শনিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম

রোবায়েত ফেরদৌস

গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম

‘ভক্স পপুলি ভক্স ডাই’

(জনগণের কণ্ঠস্বরই ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর)

— ল্যাটিন প্রবাদ

জ্যামিতির মতো গণতন্ত্রেরও সহজ সড়ক নেই; গণতন্ত্রের পথে কোনো রাষ্ট্রের পথচলা কখনোই একরৈখিক নয়, সবসময়ই তা আঁকাবাকা—দুস্তর আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ; এ এক দীর্ঘ আর কষ্টকর ভ্রমণ—যার পথে পথে পাথর ছড়ানো। গণতন্ত্রের আত্মম্ভর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে রাষ্ট্রকে দু পা সামনে তো এক পা পেছনে চলতে হয়। অগণতান্ত্রিক, প্রাচীন, সামন্ত বা সামরিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পেছনে মাড়িয়ে রাষ্ট্রকে আয়েশসাধ্য ভ্রমণে নামতে হয়—লক্ষ্য গণতন্ত্রে নোঙর গাড়া। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের উপস্থিতি, সুষ্ঠু নির্বাচন, আইনের শাসন, স্বচ্ছতা, সাংবিধানিক চর্চার ধারাবাহিকতা, জবাবদিহিতা, চিন্তার বহুত্ববাদিতা—যা গণতন্ত্রের অন্যতম নিদান—একটি রাষ্ট্রে তার সঠিক চর্চা নিশ্চিত করা মোটেই সহজ কোনো বিষয় নয়। গণতন্ত্রেরই আরেক অনুষঙ্গ মত প্রকাশের স্বাধীনতার, বলা হয় গণতন্ত্রেরে জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অপরিহার্য। কেন বলা হয়? গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের পারস্পরিক সম্পর্ক ঠিক কোথায়? গণমাধ্যম কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, না গণতন্ত্রই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে? গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে অনুসরণ করে না নেতৃত্ব দেয়? আবার এ প্রশ্নও তো বেশ যুৎসই যে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আসলে কী? কিংবা একটি রাষ্ট্র কতটুকু গণতান্ত্রিক তাই-বা মাপা হবে কোন গজকাঠিতে? গণমাধ্যমের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়টি গেল ২০০ বছর ধরে আলোচনা-সমালোচনা-পর্যালোচনায় এলেও ধারণা-নিশ্চয় এখনও বেশ গোলমেলে। একেক গোষ্ঠী-সরকার, সাংবাদিক, আইনজ্ঞ আর রাজনীতিকগণ নিজ নিজ কাঠামোয় ফেলে এর ব্যাখ্যা-বয়ানের চেষ্টা করেছেন। রাষ্ট্র একভাবে আবার এর নাগরিকরা অন্যভাবে বিষয়টিকে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। উদারপন্থি আর রক্ষণশীলদের মধ্যেও এ নিয়ে মতবিরোধ আছে। বিরোধ আছে অ্যাকাডেমিশিয়ান আর প্র্যাকটিশনারদের মাঝেও।

প্রতীতি বলে, গণমাধ্যমের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক বিচারে রাষ্ট্রীয় চরিত্র, গণমাধ্যমের মতাদর্শ ও মালিকানার কাঠামো বিশ্লেষণ জরুরি। রাষ্ট্র যদি সামরিক হয় তবে গণমাধ্যম চাইলেও মুক্ত চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে পারবে না। যেমনটি আমরা এরশাদের সামরিক শাসনামলে সাংবাদিক নির্যাতন বা বিরোধী চিন্তার পত্রিকা বন্ধের মধ্যে পরখ করেছি। ৫০/৬০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার সামরিক সরকারগুলোর এরকম চর্চার কথা আমরা জানি। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যম তখন ব্যবহূত হয়েছে সামরিক/স্বৈরশাসকের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচারযন্ত্র হিসেবে। আবার চীন বা উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্র, যেখানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বর্তমান—গণমাধ্যম সেখানে তীব্র নিয়ন্ত্রণে আছে; যেমনটি আমরা বাকশালের সময় বাংলাদেশেও লক্ষ করেছি—চারটি রেখে বাকি সংবাদপত্র তখন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরে থেকেও মতাদর্শগত কারণে গণমাধ্যম অগণতান্ত্রিক চিন্তার বিকাশকে উৎসাহিত করতে পারে। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর মালিকানায় যে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা পায় তা কিন্তু নারীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, নির্বাচন, ধর্মীয় সমালোচনা কিংবা বহু ধর্মের চর্চার মতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কাজেই বিষয়টি সরল না যে গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে সংহত করে, অনেক সময় গণমাধ্যম গণতন্ত্রকে নস্যাৎও করে। এটাই এক প্যারাডক্স যে, গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে কেউ খোদ গণতন্ত্রকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তবে যা নিয়ে তর্ক নেই তাহলো কোনো রাষ্ট্র যদি নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করে তবে সেখানে গণমাধ্যমের একশভাগ স্বাধীনতা থাকতেই হবে; এতে আরেকটি প্যারাডক্স জন্ম নেয়— যে গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করবে, যে সাংবাদিক সরকারের ভুলচুক নিয়ে নিয়ত রিপোর্ট করবে, সেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বা সেই সাংবাদিকের নিরাপত্তা আবার সেই সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। অনেকটা সংসদে বিরোধী দলের অবস্থানের মতো, তারা সংসদে সরকারের কাজের সমালোচনা বা বিরোধিতা করবে, তারা যেন সংসদে তা সুষ্ঠুভাবে করতে পারে, সেই সুযোগ সরকারি দলকেই নিশ্চিত করতে হবে। ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি কিন্তু তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’—ভলতেয়ারের এ উক্তিই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌল চেতনা; এ চেতনা আর এর চর্চার ভিতরেই লুক্কায়িত থাকে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা।   

তো গণতন্ত্রের পথচলায় গণমাধ্যম কী করতে পারে? গণমাধ্যম নাগরিকদের বহুমুখীন যোগাযোগের পাটাতনটি তৈরি করে দেয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানে যেহেতু খোলা সমাজ, তাই মানুষকে এখানে বহু স্তরে বহু পর্যায়ে বহু ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে হয়। গণমাধ্যম মানুষের জন্য তথ্যের বৃহত্তর প্রবেশগম্যতা তৈরি হয়। সরকারকে চোখে চোখে রাখার মধ্য দিয়ে ‘গণতন্ত্রের প্রহরী’র ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যম পাবলিক ডিবেট উসকে দেয়, পলিসি এজেন্ডা নির্ধারণ করে, নাগরিক মতামতের ফোরাম তৈরি করে—যেখানে জনগণ রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। দুর্নীতির ওপর সার্চলাইট ফেলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাজে স্বচ্ছতা নির্মাণ করে। অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন—রাষ্ট্রে গণমাধ্যম স্বাধীন হলে এমনকি ঠেকিয়ে দেওয়া যায় দুর্ভিক্ষও।  অজ্ঞতা ও ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি না করে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞাত হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে—সচেতন ভোটাররা তখন খারাপ শাসককে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে পারে। গণমাধ্যম প্রতিনিয়ত জনপরিসর বাড়িয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে সেতু গড়ে। প্রতিদিনের রাজনৈতিক ইস্যু/বিতর্ক তুলে ধরে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতি মনিটর করে। বহু স্বার্থ বহু কণ্ঠস্বর তুলে ধরে। সরকারের কাজের রেকর্ড, তাদের মিশন-ভিশন, নেতাদের পারঙ্গমতা তুলে ধরে। শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণকে সম্ভব করে তোলে।

ডিসকোর্স হিসেবে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ নিয়ে কথা পাড়লেই কয়েকটি বিষয় হাত ধরাধরি করে ওঠে আসে; এবং বলাবাহুল্য যে ওঠে আসা বিষয়গুলো পরস্পর আন্তঃসম্পর্কিত। মোটা দাগে, আমার বিবেচনায়, বিষয়গুলো হলো এক. রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুযোগের বণ্টনব্যবস্থা—যার ওপর নির্ভর করে একটি রাষ্ট্রে ব্যক্তিমানুষের ক্রয়ক্ষমতা, দুই. রাষ্ট্রে ভাব বা মত প্রকাশের সুযোগ ও স্বাধীনতা কতটা চর্চিত হয় তার সামাজিক প্রকৃতি ও আইনি কাঠামো, তিন. শিক্ষিতের হার, চার. তথ্য উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণের প্রবেশাধিকারের মাত্রা, পাঁচ. জনগণের রাজনৈতিক চেতনা ও সাংস্কৃতিক মান ইত্যাদি। স্পষ্ট করে বললে বিশ শতকের আগে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল আন্দোলন বা অধিকার হিসেবে ‘স্বীকৃতি আদায়ের’ বিষয়। কারণ চরিত্রগত দিক দিয়ে রাষ্ট্র তখন স্বৈরতান্ত্রিক ছিল। জনসমক্ষে নিজের মতামত মুক্তভাবে প্রকাশ করাটাই তখন মুখ্য ছিল। এর একটি দার্শনিক ভিত্তিও রয়েছে। জন মিল্টন থেকে লক কিংবা ম্যাডিসন থেকে স্টুয়ার্ট মিল বাক স্বাধীনতার পক্ষে বিস্তর যুক্তির বিস্তার ঘটিয়েছেন। যে কারণে মত বা ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সেই সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশরাজের সঙ্গে লড়াইয়ে মেতে উঠেছিলেন ইংরেজ কবি মিল্টন। কবি চেয়েছিলেন বিবেকের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বায়ত্তশাসন। অ্যারিওপ্যাজিটিকায় তার উচ্চারণ ছিল এ রকম : দাও আমায়, জ্ঞানের স্বাধীনতা দাও, কথা কইবার স্বাধীনতা দাও, মুক্তভাবে বিতর্ক করার স্বাধীনতা দাও। সবার উপরে আমাকে দাও মুক্তি। কিন্তু দুঃখজনক যে কবি-কাঙ্ক্ষিত বিবেকের মুক্তি এবং শর্তহীন বাক-স্বাধীনতার বিষয়টি আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। তবে জরুরি যে প্রশ্নটি থেকে যায়, তা হলো—এই যে স্বাধীনতা চাওয়া হয়েছিল, সেটা কার কাছ থেকে? স্বাধীনতা চাওয়া হয়েছিল চার্চ ও রাষ্ট্র থেকে—কারণ ক্ষমতার বিলিবণ্টন তখন এ দুটো প্রতিষ্ঠানই করত; এ ক্ষমতাকেন্দ্র দুটো তখন সমার্থক ছিল। তারাই সব নিয়ন্ত্রণ করত—দেহ, দেহের খোরাক এবং আত্মাও। আঠারো শতকের শেষ পাদে পশ্চিমের প্রেক্ষাপটে ভাব প্রকাশ বা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সংবাদপত্র একটি বড় ভূমিকা রাখে। সংবাদপত্রের মধ্য দিয়ে তখন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধর্মীয় বা মতাদর্শগত বিতর্ক তোলার ক্ষেত্রটি তৈরি হয়। মিডিয়া ফিলসফার য়ুর্গেন হেবারমাস তার জনপরিসর তত্ত্বে এ বিষয়ে একটি জরুরি তর্ক তোলার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাস ঘেঁটে তিনি আমাদের জানিয়েছেন যে, আঠারো শতকে ইউরোপে সেলুন ও কফি হাউসে নিয়মিত আড্ডা হতো, যেখানে সমবেতরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে মুক্ত আলোচনা করতেন কিংবা জম্পেশ বিতর্কে মেতে উঠতেন। এখানে সংবাদপত্র ও জার্নাল পড়া হতো—আড্ডার এজেন্ডা নির্ধারণে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। বাধাহীনভাবে সমাজের তাবৎ বিষয় নিয়ে মুখোমুখি কথা বলার ক্ষেত্রে, হেবারমাসের ভাষায়, এসব স্পেস ছিল আদর্শ ফোরাম, যাকে তিনি বলেছেন ‘বুর্জোয়া জনপরিসর’। এ ধরনের জনপরিসর চার্চ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল, নীতিগতভাবে এখানে প্রবেশাধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এসব জায়গা এমনকি অভিজাত সম্প্র্রদায়ের সঙ্গে ব্যবসায়ী শ্রেণির সম্পর্ক পাল্টে দিতেও ভূমিকা রেখেছে। হেবারমাসের ধারণা, আঠারো শতকে সংবাদপত্র ও সাময়িকী ‘জনপরিসর’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু পরে, হেবারমাস আক্ষেপ করেন, সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলো বিজ্ঞাপন ও পণ্যবাণিজ্যের খপ্পরে পড়ে যায়; গণভোক্তা ও গণবণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলে; ফলে জনগণের স্বার্থে সমাজের সত্যিকার ইস্যু নিয়ে আলোচনার এজেন্ডা জোগাতে ব্যর্থ হয়; তারা বরং যে কোনো প্রকারে কাটতি বাড়ানোর দিকে ঝুঁকে যায় এবং তাদের আধেয় নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞাপনদাতা ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ভূমিকা রাখতে থাকে। এভাবে জনপরিসর সংকুচিত হতে থাকে।

তবে গণতন্ত্র যে গণমাধ্যম বিকাশে সহায়ক তার প্রমাণ নব্বইয়ের পরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশ। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে, ধরে নেওয়া হয়, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে থাকে এবং তখন থেকেই সংখ্যার দিক থেকে গণমাধ্যমের বিস্ফোরণ শুরু হয়। সামরিক শাসনের বিদায়, গণতান্ত্রিক সরকারের দেশ পরিচালনা, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে বিরাষ্ট্রীয়করণকে স্বাগত জানানো এবং রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক প্রেস ও পাবলিকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৩ সংশোধীনই এর প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি। ডিএফপির ১৯৯৩ সালের উপাত্তে দেখা যায় ওই সময় ডিএফপির তালিকায় সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৩২৫টি! ১৯৯৮ সালে এ সংখ্যা ৯০৮-এ নেমে আসে এবং ২০০১-এ আবার বেড়ে হয় ৯৯০। লক্ষণীয় যে, বর্তমানে দেশে বেশি প্রচারসংখ্যার বেশিরভাগ সংবাদপত্রই নব্বইয়ের দশক এবং এর পরে প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রের সর্বত্র বাজার উদারীকরণের বিষয়টি গতিপ্রাপ্ত হলে গণমাধ্যমও এ দৌড় থেকে পিছিয়ে থাকে না। আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র দৈনিক বাংলা বন্ধ করে দেয় এবং সমায়িকী বিচিত্রা ব্যক্তিমালকানায় ছেড়ে দেয়। এরপর দেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কেবল দুটি গণমাধ্যম টিকে থাকে— বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। যদিও নব্বইয়ের আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখায় রাষ্ট্রীয় এ দুটো গণমাধ্যমের স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীকালে নির্বাচিত কোনো সরকারই জনগণের এ দাবির প্রতি সম্মান দেখাননি। রাষ্ট্রীয় এ দুটো মাধ্যম এখনো দলীয় আদর্শ প্রচারের যন্ত্র হিসেবেই কাজ করে চলেছে; এখানে সংবাদমূল্যের চেয়ে প্রটোকল মূল্যই বেশি প্রাধান্য পায়। বিবিসি বা জাপানের এনএইচকের আদলে ‘পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’ (পিবিএস) হিসেবে গড়ে তোলার কোনো চেষ্টাই আমরা আর দেখি না। এবং যে কারণে জনগণের কাছে এ দুটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ/মতামতের বিশ্বাসযোগ্যতা সব সময়ই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাচ্ছে।

সরকারের বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতি প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিকাশেও বিরাট ভূমিকা পালন করে। ১৯৯০ সালের আগে দেশে কোনো বেসরকারি টিভি চ্যানেল ছিল না। ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্ত, স্বাধীন জাতীয় গণমাধ্যম বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কথা বলে। ১৯৯৯-এর শেষে ব্যক্তিমালিকানা পর্যায়ে প্রথম টিরেস্ট্রিয়াল টিভি একুশে টিভি চালু হয়। বেতার প্রসঙ্গে বলা যায়, ১৯৯০-এর আগে বাংলাদেশ বেতার ছাড়া অন্য কোনো রেডিও স্টেশন ছিল না; ১৯৯৯-এর মাঝামাঝিতে রেডিও মেট্রোওয়েভ নামে প্রথম বেসরকারি রেডিও চালু হয়। ২০০৫-এ আরও কয়েকটিকে এফএম রেডিও হিসেবে চালুর অনুমতি পায়- রেডিও টু ডে, রেডিও ফুর্তি, রেডিও আমার; এরও পরে যোগ হয় এবিসি রেডিও। তরুণ ও শহুরের শ্রোতাদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।

আমরা বলেছি বটে ১৯৯০-এর পরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশ হয়েছে, তবে বলতে দ্বিধা নেই সাংবাদিকতার মানের বিচারে এ বিকাশ যতটা পরিমাণগত দিক দিয়ে হয়েছে, গুণগত বিচারে ঠিক ততট হয়নি। ২০০৫ সালে সাংবাদিক টীপু সুলতান কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)-এর পুরস্কার জিতে বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন। টীপু পুরস্কার পেয়েছিলেন নির্যাতনের জন্য, গুণগত রিপোর্টের জন্য নয়—ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর ক্যাডাররা তাকে পিটিয়ে পঙ্গু বানিয়ে দিয়েছিল। পুরস্কার সম্মানের কিন্তু মার খাওয়ার জন্য না পেয়ে বিশ্বমানের কোনো রিপোর্টের জন্য পেলে তা হতো আরও সম্মানের; শুধু তো টীপু নয়, ১৯৯০-এর পরে মিডিয়া বেড়েছে, সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে সাংবাদিকের ওপর হুমকি-ধমকি-নির্যাতনও বেড়েছে। সাংবাদিকতার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ১৯৯৬ সালে সাতক্ষীরার এসএম আলাউদ্দিন, ১৯৯৮ সালে দৈনিক রানারের সাইফুল আলম মুকুল, ২০০০ সালে জনকণ্ঠের সামশুর রহমান, ২০০৪ সালে সমকালের গৌতম দাস, ২০০৫ সালে দৈনিক সংবাদের মানিক সাহা ও দৈনিক জন্মভূমির হুমায়ূন কবির বালু নিহত হন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার কিংবা গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত ট্রেনকে আবারও লাইনে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিদার তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সময় প্রবীর শিকদার, সেলিম সামাদ, তাসনিম খলিল, আসাদুজ্জামান টিপু, জাহাঙ্গীর আলম আকাশসহ বহু সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাংবাদিকের ওপর এসব নির্যাতন কখনো হয়েছে প্রত্যক্ষ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা, কখনো ব্যবসায়ী, কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী, পুলিশ বাহিনী বা চরমপন্থি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দ্বারা। নির্যাতনের বাইরে বিভিন্ন সময়ে সরকারের রোষানলের কারণে সংবাদপত্র/টিভিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইটিভি, সিএসবি কিংবা আমার দেশ ও চ্যানেল ওয়ান। এতে বিপুলসংখ্যক সাংবাদিককে রাতারাতি বেকার বনে যেতে হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে তাদের চাকরি নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের প্রায়শই মালিকের ব্যবসায়িক আর সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ-দ্বন্দ্বের মাঝপথে পড়তে হচ্ছে এবং নিয়ত জীবন ও জীবিকার লড়াইটি চালিয়ে যেতে হচ্ছে।  

গণতন্ত্র/গণমাধ্যমের আন্তঃসম্পর্কের এ আলোচনায় গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতি তথা মালিকানার কাঠামোটি খেয়ালে রাখা দরকার; বাংলাদেশে  গেল দুই দশকে গণমাধ্যমের মালিকানার ধরন কিন্তু পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন আর কোনো ব্যক্তি বা একক সংস্থা নয়, রেডিও টিভি বা সংবাদপত্রের মালিক হচ্ছেন কোনো দলীয় ক্যাডার, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী বা  গ্রুপ অব কোম্পানিজ। পশ্চিমের মতো একই হাউস থেকে দৈনিক, সাপ্তাহিক আর টিভি চ্যানেল হচ্ছে। ‘মহান’ পেশায় অবদান রাখা বা সমাজ উন্নয়নের চিন্তা নয় বরং মুনাফা অর্জন, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ কিংবা বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এখন কাগজ বেরুচ্ছে, টিভির চ্যানেল গজাচ্ছে। গণমাধ্যম নিজেই পরিণত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিতে। তবে যে বিষয়টি দুঃখজনক তাহলো- আমরা দেখছি, মিডিয়ার মালিকানা চলে যাচ্ছে মাস্তান, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক আর দুষ্ট লোকদের হাতে। ‘নষ্ট’ রাজনীতিক আর ‘দুষ্ট’ ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়িক আর রাজনৈতিক স্বার্থে সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলের মালিক হচ্ছেন। আমরা বলেছি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মিডিয়ার কাজ সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চোখে চোখে রাখা, তাদের ভুলচুক-ত্রুটিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। মানুষ প্রত্যাশা করে সরকারি, বেসরকারি, বহুজাতিক বা ব্যক্তিমালিকাধীন প্রতিষ্ঠান— যাদের কাজের সঙ্গে জনগণের স্বার্থ জড়িত গণমাধ্যম তাদের কাজের ওপর নজরদারি রাখবে, জনবিরোধী বা কোনো অন্যায়- অনিয়ম দুর্নীতি হলে সেসবের সমালোচনা করবে। মিডিয়াকে তাই ‘আই অন গভর্নমেন্ট’ বলে। কিন্তু বাংলাদেশে মিডিয়ার মালিকদের এই যদি হয় অবস্থা, তারা  নিজেরাই যদি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকেন, তাহলে কী করে তারা অন্যের কাজের সমালোচনা করবেন। মহাভূত সে তো শর্ষের ভিতরেই। যে মিডিয়ার মালিক নিজেই গডফাদার সেজে বসে আছে, সরকার বা অন্যের কাজের সমালোচনা করার নৈতিক অধিকার তো সেই মিডিয়ার থাকে না। বাংলাদেশে রাজনীতি যেমন পচে গেছে, মিডিয়াও তেমনি পচে যাচ্ছে। রাজনীতির মতো, মিডিয়ার মালিকানাতেও তাই গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। কালো টাকার মালিক, নষ্ট ব্যবসায়ী আর দুষ্ট রাজনীতিকদের খপ্পর থেকে মিডিয়াকে বাঁচাতে হবে।

২০০৮ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি থেকে রেহাই পেতে, তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক-সামরিক কোয়ালিশন সরকারের শ্বাস-বন্ধ-করা-গুমোট অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মানুষ ভোট বিপ্লব ঘটায় এবং বিপুল সমর্থন দিয়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় হাজির করে। আশা ছিল দেশে মুক্তচিন্তার পরিবেশটি তার কাঙ্ক্ষিত পরিসর খুঁজে পাবে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় সাংবাদিকদের ওপর যে হামলা-মামলা হত্যা-নির্যাতন হয়েছে তার অবসান হবে, তত্ত্বাবধায়ক-সামরিক কোয়ালিশন সরকারের জরুরি অবস্থার সময় সংবাদপত্র ও টিভি তথা মত প্রকাশ ও প্রেসের স্বাধীনতাকে যেভাবে কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল তা থেকে জাতির উত্তরণ ঘটবে। কিন্তু সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনে সংসদ সদস্যরা পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এবং সংসদে সম্পাদকদের তলব করার দাবি জানিয়েছেন। আইনপ্রণেতারা জাতীয় সংসদে যে ঢালাও অভিযোগ এনেছেন তা সংবাদমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের প্রতি হুমকি ছাড়া কিছু নয়। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা পরস্পরের পরিপূরক, বিপরীতমুখী নয়। টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কোনো অবস্থায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা যাবে না। আবার সংবাদমাধ্যমকেও তার বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা বজায় রাখতে হবে। আমরা মনে করি, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাকে বৈরী হিসেবে দেখা ঠিক নয়। গণতন্ত্রের বিকাশে ভিন্নমত পোষণের পূর্ণ সুযোগ থাকতে হবে। সংবাদমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ না ভেবে সংসদ সদস্যরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন— সেটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে। চ্যানেল ওয়ান বন্ধের যে সিদ্ধান্ত বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার নেয় তা আমাদের যারপরনাই হতাশ করেছে। চারটি কাগজ/তিনটি চ্যানেল সরকারের সমালোচনা করলে কী এমন ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়? গণতন্ত্রের জন্য সমালোচনা সব সময় সহায়ক— সরকারের মনোজগতে এ সংস্কৃতিকে ঠাঁই দিতে হবে। তবে মনে রাখা দরকার, প্রেসের স্বাধীনতা মানে হাত-পা খুলে যা খুশি রিপোর্ট করা নয়, প্রকাশিত রিপোর্টকে অবশ্যই সত্য, যথার্থ আর পক্ষপাতহীন হতে হবে। অনেস্টি, অ্যাকিউরেসি আর ফেয়ারনেস হচ্ছে সাংবাদিকতার মৌল তিন নীতি— যার ওপর দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতার স্বাধীনতার চর্চাটি হয়ে থাকে। তাই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জারি রাখার জন্য যেমন সদা সোচ্চার থাকতে হবে তেমনি দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার পথে আমাদের আরও অনেক দূর অবধি যেতে হবে; যেতে হবে গণতন্ত্রকে সতেজ টাটকা আর ফুরফুরে রাখার তাগিদে।

 

লেখক : অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর