা কী বর্তমানে আছে? জনমানুষের সেই ‘ভয়েস’ কোথায়? সেই ভয়েস সংসদে অনুুপস্থিত, অনুপস্থিত বাইরেও। গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা করতে হলে এই ভয়েসকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নিজের নৈতিক জায়গা যখন দুর্বল হয়ে যায় তখন বিরোধী শক্তিকে আর সহ্য করার ক্ষমতা থাকে না। বর্তমান অবস্থা তাই। এখানে যে লড়াইটা এখন আছে সেটা ক্ষমতা দখলের। অবশ্যই গণতন্ত্র চর্চার জন্য নয়। তবে নাই-মামার থেকে যেহেতু কানা-মামা ভালো সে জন্য সামরিক বা ভিন্নরকম শাসনের চাইতে দুর্বল গণতন্ত্র অন্যতম।

আর নির্বাচনের পর দলগুলো হেন কোনো দুর্নীতি নেই যা করেনি। প্রত্যেকটি দল ক্ষমতায় এসে তাদের দলের নেতাদের সুবিধা দিয়েছে এবং সুবিধা নিয়েছে। এর ফলে তাদের আদর্শিক ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে, নীতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরিণামে, দলগুলো জনগণের প্রত্যাশামাফিক কাজ যেমন, জনমানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ, নীতি প্রণয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সংহতকরণ— সব বিষয়ে অনীহা দেখায়। তখন একটা ভীতি তৈরি হয়। আর যার ফলাফল এখন সাধারণ মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে। গণতন্ত্রের সবচেয়ে দরকারি বিষয় সরকারের জবাবদিহিতা। সরকার সংসদের কাছে তার প্রত্যেকটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য। সেটি আজ বিলীন হয়ে গেছে;  হাঁস আর সজারু মিলে  এখন যে হাঁস-জারুমার্কা ‘সরকারি-বিরোধী দল’ আছে সংসদে, তাদের যে কথা বলার সাহস নেই, প্রতিবাদের সাহস নেই, সেটা সবার জানা। এমন একটি তাঁবেদার বিরোধী দল দিয়ে গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা যে সম্ভব নয় তা বর্তমান বিরোধী দলের লোকজনও জানে। এখন চলছে ‘তাঁবেদারিত্বের গণতন্ত্র’।

জানি যে, রাজনীতির কোয়ালিটি বা গুণগত মানের দিকে থেকে বাংলাদেশের স্কোর অনেক নিচে; কথা সত্য যে, ‘অনুন্নত রাজনীতি’ বাংলাদেশে রাষ্ট্রের উইক বা দুর্বল পয়েন্ট; সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্র দুর্নীতির ক্রমবিস্তার, আইনি-শাসনের নাজুক অবস্থা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা, ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’ বা গণতন্ত্রের ঘাটতি— এগুলোও আমাদের দুর্বল দিক, তাও মানি। তবে গেল চার দশকে বাংলাদেশের ঝুলিতে গর্ব করার মতো যে অনেক অর্জন আছে সেটাও কিন্তু সমান সত্যি। ক. প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি, খ. রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের শনৈঃশনৈঃ বিকাশ, গ. ধান উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য, ঘ. প্রবাসী শ্রমিকদের বৈদেশিক অর্থের অব্যাহত প্রবাহ, ঙ. তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে সাহসী পথচলা, চ. এনজিও/ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুঁজির চলমানতা ছ. শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস এবং জ. নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক পুঁজির বিস্ময়কর উত্থান এর অন্যতম; এগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্ট্রং বা সবল দিক। আমাদের শ্রম, আমাদের মেধা আর মেহনত করার ক্ষমতা আমাদের সবল দিক; পুরো পৃথিবীতে আমাদের এ ক্ষমতার স্বীকৃতি আছে, প্রমাণ আছে। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের সবল দিক, পহেলা বৈশাখ, রমনার বটমূল, গান-কবিতা আমাদের রাষ্ট্রের উজ্জ্বল দিক; রমনা আর বোশেখ উৎসবের ভিতরে যে অসাম্প্রদায়িক আর ধর্মনিরপেক্ষ উপাদান সেটা আমাদের শক্তি; বিপরীতে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পকেটে যে ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, আর উগ্রবাদ বিরাজ করছে ও বিস্তৃত হচ্ছে তা আমাদের ক্ষয় ও ক্ষতির দিক। সাম্প্রদায়িক বিভাজন, মৌলবাদ, কুসংস্কার, জঙ্গিত্ব, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মের নামে রক্তক্ষয়— আমাদের অতিশয় দুর্বল দিক। শাহবাগ আমাদের শক্তি জোগায় আবার শাপলা চত্বর আমাদের ভীত করে; শাহবাগের গণজাগরণকে যদি বলি ‘থিসিস’, শাপলার হেফাজতের সমাবেশকে তবে বলতে হয় ‘অ্যান্টি-থিসিস’; সত্য যে সমাজে পরস্পর বিরোধী এ দুটি শক্তি কিন্তু আছে, আছে তাদের দ্বান্দ্বিকতাও— যার যার শক্তি তারা প্রদর্শন করছে এবং করবেও। এ দুয়ের ‘সিনিথিসিস’ কীভাবে হয় সেটাই এখন ‘দেখিবার অপেক্ষা’। কবিতা আমাদের শক্তি —কবিতা এ দেশে প্রায় সবাই লিখেন, মা-মাসি, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার মাঝেই কাব্যলক্ষ্মী ভর করেন; যিনি লিখতে পারেন না, কবিতা রচনা করেন এমনকি তিনিও, মুখে মুখে, নাম হয় তার চারণ কবি; এ যেন এক কবিতার দেশ। প্রতিবছর জাতীয় কবিতা উৎসব হয়, দেশের কয়েক হাজার কবি এতে অংশ নেন, নিজেদের কবিতা পড়ে শোনানোর জন্য গাঁটের টাকা খরচ করে ছুটে আসেন রূপসা থেকে, আসেন পাথুরিয়া, টেকনাফ, তেঁতুলিয়া থেকে। ফি বছর নিয়ম করে পৃথিবীর সবচাইতে দীর্ঘ বইমেলা হয় বাংলাদেশে— পুরো এক মাস হয় এবং প্রতিবছর হয়; একুশের বইমেলা— এটা অনেক ইতিবাচক নাম্বার যোগ করেছে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে। সাইবেরিয়া থেকে ফি শীতে পরিযায়ী পাখি যেমন আসে, তেমনি অনেকে বার্লিন, সিডনি, নিউইয়র্ক কিংবা বিলেত থেকে ঠিক এই সময়ে পরিযায়ী পাখির মতোই বাংলাদেশে ছুটে আসেন কেবল বইমেলার টানে! কী অদ্ভুত সুন্দর এ প্রাণের টান, ভাবলেই কান্না পায়, ভূ-ভাগে আবেগঘন এমন দ্বিতীয় জাতি মেলা ভার। কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার-পাউন্ড-ইউরো খরচ করে হাজার মাইল দূর থেকে প্রতিবছর প্রবাসী বাঙালিরা ছুটে আসেন বইমেলার ভিড়ে নিজেকে শামিল করতে, এ আতম্ভর আশায় যে, তারা যেন এ মিলনমেলা থেকে বাদ না যায়; দূরে থাকলেও তিনিও যে এ সংস্কৃতির একজন গর্বিত উত্তরাধিকার মেলায় এসে তার জানান দিতে চান। এভাবেই বইমেলা দেশি-প্রবাসী লাখো পাঠকের মনোজগতে শুভ অভিঘাতের সৃষ্টি করে চলেছে; একুশ আজ জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে, বাংলা পেরিয়ে একুশ আজ পুরো পৃথিবীর, মহিমান্বিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সম্মানিত হয়ে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অসম্ভব সবল দিক এটি। আবার এফডিসিকেন্দ্রিক বাংলা চলচ্চিত্র এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আমাদের দুর্বল দিক; যদিও কিছু ভালো চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে এবং পতন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে, শুভ দিক নিঃসন্দেহে সেটি। বাংলাদেশে বহু জাতি, বহু ভাষা আর বহু ধর্মের মানুষ বাস করে— সমাজের এ বহুত্ববাদী বিন্যাস আমাদের শক্তি; কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা আর সংবিধানে এ বহুত্ববাদের প্রতিফলন না থাকাটা আমাদের দুর্বল দিক; জাতিগত অসাম্য আর ধর্মীয় বৈষম্য আমাদের ক্ষয়ের দিক। আবার সংগীত আমাদের স্বাস্থ্যের দিক; আপনারা কি জানেন, বাংলাদেশেই বসছে পৃথিবীর বৃহত্তম ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদি সংগীতের সবচেয়ে বড় আসর। পুরো তিন-চার রাত জেগে স্টেডিয়াম ভর্তি সমঝদাররা উপভোগ করছে ধ্রুপদি সংগীতের মূর্ছনা, বলুন ভাবা যায়? এর চেয়ে বড় স্ট্রং পয়েন্ট আর কী হতে পারে? নিঃসন্দেহে ভাটিয়ালি, কবিয়াল, গম্ভীরা, জারি-সারি-লোককাহিনী আমাদের দারুণ স্ট্রং পয়েন্ট; পট, পুতুল নাচ, ঘুমপাড়ানি গান, ছড়া সেও সবল দিক বৈকি। বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গান আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের বিস্ময়কর সম্পদ— দেশকে নিয়ে এত সুরেলা, এত আবেগমেশানো গান পুরো পৃথিবীতেই বিরল। আমরা কি জানি আন্তর্জাতিক সংগীতের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর লোকগান কিংবা চীনে অনুষ্ঠিত আন্তঃদেশীয় সংগীতের আসরে ‘সাধের লাও’ গানটি দ্বিতীয় হয়েছিল; এটি গেয়েছিলেন কিরণ চন্দ্র রায়; ‘মিউজিক সঁ ফ্রঁতিয়ে’— মিউজিকের কোনো ফ্রন্টিয়ার নেই, ‘মিউজিক উইদাউট বর্ডার’— সংগীতের কোনো সীমান্ত নেই— নিয়ত এর প্রমাণ বাংলা সংগীত রেখে চলেছে।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার রবীন্দ্রসংগীত আসর বসিয়েছে খোদ জাতিসংঘের সদর দফতরে। আমাদের মুক্তি সংগ্রাম আমাদের সব থেকে বড় শক্তি; আর মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সব গান, সেও আরেক শক্তি। রবীন্দ্র-নজরুল-লালন-বাউল আমাদের শক্তি; ইতিবাচকভাবে বিস্ময়কর! ষোল কোটির দেশে দশ কোটি মানুষ মোবাইলে কথা বলতে পারে, ক্ষেতে-পাহাড়ে-প্রত্যন্তে সেলফোনের যে ব্যবহার করে— এ এক বিশাল অর্জন। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে যে ‘সাংস্কৃতিক মন্থরতা’ কাজ করে, তাকে সর্বোত ভুল প্রমাণ করে প্রযুক্তিবান্ধব এক জাতি হিসেবে বাকি বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন পরিচয় নির্মিত হচ্ছে। আমাদের ক্রিকেট আমাদের আরেক অহংকার। ক্রিকেট বদৌলতে পুরো পৃথিবী বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে চিনতে, জানতে, সমীহ করতে।

আর রাজনীতি? সে আমাদের রুগ্ন দিক; শুধু রাজনীতির স্কোরটা একটু ভালো হলে আমাদের ঠেকিয়ে রাখার কোনো শক্তি পৃথিবীতে নেই। কাজেই দুষ্ট রাজনীতি আর নষ্ট রাজনীতিবিদদের কাছে দেশটাকে আমরা জিম্মি হতে দিতে পারি না। চলমান রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পাঠ করতে ভয়ঙ্করভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। গেল এক দশকে পুরো পৃথিবী দারুণভাবে পাল্টেছে, তার সমান্তরালে পাল্টেছে এ দেশের মানুষের রুচি-চাহিদা-প্রয়োজন; কিন্তু চলমান রাজনীতি আর ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল তার সঙ্গে ‘কমপ্যাটিবল’ নয় একেবারেই— চিন্তায় আর মানসিকতায় তারা অনেক অনেক পেছনে; মানুষের মনের মানচিত্র তারা পড়তে পারছে না। কাজেই দোহাই মুক্তিযুদ্ধের, দোহাই শুভবুদ্ধির ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা’ আর ‘যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়ার’ এহেন নগ্ন আর ন্যক্কারজনক খেলা থামান; ‘রাজনৈতিক ন্যাকামি’ আর ‘পলিটক্যাল নখরামি’ যথেষ্ট হয়েছে— দয়া করে এবার আমাদের মুক্তি দিন, বাঁচতে দিন, স্কোরবোর্ডে চার-ছক্কা যোগ করতে দিন, আরও স্ট্রং আরও সবল রাষ্ট্র নির্মাণের পথ করে দিন; রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘হেথা হতে যাও পুরাতন’। জায়গা ছেড়ে দিন, পথ করে দিন যাতে নতুন সৃজনশীল রাজনীতির বিকাশ এ বাংলায় সম্ভব হয়; পুরনো আর বাতিল, পচা-বাসি আর ফসিলাইজড রাজনীতির দিন এখন শেষ; দরকার ঝলমলে, সৃজনশীল, টাটকা রাজনীতি; একুশ শতকের উপযোগী নতুন, মননশীল আর ক্রিয়েটিভ পলিটিক্স।

বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যেরকম মডেল চাইছেন— কম গণতন্ত্র আর বেশি উন্নয়ন— লি কুয়ানের এ ‘সিঙ্গাপুর-মডেল’ কিংবা মাহাথিরের ‘মালয়েশিয়া-মডেল’ সফল হবে যদি বাংলাদেশে তাঁর মতো কঠোর হাতে দুর্নীতির বল্গাহীন রশিকে টেনে ধরা যায়। বাংলাদেশের সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে যেভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। রাজনীতিবিদ, পুলিশ, চিকিৎসক, আমলা, শিক্ষক থেকে শুরু করে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য যেরকম স্টেট্সপার্সনশিপ দরকার বর্তমানে তা নেই।

সুশাসন প্রতিষ্ঠাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি করা গেলে, মানুষ হয়তো লি কুয়ানের ‘কম গণতন্ত্র আর বেশি উন্নয়নের মডেল’ মেনে নেবে; কিন্তু মানুষের মনে সংশয় একশ ভাগ যে, এ সরকার দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠায় আদৌ আন্তরিক কিনা। কারণ এ সরকারের কাজেকর্মে এর ন্যূনতম কোনো ইঙ্গিতও কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চুরি, দুর্নীতি, লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করবেন, রাজনীতিকে টাকা বানানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন, জোর করে রাষ্ট্র ক্ষমতা আঁকড়ে থাকবেন আবার সুষ্ঠু নির্বাচনও দেবেন না, এটা বাংলাদেশের মানুষ বেশি দিন মেনে নেবে না। সাংস্কৃতিক রুচিসম্পন্ন মানবিক-বৈষম্যহীন, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নির্মাণের আত্মম্ভর আকাঙ্ক্ষা থেকে আমরা এক চুলও সরে আসতে পারি না। রাষ্ট্রকে এখন কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলে চলবে না, একে হতে হবে জাতিনিরপেক্ষ, ভাষানিরেপেক্ষ, লিঙ্গনিরপেক্ষ ও যৌনতানিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে ‘সংস্কৃতি’, আর ‘রাজনীতি’ হবে সে লক্ষ্য পূরণের উপায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও

সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর