বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

‘নীলকণ্ঠ’ কম্যুনিস্ট : পাকিস্তানি জামানায় ও স্বাধীন বাংলাদেশে

যতীন সরকার

‘নীলকণ্ঠ’ কম্যুনিস্ট : পাকিস্তানি জামানায় ও স্বাধীন বাংলাদেশে

শিল্পকর্ম : কাইয়ুম চৌধুরী

দারিদ্র্যের কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া অনেক কম্যুনিস্টের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে। অথচ, এই কম্যুনিস্টদের প্রায় সবাই জন্মসূত্রে ছিলেন সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কিন্তু মাথায় কম্যুনিজমের ভূতের আছর হওয়ার ফলেই সচ্ছলতার স্বর্গচ্যুতি ঘটল তাদের, শ্রেণিচ্যুত হয়ে তাদের অবস্থান নির্ধারিত হলো ‘সবার পিছে সবার নিচে সব-হারাদের মাঝে।’

সে-সময়ে এই কম্যুনিস্টদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে আমি লক্ষ্য করেছিলাম ও বুঝে নিয়েছিলাম : “... সমাজের বিরূপতা, রাষ্ট্রের উত্পীড়ন বা দারিদ্র্যের দংশন— কোনো কিছুই তাদের উঁচু মাথা নিচু করতে পারেনি, কিংবা নৈরাশ্যের অন্ধকূপে নিমজ্জিত করতে পারেনি। পুরাণে নীলকণ্ঠের কথা পড়েছি যিনি সমুদ্রমন্থনজাত বিষ নিজে পান করে পৃথিবীকে বিষমুক্ত করেছিলেন। আর বাস্তবে পাকিস্তানি জামানার কম্যুনিস্টদের দেখে আমার মনে হয়েছে যে, এরা পুরাণকারের কল্পনার নীলকণ্ঠকেও ম্লান করে দিয়েছেন।

কম্যুনিস্টদের অজস্র ভুলের কথা আমি জানি। সেই সব ভুলের কথা তুলে অন্য অনেকের মতো আমিও তাদের কম সমালোচনা করিনি। কিন্তু একান্ত কাছে থেকে যখন কম্যুনিস্টদের দেখলাম তখন বুঝলাম যে, ভুলত্রুটির চেয়ে এরা অনেক অনেক বড়ো। নেত্রকোনার একজন সুরসিক কম্যুনিস্ট ঠাট্টা করে বলতেন, ‘কম্যুনিস্ট কথাটার অর্থ জানো? কম+অনিষ্ট=কমানিস্ট। এ থেকেই হয়েছে ‘কম্যুনিস্ট’। অর্থাৎ যারা কম অনিষ্ট করে তারাই হচ্ছে কম্যুনিস্ট। অন্য সবাই সমাজের অনেক বেশি অনিষ্ট করে। সারা দুনিয়ায় কম্যুনিস্টরা যদি অনিষ্ট করেও থাকে, তবে করেছে খুব কম মানুষের।’

ঠাট্টা করে তিনি বোঝাতে চাইতেন যে, বুর্জোয়া রাজনীতিকরা শতকরা পাঁচ-দশজন বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়ার ইষ্ট করার লক্ষ্যে শতকরা নব্বইজন মানুষের অনিষ্ট করে। আর কম্যুনিস্টরা শতকরা নব্বইজন শোষিত-বঞ্চিত মানুষের ইষ্ট করতে চায় বলে দশজনের অনিষ্ট তাদের করতেই হয়। এ কাজ করতে গিয়ে তারা অনেক ‘ভুল’ করে বটে, কিন্তু ‘অন্যায়’ করে না। কম্যুনিস্ট মানেই সত্যিকারের ন্যায়নিষ্ঠ।”

উদ্ধৃতি-চিহ্নের ভিতরে রাখা কথাগুলো নিয়েছি আমারই নিজের লেখা বই ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন’ থেকে। কম্যুনিস্টদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের প্রতিক্রিয়া সেদিন যেভাবে ওই বইটিতে প্রকাশ করেছিলাম, এতদিন পরে অন্যতর ভাষায় তা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

সেই পঞ্চাশের দশকেই ময়মনসিংহ শহরে আনন্দমোহন কলেজে পড়ার সূত্রে একঝাঁক কম্যুনিস্টের সঙ্গে আমার পরিচয়। কম্যুনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। তবে নিষিদ্ধ হলেও কম্যুনিস্টরা তখন ‘ভূতলবাসী’ (আনন্ডারগ্রাউন্ড) নয়। খোলা আকাশের নিচে সামাজিক মানুষরূপে তাদের অবাধ বিচরণ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ই এ রকম বিচরণের সুযোগ তাদের করে দিয়েছে। সেই সুযোগই আমার জন্য কম্যুনিস্ট ও কম্যুনিজমকে জানার সুযোগ এনে দিল। কমরেড অজয় রায় আমার মতো আরও কয়েকজন ছাত্রকে কম্যুনিজমের দীক্ষা দিলেন। প্রয়াত কমরেড জ্যোতিষ বসু যুক্ত করে দিলেন সাংগঠনিক কাজকর্মের সঙ্গে।

সে সময়কার ময়মনসিংহের কম্যুনিস্টদের নীলকণ্ঠ রূপই শুধু প্রত্যক্ষ করিনি, তাদের আত্মসমালোচনামূলক বক্তব্য শুনে আমি অভিভূতও হয়ে পড়ি। মানুষ মাত্রই ভুল করে, কিন্তু মুক্তকণ্ঠে সেই ভুল স্বীকার করে প্রকৃত সত্যের পথ সন্ধান করতে পারে খুব কম মানুষই। কম্যুনিস্টরা যে সেই কম মানুষেরই অন্তর্ভুক্ত, সে সময়ে আমার সে-রকমই প্রতীতি জন্মেছিল। কারণ সেই পঞ্চাশের দশকেই ময়মনসিংহের কম্যুনিস্ট নেতারা নিকট অতীতে সংঘটিত অনেক ভুলের বয়ান আমার কাছে তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন : ছেচল্লিশ সনে কম্যুনিস্টরা যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিকে সংখ্যালঘুদের ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক অধিকার’ বলে মেনে নিয়েছিল, সেটি ছিল একান্তই ভ্রান্ত। এরপর পাকিস্তানোত্তরকালে সেই কম্যুনিস্টরাই ‘রনদিভে থিসিস’ গ্রহণ করে এবং ‘এ আজাদি ঝুটা হ্যায়’ আওয়াজ তুলে যে সব হঠকারী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল তার ফল হয়েছিল মারাত্মক। তবে অন্তত বায়ান্ন সাল থেকে কম্যুনিস্টরা যে ভ্রান্তির অপনোদন ঘটিয়ে সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে সাতান্ন সালে আমার মনে এ রকম ধারণা জন্মে যায়। সেই ধারণা থেকেই কম্যুনিস্ট পার্টির কাজকর্মের সঙ্গে আমি নিজেকে যুক্ত করে ফেলি। বেশ ভালোই চলছিল তখন।

কিন্তু সব ভালোর সমাপ্তি ঘটল পঞ্চাশের দশক শেষ হওয়ার আগেই। আটান্ন সনে জঙ্গবাহাদুর আইয়ুব খান যখন বন্দুকের জোরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে মার্শাল ল’ জারি করলেন, তখন সবই উলটপালট হয়ে গেল। মার্শাল ল’-এর তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় নেমে এলো কম্যুনিস্টদের ওপর। যে সব কম্যুনিস্ট তড়িঘড়ি করে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারলেন না তারা শুধু কারাবন্দীই হলেন না, তাদের অনেকেরই ভিটেবাড়ির অধিকারও হারাতে হলো, তাদের পরিবার-পরিজনের ওপর নেমে এলো সীমাহীন দুর্ভোগ।

তবে সেই দুর্ভোগ যে কেবল দুর্ভাগ্যেরই বাহন হয়েছে তা কিন্তু নয়। ষাটের দশকেই সৌভাগ্যের হাতছানিও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। জানতে পেরেছি যে : আইয়ুবী স্বৈরশাসনের তিন বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই, ১৯৬১ সালের শেষদিকে আওয়ামী লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি রূপে চারজন নেতা তিন-চারটি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ‘ইত্তেফাক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিঞা), আর কম্যুনিস্টদের পক্ষ থেকে মনি সিংহ ও খোকা রায়। আইয়ুব শাহীকে হঠানোর প্রক্রিয়া-সন্ধানই ছিল বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য।

বৈঠকের বিবরণ দিতে গিয়ে কমরেড খোকা রায় জানিয়েছেন : “আন্দোলনের দাবি নিয়ে আলোচনার সময় শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছিলেন যে, পাঞ্জাবের ‘বিগ বিজনেস’ যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ‘ওদের সাথে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে’, ইত্যাদি।

তখন আমরা (আমি ও মনিদা) শেখ মুজিবকে বুঝিয়েছিলাম যে, কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করে কিন্তু সে দাবি নিয়ে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিস্থিতি তখনো ছিল না।

‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ দাবি নিয়ে ওইসব আলোচনার পরের বৈঠকে শেখ মুজিব আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘ভাই এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও (অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই এখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল’ ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সন থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন।

পরপর ৩-৪টি বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতৃদ্বয়ের সাথে আমাদের বিশদ আলোচনার পর উভয়ের ঐকমত্যে সামরিক শাসনের অবসান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সমস্ত রাজবন্দির মুক্তি, ২১ দফা কর্মসূচি মোতাবেক পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের জরুরি দাবি-দাওয়া পূরণ প্রভৃতি দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে এক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। ওইসব দাবির ভিত্তিতে ১৯৬২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভিতর থেকে আন্দোলন শুরু করার জন্য চেষ্টা করার সিদ্ধান্তও হয়েছিল।”

সেই সিদ্ধান্তের সুফল ফললো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। বাষট্টির একুশে ফেব্রুয়ারির একুশ দিন আগেই শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ছাত্র-আন্দোলন। সে আন্দোলনের প্রত্যক্ষ হেতু ছিল জঙ্গি আইয়ুব শাহীর হাতে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদ।

খোকা রায়ের ‘সংগ্রামের তিন দশক’ বইটিতে ১৯৩৮ থেকে ১৯৬৮ সন পর্যন্ত এ দেশের কম্যুনিস্ট আন্দোলনের বিবরণ অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এই বিবরণের ভিতরে ধরা পড়েছে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনের বিরুদ্ধে সে-সময়কার গণমানুষের সংগ্রামের ইতিহাসও। সেই সঙ্গেই এ-বইয়ে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। রুশ-চীন বিরোধের মধ্য দিয়েই সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশের কম্যুনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি ঘটে যায়। সেই বিভক্তির ফল মোটেই শুভ হয়নি।

সে-সময়েই আমি কয়েকবার আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যুনিস্ট নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে মিলিত হই। সেসব বৈঠকে অনেক তর্ক-বিতর্কের পর মোটামুটিভাবে ‘মস্কোপন্থি’দের অভিমতকেই আমার কাছে সঠিক বলে মনে হয়। পার্টির গোপন মুখপত্র ‘শিখা’ পাঠেরও সুযোগ পেয়ে যাই। ‘শিখা’ পাঠ করেই পার্টির তথা এ দেশের বামপন্থি ও প্রগতিশীল শক্তির ভিতরকার মতবিরোধের বিষয়গুলো সম্পর্কেও অবহিত হই। সে-রকম অবহিতির ফলেই আমি ধারণা করে নিয়েছি যে, তথাকথিত মস্কোপন্থি কম্যুনিস্টরা ‘আওয়ামী লীগের লেজুড়’ রূপে নিন্দিত হয়েও খুব একটা ভুল করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই কম্যুনিস্টদের অবদানকে যারা অস্বীকার করে, তারা মোটেই সত্যসন্ধ নয়। ১৯৭৫-এর সেই একান্ত মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়া পর্যন্ত এই কম্যুনিস্টরা যেসব ভাবনা ভেবেছে ও কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে, সে-সবের ভিতর অনেক ভুল-ত্রুটি ও ব্যর্থতা থাকলেও অন্যতর কিছু করার খুব বেশি সুযোগ তখন ছিল না বলেই আমি মনে করি।

বঙ্গবন্ধু নিহত হন পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। এর আগে পঁচিশে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রবর্তনাতেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় একদলীয় শাসনব্যবস্থা। ‘বাকশাল’ নামে পরিচিত ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠার আগে আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থি ন্যাপ ও কম্যুনিস্ট পার্টি— এই দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’। এই ঐক্যজোটে থেকে কম্যুনিস্টরা উৎসাহের সঙ্গে কাজ করতে চাইলেও, তাদের সেই উৎসাহের আগুনে আওয়ামী লীগই জল ঢেলে দিয়েছে। ত্রিদলীয় ঐক্যজোট প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো কাজই করতে পারেনি।

এরপর বঙ্গবন্ধু যখন সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হলেন, তখনো কমরেড মনি সিংহসহ কম্যুনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতারা ঐক্যজোটকে কার্যকর করে তোলার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে প্রণোদিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে চেষ্টাও সফল হয়নি। ‘বাকশাল’ গঠিত হয়ে গেল।

বাকশালে যোগদান করা না করা নিয়ে কম্যুনিস্টদের ভিতর বিভিন্নমুখী চিন্তাভাবনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই, কম্যুনিস্ট পার্টি বাকশালের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা ও ফলাফল নিয়ে যথাযথ বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা হয়নি। হওয়া উচিত ছিল। তবে, বাকশালের কর্মসূচি কার্যকর হলে তার কী ফল ফলতো তা দেখার সুযোগই তো দেশবাসী পায়নি। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার দেশি-বিদেশি দুশমনরা দেশটিকে উল্টোপথে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ অবারিত করে দেয়। এই দুশমনরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই ‘আওয়ামী-বাকশালী’ অপবাদ দিয়ে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক মানুষকে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয়। আমার মতো চুনোপুঁটিকেও জেলে আটকে রাখে আঠার মাস। জেলখানায় বিভিন্ন দলের অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গেই আলাপ-আলোচনা হয়েছে। দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করারও সুযোগ পেয়েছি।

যদিও আমি কোনো দিনই ‘পলিটিক্যাল একটিভিস্ট’ ছিলাম না, তবু জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে তো আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যই বানিয়ে ফেলা হয়। আশির দশকের মধ্য পর্ব থেকে নব্বই দশকের শুরু— এই কয় বছর বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রূপে আমি এমন কিছু বিষয় প্রত্যক্ষ করেছি, এর আগে যা ছিল আমার চিন্তারও অগোচর। পার্টির নেতাদের সম্পর্কে আমার ছিল খুবই উচ্চ ধারণা। আমি ভাবতাম : পার্টির উচ্চপদে অধিষ্ঠিত নেতাদের সবাই গুণে-মানে অনেক উন্নত, কম্যুনিজমের দর্শন তাদের সবারই অধিগত, সেই দর্শনের ধারকরূপেই তারা হয়েছেন কম্যুনিস্ট, কোনো ঝঞ্ঝা-বাত্যাই তাদের নিষ্ঠাকে বিচলিত করতে পারবে না।

আসলে আমার এরকম ভাবনায় মস্ত একটা ফাঁক ছিল। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমার প্রথম যৌবনে দেখা ‘নীলকণ্ঠ’ কম্যুনিস্টদের প্রায় সবাই জীবনমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছেন, যারা জীবিত আছেন তারা বয়সের ভারে ন্যুব্জ, বয়োকনিষ্ঠরাই এখন পার্টির নেতা। বয়োকনিষ্ঠ এই নেতাদের অধিকাংশই বিদ্যায়তনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত হলেও কম্যুনিজমের দর্শন ও পার্টির ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের জ্ঞান যে একান্তই সীমিত— এ বিষয়টি সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হওয়ার আগে আমি বুঝে উঠতে পারিনি। বিশেষ করে নব্বই দশকের গোড়ায় যখন সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে গেল এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে ঘটে গেল অচিন্তিতপূর্ব বিপর্যয়, তখনই থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়ল।

সে সময়কার সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক সদস্যের মুখেই অনেক দুর্বচন শুনতে হলো। শুধু তরুণ সদস্যদের মুখেই নয়, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন যিনি, তেমন প্রবীণ কম্যুনিস্ট নেতাও সেদিন সখেদে বলে চললেন, ‘সারাজীবন একটা মোহের পেছনেই ছুটে গেলাম আমরা।... এখন বুঝলাম, বিপ্লব-টিপ্লবের স্বপ্ন দেখে জীবনটার অপচয় করেছি কেবল... দেশের জন্য মানুষের জন্য কিছুই করতে পারলাম না...’

দুদিন আগেও যারা ‘মুমূর্ষ পুঁজিবাদ’ ও ‘জঘন্য সাম্রাজ্যবাদ’-এর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণাব্যক্তক বাক্যাবলি উচ্চারণ করে চলছিলেন, এমন কিছু নেতার কণ্ঠেই দুদিনের ব্যবধানে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা ধ্বনিত হতে লাগল। যাতে বলা হয়, ‘অক্টোবর বিপ্লব’ তাতে বিপ্লবের ছিটেফোঁটাও ছিল না, ওটা ছিল একটি ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থান মাত্র, এরকম কথা যখন কম্যুনিস্ট পার্টিরই কোনো কেন্দ্রীয় নেতার মুখে শুনতে পেলাম, তখন নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

তবে একটু ধাতস্থ হয়েই বুঝে নিলাম যে, এমনটি হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এরকম আকস্মিক বিপর্যয় ঘটে গিয়ে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা তো ছিল একেবারেই অচিন্ত্যনীয়। সেরকম অঘটনের ধাক্কায় সারা দুনিয়াই যখন কম্পমান, তখন বাংলাদেশের কম্যুনিস্টদেরও ভাব-ভাবনায় যে লাগবে ভাটার টান, আশাভঙ্গের বেদনায় তাদের ভাষাও যে হয়ে পড়বে পারম্পর্যহীন, তাতে বিস্ময়ের কী আছে? তাই দেখলাম : সে সময়কার সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সাতাত্তর জন সদস্যের তেষট্টিজনই পার্টি পরিত্যাগ করে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়লেন। তবে স্বস্তির বিষয় এই, এঁদের কারও কারও চূড়ান্ত অধঃপতন ঘটলেও, অনেকেই কম্যুনিস্ট নৈতিকতাকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে পেরেছেন এবং জনমনে শ্রদ্ধাস্পদ হয়ে আছেন। থাকবেনও।

হতাশা সাময়িক, আশা চিরকালীন। আশার আলো জ্বলতেই থাকবে।

 লেখক : শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর