শুক্রবার, ৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণ

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেন। বাজেট উপস্থাপনকালে তিনি যে বাজেট ভাষণ দেন এখানে তার পূর্ণ বিবরণ দেওয়া হলো

সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণ

বিস্মিল্লাহির রহমানির রহিম

তাবারাকাল্লাজি বিয়াদিহিল মুল্ক ওয়া হুয়া আলা কুল্লি সাইয়্যিন ক্বাদির

মাননীয় স্পিকার

০১। আপনার সানুগ্রহ অনুমতিক্রমে আমি আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থমন্ত্রী ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট এই মহান সংসদে উপস্থাপন করছি।

মাননীয় স্পিকার

০২। যে নামের ওপর দুলছে বাঙালির বিজয়ের পতাকা, দুলতে থাকবে অবিরাম; যাঁর নামের প্রতিটি অক্ষরই আমাদের স্বাধীনতা, দুর্মর ভেঙে ফেলা শত শৃঙ্খল; বক্তব্যের শুরুতে আমি গভীর ভক্তি ও বিনম্র শ্রদ্ধায় তাঁকে স্মরণ করছি যিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় হিজল তমালের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন, বাঙালির মানসলোকে স্বাধীনতার বাসনা সঞ্চারক, বাঙালির বরপুত্র, সোনার বাংলার স্বপ্নচারী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মৃত্যুঞ্জয়ী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

০৩। আমি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি শহীদ বঙ্গমাতাসহ জাতির জন্য কলঙ্কময় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রির সকল শহীদদেরকে। স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুুর সুযোগ্য সহকর্মী কেন্দ্রীয় জেলখানায় শহীদ জাতীয় চার নেতাকে। গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সাথে আরো স্মরণ করছি, আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, যাঁদের চরম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন, সেই সকল নিঃশঙ্ক বীর সন্তানদের। আমি স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ত্রিশ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সম্ভ্রম হারানো ২ লাখ মা বোনকে। আমি স্মরণ করছি, কভিড-১৯ মহামারীর কারণে আমরা যাদেরকে অকালে হারিয়েছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর কাছে আমি সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

দ্বিতীয় অধ্যায়

মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থনীতির এলাকায় বাংলাদেশের অবস্থান

মাননীয় স্পিকার

০৪। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বুধবার সন্ধ্যা ৮ ঘটিকা। দিকে দিকে শোনা যাচ্ছিল আজানের ধ্বনি, মধুমতি নদীর ঢেউ, পাখির কলকাকলি আর বসন্তের গান। ঠিক তখনই গোপালগঞ্জের গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা বেগমের কোলজুড়ে আর্তমানবতার মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলার সহস্র বর্ষের সাধনার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। পরিচিত হয়েছিলেন সকলের প্রিয় খোকা হিসেবে। জাতির শাণিত শিরায় অকুতোভয় সাহস ছড়িয়ে কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছার অনিন্দ্য কুসুম ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। বাঙালি জাতি তাঁরই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধ জয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ে, সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। বাংলার মানুষ তাই ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখে তাঁকে ভূষিত করেন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। ছাত্র অধিকার আন্দোলন, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বশেষ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বের কারণে ৪ হাজার ৬ শত ৮২ দিন কারাবাসসহ অবর্ণনীয় জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে দুঃসময়, হতাশার সব বাধার দেওয়াল ভেঙে দীর্ঘ পরাজিত, শোষিত, বঞ্চিত বাঙালি জাতিকে উপহার দেন একটি ঠিকানা-লাল সবুজ পতাকা খচিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ- বাংলাদেশ- যার নামকরণ তিনি নিজেই করেছিলেন। জাতিকে এ দুর্লভ উপহার দানের মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিব থেকে পরিণত হয়েছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুু শেখ মুজিবে।

মাননীয় স্পিকার

০৫। সাধিত সেই ধন্য পুরুষের জন্মশতবর্ষে বাঙালি জাতি নতুন উদ্দীপনায় তাঁরই নির্দেশিত পথে অর্থনৈতিক মুক্তির রথে এগিয়ে চলেছে। জাতি পালন করছে তাঁর পিতার জন্মশতবর্ষ, মুজিববর্ষ। বঙ্গবন্ধুু ও বাংলাদেশ অবিনাসূত্রে গাঁথা। এ বছরই বাংলাদেশ পার করল তার স্বাধীনতার গৌরবময় পঞ্চাশ বছর। দেশে-বিদেশে পালিত হচ্ছে আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। বছরটা যেন মহাকালের দুই মহান ধারার সংগমস্থলকালের মোহনা। এই মোহনায় বাঙালির আরেক সম্ভার যুক্ত হয়েছে জাতির জীবনের অন্যতম একটি অর্জন স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। একসাথে তিনটি বিশেষ ঘটনার যোগসূত্রের এ বছরটি, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি বছর হিসেবে বিবেচিত হবে।

মাননীয় স্পিকার

০৬। বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, বঙ্গবন্ধুু হলেন একটি জাগ্রত ইতিহাস। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহংকার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বাংলাদেশের অস্তিত্বস্পর্শী অমর নাম। ন্যায্য, সত্য, কল্যাণ এবং আত্মমুক্তির পক্ষে সোচ্চার উদার হৃদয় মহান মানুষ। কোনো প্রকার সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাঁকে স্পর্শ করেনি কখনো। বাঙালিত্ব ছিল তার অহংকার। জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। যে বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের যে দরদ, যে ভালোবাসা, তার গভীরতা অপরিমেয়। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি, সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।”

মাননীয় স্পিকার

০৭। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সারা দেশব্যাপী আমাদের যে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছিল, অপ্রত্যাশিত অভিঘাত কভিড-১৯ এর কারণে তা বছরব্যাপী সীমিত পরিসরে পালন করা হয়। পাশাপাশি, জাতীয় পর্যায়ে ‘মুজিব চিরন্তন’ মূল থিম নিয়ে ১৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে দশ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই উদযাপন শুধু আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব নয়, এই উদযাপনের লক্ষ্য জাতির জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

মাননীয় স্পিকার

০৮। আমি এখন আলোকপাত করছি বাংলাদেশ অর্থনীতির গোড়ার দিকের কিছু কথা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে তলাবিহীন ঝুড়ি হতে বাংলাদেশের উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হওয়ার ইতিহাসের প্রতি। দীর্ঘ নয় মাসের নজীরবিহীন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ছিল না কোন অবকাঠামো ও সম্পদ। পুরো বাংলাদেশ ছিল একটি ধ্বংসস্তুপ-চারিদিকে ছিল শুধু হাহাকার। বাংলাদেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র্রতম দেশ, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে দরিদ্র্র তো বটেই। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বাংলাদেশ ছিল বিশ্বের দরিদ্র্র্রতম দশটি দেশের একটি। বাংলাদেশের ৮৮ শতাংশ মানুষ দরিদ্র ছিল এবং বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতাও ছিল শতকরা ৮৮ ভাগ। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শূন্য থেকে শুরু করেন দেশ বিনির্মাণের কঠিনতম কাজ। বঙ্গবন্ধু বলেন, “স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলাম; আজ স্বাধীনতা পেয়েছি। সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছি; সোনার বাংলা দেখে আমি মরতে চাই”। তিনি আরও বলেন, “এই বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের জন্য সবারই এখন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে”। দেশের ভবিষ্যত নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন অনেকে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন ‘ইকোনমিক প্রসপেক্টাস অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি বেশি থাকায় বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে ম্যালথাসিয়ান স্ট্যাগনেশন এর সাথে তুলনা করেন যার পরিণতি দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু। তৎকালীন মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কন্ঠে সকলকে জানিয়ে দেন, “বাংলাদেশ এসেছে বাংলাদেশ থাকবে”। অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধু আর বাঙ্গালী জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু সরকারের ৭১৯ কোটি টাকার প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। দেশের উন্নয়নকে মাথায় রেখে বাজেটের ৬৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় উন্নয়ন বাজেটে। বঙ্গবন্ধুর সুদৃঢ় নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রথম অর্থবছরে অর্থাৎ ১৯৭২-১৯৭৩ সালেই ২.৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যার ফলে জিডিপির আকার হয় ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা এবং মাথাপিছু জাতীয় আয় দাড়ায় ৯৪ মার্কিন ডলারে।

০৯। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গুরুত্ব বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু প্রণয়ন করেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮)। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্য হ্রাসকে প্রাধিকার লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। তারপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় পুণর্গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধির উপর। প্রতিবছর গড়ে ৫.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা, প্রতিবছর কমপক্ষে ২.৫ শতাংশ হারে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি লক্ষ্য অর্জনের বিস্তারিত কৌশলও সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। পরিকল্পনা মোতাবেক এগোচ্ছিল দেশ। পরিকল্পনা প্রণয়নের ২য় বছরেই অর্থাৎ ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে ৫.৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৯.৫৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। যদি আমরা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে না হারাতাম আর একই ধারায় প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকত তাহলে আমাদের জিডিপির আকার ৩৫ বছরে ৩০০ বিলিয়ন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে উন্নত দেশের জিডিপির সমান হতো। কিন্তু দুর্ভাগা সন্তান আমরা কিছু বিপথগামী স্বাধীনতার চেতনাবিরোধীর কারণে আমাদের জাতির পিতা সে সুযোগ পাননি।

মাননীয় স্পিকার

১০। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের পর দেশ ও দেশের অর্থনীতি নিমজ্জিত হয় এক গভীর অন্ধকারে- থেমে যায় জাতির পিতার সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণ। বঙ্গবন্ধুর অন্তর মন প্রথিত স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের কান্ডারী তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার বর্তমান প্রজন্মের কিংবদন্তি ও আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং তাঁদের জীবনমানের উন্নয়নসহ সকলের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে ছয় বছরের নির্বাসন ভেঙে সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে আলোকবর্তিকা হাতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রত্যয়ে দেশে ফেরেন জাতির পিতার রক্তের উত্তরাধিকার জননেত্রী শেখ হাসিনা। শুরু করেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনরুদ্ধারের কাজ। দীর্ঘ ১৫ বছরের সংগ্রাম, জুলুম নির্যাতন সহ্য করার পর দেশের মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকার গঠন করে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজে মনোনিবেশ করেন ১৯৯৬ সালে; উম্মুক্ত করেন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় ৫.৫ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.৪ শতাংশ। সর্বস্তরে স্বাধীনতার আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকায়ন, কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করতঃ জাতির পিতা ও জেল হত্যা মামলার বিচার প্রবর্তনের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার ও শান্তি সংরক্ষণ, পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদন, গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি, কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন, অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, ১৯৯৮ এর প্রলয়ংকরী বন্যা মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু উন্নয়ন, দারিদ্র্যের হার ৪৪.৩ শতাংশে নামিয়ে আনা, ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি, গৃহায়ণ তহবিলের আওতায় গৃহহীনদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থাকরণ, সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকল্পে নতুন স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন-দেশব্যাপী হাসপাতাল ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, গড় আয়ু ৬৩ বছরে উন্নীতকরণ, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বয়স্কভাতা চালুকরণ, দুঃস্থ মহিলা ভাতা চালুকরণ, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, একটি বাড়ি একটি খামার কর্মসূচি চালুকরণ, কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রতিষ্ঠা, দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা দূরীকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষা নীতি প্রণয়ন, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থাকরণ, মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তি প্রবর্তন, পাঁচ বছরে স্বাক্ষরতার হার ৪৪ থেকে ৬৫ শতাংশে উন্নীতকরণ, পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি শক্ত ভিত স্থাপন করেন। কিন্তু উন্নয়নের রথ আবার বাধাগ্রস্ত হয়।

মাননীয় স্পিকার

১১। দীর্ঘ ৮ বছরের স্থবিরতার পর ২০০৯ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের চাকা আবার ঘুরতে শুরু করে- তাদেরকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শুরু হয় শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও এদেশের মানুষ নিরঙ্কুশভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে নিরবচ্ছিন্নভাবে দেশের উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়। বর্তমান প্রজন্মের কিংবদন্তি আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একের পর এক রচিত হয় সাফল্য আর উন্নয়নের মহাকাব্য যা রুপকথার গল্পগাঁথাকেও হার মানায়। আমি এখন আমাদের সরকারের গত ১২ বছরের অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতির অর্জন সম্পর্কে আলোকপাত করছি। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন অভিযাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। এক যুগ আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। আজকের বাংলাদেশ বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা একটি স্বর্ণালী যুগ অতিক্রম করলাম, যা সারা বিশ্বে সমাদৃত। বঙ্গবন্ধুর পরে অর্থনীতি ও উন্নয়ন, সমাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন-শৃঙ্খলা, পররাষ্ট্রনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। গত ১২ বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৬ শতাংশ যা ২০১৬-২০১৭, ২০১৭-২০১৮ ও ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭ শতাংশের উপরে ছিল এবং ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ অতিক্রম করে। মূল্যস্ফীতি ছিল সহনীয় পর্যায়ে। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার যা বর্তমানে ২,২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ওই সময়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশ। জিডিপির আকার ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ০.৭৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ এক বিলিয়ন ডলারের কম যা বর্তমানে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।

১২। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা যা বর্তমান অর্থবছরে দশগুণের মত বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ২০০৫-২০০৬ বৃছরের ৫৯ বছর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৯-২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৭২.৬ বছর। শিশুমৃত্যু হার কমে প্রতি হাজারে ৮৪ থেকে ২৮ এবং মাতৃমৃত্যু হার প্রতি লক্ষে ৩৭০ থেকে ১৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। দানাদার শস্যের উৎপাদন ২০০৫-২০০৬ বছরের ১ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট থেকে ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ থেকে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

১৩। বাংলাদেশে বিগত ১২ বছর ধরে যে গতিতে অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছে, তাতে দেশে উন্নয়নের একটা ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারী আমাদের উপর আঘাত হানে, যা অদ্যাবধি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর ঝুঁকি তৈরি এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। ফলে, আমাদের এখন স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বাড়ানো ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধের মাধ্যমে কোভিড-১৯ এর মোকাবেলা করে যেতে হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে আমরা দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

মাননীয় স্পিকার

১৪। এক সময়ের বিশ্বের দরিদ্র্রতম দশটি দেশের অন্যতম বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর মতে, অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য গতি আজ বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়ের বিস্ময়। স্বাস্থ্য বিধি পরিপালন নিশ্চিত করতঃ ১৭ থেকে ২৬ মার্চ ২০২১ এ আয়োজিত মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর জাতীয় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন বিশ্বনেতারা।

১৫। অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ্, শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারী এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিংসহ উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ এবং দেশ-বিদেশের অতিথিগণ। এছাড়া জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল ড. ইউসেফ আহমেদ আল-ওথাইমিন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইউশিহিদে সুগা, পোপ ফ্রান্সিস, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং স্যু-কুয়েন, ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, এবং জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ আল হোসাইনসহ অনেকে শুভেচ্ছা বার্তা প্রেরণ ও ভিডিওবার্তা উপস্থাপন করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘Bangladesh is an example of economic progress and a country of great hope and opportunity..’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “বাংলাদেশ বিশ্বকে তার সামর্থ্য দেখিয়ে চলছে। এখন কেবল সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর দেরি করা যাবে না।”

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ‘Bangladesh is one of the fastest growing economies in the world and the UK and Bangladesh share the ambition to create an ever more prosperous and environmentally-sustainable future.’

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিং পিং বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু তাঁর সমগ্র জীবন নিজের দেশ আর মানুষের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। তাই আজও বাংলাদেশের জনগণের কাছে তিনি এত প্রিয়। তার সোনার বাংলার স্বপ্ন এখনো বাংলাদেশের বিকাশে ১৬ কোটি মানুষকে উদ্দীপ্ত করে।”

বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণশক্তি হিসেবে অভিহিত করেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদো সুগা বলেছেন, “দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত উপমহাদেশের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে এটি জাপানের ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।”

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, But Bangladesh is much different today than when I first visited with my father in 1983. Over the past 50 years, your country has made incredible progress. You have spurred economic growth, reduced poverty, increased access to education and health resources and built new opportunities for your people.

বাংলাদেশের মানুষ বিগত পাঁচ দশকে সামাজিক অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তাদের এ উন্নতির জন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। আরও অভিনন্দন জানাতে চাই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায়। -জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন। তার সম্মোহনী নেতৃত্বের কথা কেউ ভুলে যাবে না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ দেওয়া তার বক্তব্য বিশ্বের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের সড়কে অনেক এগিয়ে গেছে। - মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নতি ঘটেছে এবং বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন দেখে মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে নেপাল অত্যন্ত আনন্দিত। -নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি

বিশ্ববাসীকে বলার মতো একটি সুন্দর গল্প বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।, আমি বিশ্বাস করি, অন্যকে বলার মতো একটি গল্প প্রত্যেক মানুষ ও জাতির থাকা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন অনুপ্রেরণাদায়ী নেত্রী। তিনি আমার কাছে মায়ের মতো। এই দেশের মানুষ সত্যিই ভাগ্যবান-তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নেতা হিসেবে পেয়েছে। -ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময়ে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীও পালন করছে। ‘আমি নিশ্চিত যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের গঠনমূলক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে।’- রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন

বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং সমৃদ্ধির পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই পথ অনুসরণ করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনন্য সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে; আর সেটি হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে চূড়ান্ত যোগ্যতা অর্জন।- কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন

শতবর্ষ উৎসব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দুই দেশের জনগণের মধ্যে পুনর্মিত্রতা ও বন্ধুত্বের দূরদর্শী চিন্তাকে, যা পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নেতারা সযতেœ লালন করেছিলেন। ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বিদ্যমান বন্ধনকে আরও মজবুত করতে চাই। দুই দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত হওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা নতুন কিছু করতে চাই। -পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

পঞ্চাশ বছর আগে সম্পূর্ণ ভাগ্যলিপি রচনা করেছিল বাংলাদেশের সাহসী মানুষ, যার মাধ্যমে পুরো উপমহাদেশের ইতিহাস ও মানচিত্র বদলে যায়। গত পাঁচ দশকে সামাজিক উন্নয়ন, জনগণের অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতিও অভাবনীয়, যা বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে।- ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী

নতুন স্বাধীন দেশ বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সেই স্বপ্নকে এখন বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তার সুযোগ্য কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব শান্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। -ওআইসি’র মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিন

করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গভীরভাবে অভিভূত করেছে। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির দেশ। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নয়ন অভাবনীয়। আগামী দিনে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া অটুট বন্ধনে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা। -দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং সি-কুন

আপনাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বিশেষ দিন উপলক্ষে আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আমার শুভেচ্ছা এবং আপনাকে অভিনন্দন জানাতে পেরে আনন্দিত। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সম্পর্কের ভিত্তি এখনও পঞ্চাশ বছর আগের মতো গুরুত্বপূর্ণ। একটি কঠিন বছর কাটিয়েছি আমরা। আশা করি আমরা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারব। ভবিষ্যতে আরও ভাল সময়ের প্রত্যাশায় আছি।-ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ

গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। যার মাধ্যমে দেশের জনগণের সহনশীলতা ও নেতৃত্বের প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। আমি আত্মবিশ্বাসী, শান্তি বজায় রাখা, আরও উন্নয়ন এবং জনগণের সক্ষমতা কাজে লাগানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরও বেশি অগ্রগতি অর্জন করবে বাংলাদেশ।-জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ আল হোসাইন

মাননীয় স্পিকার

১৬। এছাড়া অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সকল বিশ্বনেতাই বাংলাদেশের অগ্রগতির অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ভূয়সী প্রশংসা করেন। করোনা মহামারিতে পুরো পৃথিবী যখন লন্ডভন্ড, এমন দুর্বিষহ সময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পাথেয় করে চলার কথা বলেছেন এই বিশ্বনেতারা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে বাংলাদেশের অর্জনের প্রশংসা করেছেন তাঁরা। অঙ্গীকার করেছেন, আশা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রার সারথি হওয়ার। গত অর্ধশতাব্দীতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামল এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭ বছরের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ২৭১ গুণ বেড়েছে আর আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়েছে ৩০০ গুণ। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছে একটি সম্মানজনক স্থান। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা দেশবাসী বিনম্র কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি।

তৃতীয় অধ্যায়

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ এবং ভবিষ্যৎ পথ পরিক্রমা

মাননীয় স্পিকার

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশে তালিকাভুক্তি

১৭। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলো আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন মানদন্ডে ক্রমশ পিছিয়ে থাকার প্রেক্ষাপটে এ সমস্ত দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৭১ সালে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকের ভিত্তিতে স্বল্পোন্নত দেশের ধারণা প্রবর্তন করে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জাঁতাকলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। পাকিস্তান উন্নয়নশীল দেশ হলেও বাংলাদেশ রয়ে যায় শ্রেণিকরণের বাইরে। এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে বঙ্গবন্ধুু বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহবান জানান। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্ব-সভার সকল সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতা লাভের জন্য জাতির পিতার হাত ধরে ১৯৭৫ সালে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তালিকাভুক্ত হয়।

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন

মাননীয় স্পিকার

১৮।       জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি) প্রতি তিন বছর অন্তর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর পর্যালোচনা বৈঠকে বসে। এই  বৈঠকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর তিনটি সূচক, যথা: (ক) মাথাপিছু আয়-যা বিশ্ব ব্যাংকের এটলাস মেথড অনুযায়ী পূর্ববর্তী তিন বছরের গড় মাথাপিছু জাতীয় আয় হতে নির্ধারণ করা হয়; (খ) মানবসম্পদ সূচক-যা পুষ্টি, স্বাস্থ্য, মৃত্যুহার, স্কুলে ভর্তি ও শিক্ষার হারের সমন্বয়ে তৈরি হয়; (গ) অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচক-যেখানে অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, উপকূলীয় অঞ্চলের জনসংখ্যার অনুপাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিস্থিতি ইত্যাদি বিবেচনায় নেওয়া হয়। স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করতে হলে সিডিপির পর পর দুটি ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনায় নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে হয়। কোনো দেশ পর পর দুটি ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনায় তিনটি সূচকের যে কোনো দুটিতে উত্তীর্ণ হলে অথবা জাতীয় মাথাপিছু আয় নির্ধারিত মানের দ্বিগুণ অর্জন করতে পারলে তাকে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের যোগ্য হিসেবে ঘোষণা করে।

১৯।       মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালের ৯-১৩ মে তারিখে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ শীর্ষক চতুর্থ সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উক্ত সম্মেলনে গৃহীত Istanbul Programmes on Actions (IPoA) এর সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণকে ত্বরান্বিত করেছে।

২০। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে মাথাপিছু আয় সূচকে ন্যূনতম ১,২৩০ মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১,২৭৪ মার্কিন ডলার, মানব সম্পদ সূচকে ন্যূনতম ৬৬ এর বিপরীতে ৭৩.২ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা সূচকে সর্বোচ্চ ৩২ এর বিপরীতে ২৫.২ অর্জন করে প্রথম দেশ হিসেবে তিনটি সূচকেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করে।

২১। ইউএন-সিডিপির ২০২১ সালের পর্যালোচনায় এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্যতা হিসেবে মাথাপিছু আয়ের মানদন্ড ১,২২২ মার্কিন ডলার বা তার বেশি। কিন্তু গত তিন বছরে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১,৮২৭ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে যোগ্যতা নিরূপণের জন্য স্কোর ধরা হয় ৬৬ বা তার বেশি। বাংলাদেশের স্কোর সেখানে ৭৫.৩। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে যোগ্য হওয়ার নির্ধারিত স্কোর ছিল ৩২ বা তার কম। বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়িয়েছে ২৭.২।          

এর পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরণের সকল সূচকে উত্তীর্ণ হয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত ইউএন-সিডিপির ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করেছে। বাংলাদেশ ২০১৮ এবং ২০২১ সালের পর্যালোচনায় তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে এবং ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে বের হয়ে সগৌরবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হবে।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য নতুন দুয়ার উন্মোচন

মাননীয় স্পিকার

২২। বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি হতে উত্তরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-যা সরকারের সঠিক পদক্ষেপ, নীতি ও কৌশলের ফলে সম্ভব হয়েছে। উত্তরণের পর গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি হবে:

♦ উত্তরণের ফলে সরকার ও জনগণের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধের বিকাশ ঘটবে। ফলে জনগণ অনুপ্রাণিত হবে-যা উন্নয়নের উচ্চতর স্তরে পৌঁছতে সহায়তা করবে।

♦ উত্তরণের পর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে-যা  বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

♦ উত্তরণ পরবর্তী দেশের ক্রেডিট রেটিং বৃদ্ধি পাবে। ফলে সভরেন বন্ড ইস্যু করে স্বল্প সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সংগ্রহ করা যাবে। উৎপাদনশীলতা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে যা রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

♦ বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে-যার ফলে দেশে অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং মানুষের জীবনমানের উন্নতি হবে।

♦ স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধাদির অবর্তমানে রপ্তানি বহুমুখীকরণের এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে-ফলে নতুন রপ্তানি পণ্য ও বাজারের সৃষ্টি হবে।

♦ পণ্য সরবরাহ চেইন সুসংহত হবে এবং উচ্চ মূল্যমান ও উচ্চ মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনে উৎসাহ এবং বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে।

♦ দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা বৃদ্ধির ফলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী শ্রমশক্তি তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে।

♦ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন-উন্নয়ন ও বাণিজ্য সহযোগী, বেসরকারি খাত, সুশীল সমাজসহ সকলকে নিয়ে একটি অভিন্ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

মাননীয় স্পিকার

২৩। বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে যে সকল আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের পর সেগুলি অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে না বা হ্রাস পাবে। তন্মধ্যে রয়েছে,

♦ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, শুল্ক-ম্ক্তু ও কোটা-ম্ক্তু বাজার সুবিধা; WTOর বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট মেধাসত্ত্ব (TRIPS) চুক্তির আওতায় ঔষধ শিল্পে পেটেন্ট প্রটেকশন প্রদান থেকে অব্যাহতির সুবিধা; এবং রপ্তানি পণ্যে/শিল্পে ভর্তুকি প্রদানের সুবিধা হ্রাস পাবে।

♦ সহজ শর্তের বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান সহায়তা হ্রাস পাবে। যদিও ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিবিভাজনে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর থেকে নমণীয় ঋণের সাথে শর্তযুক্ত অনমনীয় ঋণ গ্রহণ করে আসছে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় গৃহীত কৌশল

মাননীয় স্পিকার

২৪। আমাদের জন্য সুখবর হলো আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের এ সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ন্যূনতম ৫টি বছর সময় পাবো। ইউএন-সিডিপির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তরণ ২০২৬ সালে কার্যকর হবে। অর্থাৎ, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য এ সকল সুবিধা ভোগ করতে পারবে। তবে, বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বাংলাদেশ উত্তরণের পর আরও তিন বছর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত শুল্কম্ক্তু ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা ভোগ করতে পারবে। এ সময়কালের মধ্যেই বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে তাঁদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো অনেক বাড়াতে সফল হবে বলে আশা করা যায়। আমাদের সরকার ব্যবসায়ীদের জন্য সকল নীতি-সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে এবং প্রয়োজনভেদে নতুন আঙ্গিকে সহায়তা প্রদান করবে। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কৌশল আমরা ইতোমধ্যে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমন্বিত করেছি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ হতে একটি বিস্তারিত কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজও চলমান আছে। স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের ফলে বাংলাদেশ যে সকল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে তা মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আমি তুলে ধরছি:

♦ আমাদের সরকারের অনুরোধে ইউএন-সিডিপি উত্তরণের প্রস্তুতিকাল কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারীর প্রেক্ষাপটে তিন বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।

এ সময়কালে, অর্থাৎ, ২০২৬ সাল পর্যন্ত সকল আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে।

♦ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)-এর এলডিসি গ্রুপ স্বল্পোন্নত দেশ সংক্রান্ত সকল বাণিজ্য সুবিধা যাতে উত্তরণের পর আরও ১২ বছর পর্যন্ত বহাল থাকে, সে সম্পর্কে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেছে। বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং এ প্রস্তাব যাতে গৃহীত হয় সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

♦ উত্তরণের পর ইইউ দেশগুলোতে GSP+ সুবিধা নেয়ার জন্য সরকার ইতোমধ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে ভুটানের সাথে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন এবং আরও ১১টি দেশের সাথে অনুরূপ চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

♦ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ  গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পণ্য অন্যান্য দেশের পণ্যের সাথে আরো বেশি প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে সক্ষম হবে। তাছাড়া, এফডিআই বাড়ানোর জন্য সরকার ব্যবসা সহজীকরণ সূচক উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে।

♦ সরকার ইতোমধ্যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের জন্য হাইটেক পার্ক স্থাপন এবং পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

♦ উত্তরণের পরেও যাতে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সুযোগ-সুবিধাদি অব্যাহত রাখা যায়, সে বিষয়ে উন্নয়ন সহযোগী বাণিজ্যিক অংশীদার ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সাথে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখা হবে।

♦ উত্তরণ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশ ও বিদেশের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

♦ উত্তরণের ফলে সৃষ্ট সুযোগগুলিকে কাজে লাগানো এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী কী করা যেতে পারে সে সম্পর্কে খাতভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার কাজ শুরু করা হয়েছে।

♦ সর্বোপরি, উত্তরণ পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আসন্ন প্রস্তুতিকালে সরকার সকল অংশীজন, বেসরকারি খাত, উন্নয়ন ও বাণিজ্য সহযোগী, সুশীল সমাজ-এর সাথে নিবিড়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি উত্তরণ কৌশল তৈরির কাজ হাতে নিয়েছে।

মাননীয় স্পিকার

২৫। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাত্রিতে জাতির পিতার বিয়োগান্তক শাহাদাতের মাধ্যমে দেশ পিছিয়ে গিয়েছিল অনেক। স্বল্পোন্নত দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতে আমাদের তাই অনেক দিন লেগে গিয়েছে। প্রায় ৪৩ বছর পর বিগত ১২-১৬ মার্চ ২০১৮ তারিখ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ইউএন-সিডিপি’র ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের তিনটি সূচকের সকল মানদন্ড পূরণের স্বীকৃতি পায়। এটি সম্ভবপর হয়েছে বিগত এক যুগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিচালিত সরকারের সফল কর্মকান্ডের ফলস্বরূপ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রায় সকল সূচকে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করার ফলে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে ইউএন-সিডিপি’র ত্রি-বার্ষিক পর্যালোচনা সভায় চূড়ান্তভাবে পাঁচ বছরের প্রস্তুতিকালসহ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের সুপারিশ লাভ করেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এটি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

চতুর্থ অধ্যায়

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম

মাননীয় স্পিকার

২৬। আপনি জানেন যে, কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি করেছে, যা হতে আমাদের দেশও মুক্ত নয়। ২৩ মে ২০২১ পর্যন্ত সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ কোটি ৭০ লাখ এবং প্রাণহাণির সংখ্যা ৩৪ লক্ষ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ৮০ হাজার এবং প্রাণহানির সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর হতে বিগত পঞ্চাশ বছরে নানাবিধ চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমরা আজ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে উন্নীত হয়েছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের গত ১২ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে আমরা দারিদ্র্য দূর করে ও স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা হতে বেরিয়ে এসে একটি উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে যাত্রা করেছি। কিন্তু জাতীয় জীবনের এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে করোনাভাইরাসজনিত সংকট আমাদের অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য, দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্যান্য আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের গতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

২৭। বাংলাদেশে এ ভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হয় গত ২০২০ সালের ৮ মার্চ তারিখে। কিন্তু এর আগেই ভাইরাসটি চীন, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে ঐ বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই আমাদের আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির অন্যান্য সেক্টরে এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে শুরু করে। এ প্রেক্ষাপটে, প্রাদুর্ভাব শুরুর সাথে সাথেই আমরা এ সংকট মোকাবিলায় দ্রুত উদ্যোগ নেই। আমাদের অর্থনীতিতে প্রথম আঘাতটি আসে ইউরোপ-আমেরিকায় আমাদের রপ্তানিমুখী পোষাকশিল্পের রপ্তানি আদেশ বাতিলের মাধ্যমে, যার ফলে এ খাতের প্রায় ৫০ লক্ষ প্রমিকের কর্মসংস্থান হুমকির মধ্যে পড়ে। আমরা কোন ধরনের কালক্ষেপণ না করে মার্চের ৩১ তারিখেই রপ্তানি খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি জরুরি তহবিল চালু করি। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে গত বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহ হতে মে মাস পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ছুটির কারণে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে স্থবিরতা দেখা দেয়। এ থেকে উত্তরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত বছরের ৫ এপ্রিল তারিখেই আরো ৬৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার চারটি প্যাকেজ ঘোষণা করেন। গত এক বছরে আমরা ধীরে ধীরে এ প্যাকেজের আওতা বর্ধিত করেছি এবং নতুন নতুন সেক্টর ও নতুন নতুন ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সহায়তার জন্য প্যাকেজের আওতা সম্প্রসারণ করেছি। এ পর্যন্ত আমরা ২৩টি প্যাকেজ চালু করেছি যার মোট আর্থিক মূল্য ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র প্রায় ৪.২ শতাংশ।

২৮।       অর্থনৈতিক এ সংকট মোকাবেলা করতে গিয়ে আমরা একটি বিস্তারিত কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলাম, যার চারটি প্রধান কৌশলগত দিক রয়েছে। আমাদের প্রথম কৌশলটি ছিল সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়া এবং বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা। গত এক দশকের সুশৃঙ্খল মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি বাস্তবায়নের ফলে আমাদের ঋণের স্থিতি-জিডিপি’র অনুপাত অত্যন্ত কম হওয়ায় প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কারণে সরকারি ব্যয় বড় আকারে বাড়ালেও তা সামষ্টিক অর্থনীতির উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। আমাদের দ্বিতীয় কৌশলটি ছিল ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা যাতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুনরুজ্জীবিত হয় এবং দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় কৌশলটি ছিল হতদরিদ্র, কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত জনগণকে সুরক্ষা দিতে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা। চতুর্থ সর্বশেষ কৌশলটি ছিল বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।

২৯। এসকল কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, গবেষক ইত্যাদি নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের সাথে নিয়মিত কথা বলেছি এবং তাদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করেছি। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আমরা কোভিড-১৯ মোকাবিলা এবং টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নেয়া এই প্রণোদনা প্যাকেজ বিষয়ে তিন পর্বের একটি সিরিজ মতবিনিময় সভার আয়োজন করি। এসব সভায় উঠে আসা সুপারিশ ও পরামর্শ অনুসারে আমরা প্যাকেজগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করি।     

মাননীয় স্পিকার

৩০। আমি গত বছরের বাজেট বক্তৃতায় সে সময় পর্যন্ত চালু করা বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলাম। আজকে আমি এ প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়নের একটি সংক্ষিপ্ত হালচিত্র এ মহান সংসদে তুলে ধরছি:

♦ তৈরি পোষাকসহ রপ্তানিমুখী খাতের প্রায় ৫০ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল আমরা সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছি;

♦ ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে আমরা প্রথমে ৩০ হাজার কোটি টাকার স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করেছিলাম, যা পরে ৪০ হাজার কোটি টাকায় বর্ধিত করা হয়। এর মধ্য হতে গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত মোট ৩২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। একইভাবে কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দেয়া ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল হতে গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকার স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ বিতরণ করা হয়েছে;

♦ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের আকার ৩.৫ বিলিয়ন ডলার হতে ৫.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে এবং গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত মোট ৯.০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে;

♦ করোনা রোগীদের সেবা প্রদানের কাজে সরাসরি নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সকলকে দুই মাসের বেতনের সমপরিমাণ বিশেষ সম্মানী দেয়া হচ্ছে। গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত আমরা মোট ১৯ হাজার ৫৭৯ জন স্বাস্থ্যকর্মীকে মোট ৪৯ কোটি টাকা সম্মানী প্রদান করেছি;

♦ রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ এ সংক্রান্ত সরকার ঘোষিত নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে দায়িত্ব পালনকালে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা ১৩২ জনের পরিবারকে মোট ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছি;

♦ ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র মানুষের জন্য আমরা খাবারের ব্যবস্থা করেছি। এ লক্ষ্যে আমরা মানবিক সহায়তা হিসেবে দেশব্যাপী মোট ৪ লক্ষ মেট্রিক টন চাল ও ১ লক্ষ মেট্রিক টন গম বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। পাশাপাশি, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মাঝে আমরা মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয় করেছি;

♦ ভাইরাসজনিত কারণে কর্মহীনতা ও আয়ের সুযোগ হ্রাসের কবল থেকে দেশের অতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে সারাদেশে নির্বাচিত ৩৫ লক্ষ উপকারভোগী পরিবারের প্রত্যেককে ২,৫০০ টাকা করে অনুদান প্রদান করেছি;

♦ দেশের অতি দরিদ্র ১১২টি উপজেলায় আমরা বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ভাতা কর্মসূচি এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা কর্মসূচির আওতা শতভাগে উন্নীত করেছি;

♦ গৃহহীন মানুষের জন্য সারাদেশে ৮১ হাজার ৬৪৩ টি গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি, যার মধ্যে গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত মোট ৬৬ হাজার ৮৯৮টি গৃহ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে;

♦ কৃষকের ঋণ প্রাপ্তি সহজ করার লক্ষ্যে গঠন করা ৫ হাজার কোটি টাকার কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত মোট ৩ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। নিম্ন আয়ের পেশাজীবী কৃষক/ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য গঠিত ৩ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের গত এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৭৭২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে;

♦ বাণিজ্যিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থগিতকৃত সুদের বিপরীতে ২ হাজার কোটি টাকার সরকারি সুদ ভর্তুকি প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গত এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা সুদ ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে।

৩১। এ পর্যায়ে আমি করোনাভাইরাসজনিত সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেয়া আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নতুন প্যাকেজ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। ক্ষতিগ্রস্ত কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঋণ প্রবাহের গতি প্রথম দিকে কিছুটা শ্লথ হওয়ার কারণে আমরা এ খাতে ঋণ প্রদান উৎসাহিত করতে ২ হাজার কোটি টাকার একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছি। রপ্তানিমুখী তৈরি পোষাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের দুস্থ শ্রমিকদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে আমরা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম চালু করেছি। গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমরা আটটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোট ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি ক্ষুদ্রঋণ ও পল্লী উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করেছি। বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা আমরা আরো ১৫০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছি যা ২০২১-২২ অর্থবছর হতে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব মোকাবিলায় ইতোপূর্বে নির্বাচিত ৩৫ লক্ষ দরিদ্র পরিবারের মাঝে ২য় পর্যায়ে আরো ২ হাজার ৫০০ টাকা করে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছি। পাশাপাশি, ক্ষতিগ্রস্ত ৪ লক্ষ ৭ হাজার ৪০২ জন ডেইরি ও পোল্ট্রি এবং ৭৮ হাজার ৭৪ জন মৎস্য খামারিকে ৫৬৮ কোটি টাকা নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করছি। সাম্প্রতিক সময়ে ঝড়ো হাওয়া, তাপদাহ ও শিলাবৃষ্টিতে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ৯৭ হাজার ৫০৫ জন কৃষককে জনপ্রতি ২,৫০০ টাকা করে মোট ২৪ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা প্রদান করেছি। এছাড়াও, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নন-এমপিও সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ লক্ষ ৬ হাজার ও স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার ৬১ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীকে মোট ৭৫ কোটি টাকার নগদ সহায়তা প্রদান করছি।

৩২। আমাদের এসকল উদ্যোগের ফলে এ পর্যন্ত দেশে ৫ কোটি ৮১ লক্ষ ৯৫ হাজার ২১১ জন নাগরিক এবং ১ লক্ষ ৪ হাজার ৯৯৬টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি উপকৃত হয়েছে (পরিশিষ্ট ‘ক’ সারণি ১)। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গৃহীত সময়োপযোগী পদক্ষেপের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি কমনওয়েলথ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সফল শীর্ষ নারী নেত্রীদের অন্যতম হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

মাননীয় স্পিকার

৩৩। এ প্রসঙ্গে আমি আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের আস্থার প্রতিফলন আমরা সংকটকালে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমাদের সকল দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের আমরা এই সংকট মোকাবিলায় পাশে পেয়েছি। মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে আমরা ২০১৯-২০২০ ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রায় ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজেট সহায়তা ঋণ পেয়েছি। আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরেও আরো প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা পেতে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি, করোনা টিকা ক্রয়ের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা হতে আরো ১.৫ বিলিয়ন ডলারের ভ্যাক্সিন সাপোর্ট পেতে যাচ্ছি। জাপান সরকার, দক্ষিণ কোরিয়া সরকার, Asain Infrastructure Investment Bank (AIIB) Ges OPEC Fund for International Develpment (OPEC Fund)  এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে বাজেট সহায়তা দিতে এগিয়ে এসেছে। আমাদের ঋণ-জিডিপি’র হার কম থাকায় ও সার্বিকভাবে ঋণ সক্ষমতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কোন সংশয় না থাকায় এ বিপুল বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া আমাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি আপনার মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতি সরকারের কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিচ্ছি।

পঞ্চম অধ্যায়

প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট : বিশ্ব অর্থনীতি ও বাংলাদেশের অবস্থান

মাননীয় স্পিকার

৩৪।       ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটটিও প্রণয়ন করা হচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী চলমান একটি ক্রান্তিকালে। যখন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাইরাসের দ্বিতীয় এবং কোথাও কোথাও চলছে তৃতীয় ঢেউ । বৈশ্বিক এ প্রাদুর্ভাবের ভরকেন্দ্র সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া মহাদেশ, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে সরে আসছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

৩৫। তবে আশার কথা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক উভয়ই বাংলাদেশের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়েছে। আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ২০২১ সালে ৬.০ শতাংশ ও ২০২২ সালে ৪.৪ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস হলো ২০২১ সালে ৫.০ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৭.৫ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের মতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ ও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৬ শতাংশ এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৫.১ শতাংশ হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর মতে বাংলাদেশ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫.৫ থেকে ৬ শতাংশ এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হবে।

৩৬। কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে যা ছিল এশিয়ার মধ্যে সবার উপরে। ঐ সময়ে বাজেট ঘাটতিও ধারণযোগ্য পর্যায়ে ছিল যা জিডিপি’র ৫.৫ শতাংশ। সরকারি ঋণ/জিডিপি অনুপাত হয়েছে মাত্র ৩৫.৯৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২.৮৭ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরের বিগত ১০ মাসে রপ্তানি খাতে ৮.৭৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে জুলাই-মার্চ সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.০৬ শতাংশ। প্রবাস আয়ের ক্ষেত্রে বিগত ৩১ মে ২০২১ পর্যন্ত ৪০.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। চলতি হিসাবের ভারসাম্যে জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ১.৫৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে মার্চ ২০২১ তে ৮.৭৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সামগ্রীক মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মার্চ ২০২১ এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল ৫.৪৭ শতাংশ। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশের মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২,২২৭ মার্কিন ডলারে, যা প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় বেশী। সামষ্টিক অর্থনীতিতে সরকারের এ সাফল্য উন্নয়ন সহযোগীসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলেও সমাদৃত হয়েছে। আইএমএফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বব্যাংকের মতে, “Bangladesh economy shows early signs of recovery amid uncertainties.” ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সম্প্রতি শিরোনাম করেছে, “Bangladesh is becoming South Asia's Economic Bull case.” দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে “Bangladesh: From a `basket case' to a robust economy.” দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর ১০ মার্চ ২০২১ এর শিরোনাম “What can Biden's plan do for poverty? Look to Bangladesh.”

৩৭। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির এ ইতিবাচক চিত্র হতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সময়োপযোগী ও কার্যকর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার কর্মসৃজন ও কর্মসুরক্ষা, অভ্যন্তরীণ চাহিদা সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখা, কোভিড-১৯ প্রতিষেধক টিকা প্রদান কার্যক্রমের মাধ্যমে করোনা মহামারির চলমান দ্বিতীয় ঢেউ এর অর্থনৈতিক প্রভাবও সফলভাবে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। সরকার বিশ্বাস করে ‘Every challenge creates lots of opportunities and windows for moving forward.’ সে কারণে কোভিড-১৯ এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সৃষ্ট ক্ষতের পাশাপাশি কিছু সুযোগও তৈরি হবে যা গ্রহণে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করবে।

৩৮। আমাদের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ। সংগত কারণেই কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিবেচনায় এবারের বাজেটে প্রাধান্য পাবে দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা। দেশের সকল মানুষের জীবন-মান উন্নয়নের মাধ্যমেই মূলত অর্জিত হবে ২০৩০ (টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট), ২০৩১ (উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ), ২০৪১ (উন্নত দেশ) এবং ২১০০ (ব-দ্বীপ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন) এর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যসমূহ।

ষষ্ঠ অধ্যায়

সম্পূরক বাজেট

মাননীয় স্পিকার

৩৯। এ পর্যায়ে আমি চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট ও ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট কাঠামোর উপর আলোকপাত করব।

চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট

মাননীয় স্পিকার

৪০। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে নানাবিধ সংস্কার কার্যক্রম বিশেষ করে ভ্যাট আইন, ২০১২-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং দেশের অর্থনীতি করোনার প্রভাব হতে পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কোভিড-১৯ এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায়, বিশেষ করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এর প্রভাবে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের প্রত্যাশিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্জিত হবে না মর্মে প্রতীয়মান হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পর্যন্ত আহরিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল মূল বাজেটের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৪১.০ শতাংশ। একই সময়ে সরকারি ব্যয় হয় বার্ষিক বরাদ্দের ৩৩.৫ শতাংশ। বাজেট বাস্তবায়নের এই পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেটে যে সংশোধন ও সমন্বয় করতে হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরিশিষ্ট ক: সারণি ৪-তে বিস্তারিত দেখানো হয়েছে।

৪১। সংশোধিত রাজস্ব আয় : ২০২০-২০২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা হ্রাস করে ৩ লক্ষ ৫১ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

৪২। সংশোধিত ব্যয় : চলতি অর্থবছরের বাজেটে সর্বমোট সরকারি ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয় ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এ ব্যয় ২৯ হাজার ১৭ কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লক্ষ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লক্ষ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা হতে ৭ হাজার ৫০২ কোটি টাকা হ্রাস করে ১ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ এর কারণে স্বাস্থ্য খাতে এবং বিভিন্ন প্রণোদনা বাস্তবায়নে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় সাশ্রয় করে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়ের প্রাক্কলন হ্রাস করা হয়েছে ২১ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা।

৪৩। সংশোধিত বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন : চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৬.১ শতাংশ। মূল বাজেটে ঘাটতির বিপরীতে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের প্রাক্কলন ছিল ৮০ হাজার ১৭ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকায়। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা হতে অর্থায়নের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৭৯ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা।

সপ্তম অধ্যায়

আগামী ২০২১ ২০২২ অর্থবছরের বাজেট কাঠামো

মাননীয় স্পিকার

৪৪। কোভিড-১৯-এর দীর্ঘতর প্রভাব এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর দ্বিতীয় ঢেউ-এর প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতি ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সৃষ্ট ক্ষতি হতে পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে এবং বিশেষভাবে স্বাস্থ্য খাতে উদ্ভূত প্রয়োজন মেটানো এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুত করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ব্যবস্থা প্রস্তাবিত বাজেটে রাখা হয়েছে।

মাননীয় স্পিকার

৪৫। এবার আমি আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত আয় ও ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরছি যা পরিশিষ্ট? ‘ক’: সারণি ৫ এ বিস্তারিত দেয়া আছে।

৪৬। বিগত অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে আমি কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বেশকিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছিলাম। এ বছরে এ সকল সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন আমরা শুরু করেছি। কিন্তু অর্থবছরব্যাপী কোভিড-১৯ এর প্রভাবে আমরা সেগুলো সফলভাবে শেষ করতে পারিনি। আমরা গৃহীত সকল সংস্কারমূলক কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে আগামী অর্থবছরে অব্যাহত রাখতে চাই।

৪৭। জুলাই, ২০১৯ হতে আমরা নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করছি। এ বাস্তবায়ন সফল করতে আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি, সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে কার্যক্রম চলমান থাকবে। রাজস্ব আদায়ের সিংহভাগ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। তাই আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং একই সাথে Business প্রসেস অটোমেশন-এর কাজকে প্রাধান্য দেয়া হবে।

৪৮। আমাদের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ কর প্রদানে সমর্থ হলেও কর প্রদানকারীর সংখ্যা বর্তমানে মাত্র ২৫.৪৩ লক্ষ। ফলে কর ফাঁকি রোধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণসহ তাদেরকে কর জালের (Tax-net) আওতায় আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আগামী বাজেটে থাকবে। তাছাড়া, আমাদের রাজস্ব জিডিপি’র অনুপাত সম-অর্থনীতির অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। ফলে রাজস্ব জিডিপি অনুপাত বর্তমানের যৌক্তিক পর্যায়ে বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

মাননীয় স্পিকার

৪৯। প্রস্তাবিত কাস্টমস আইন, ২০২০ মহান জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হলে আগামী অর্থবছরে এই আইন কার্যকর করা হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

৫০। উপরে বর্ণিত বাস্তবতা এবং আমাদের সকল পরিকল্পিত ও সংস্কারমূলক কর ব্যবস্থাপনার হাত ধরে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩ লক্ষ ৮৯ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১১.৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উৎস হতে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। এনবিআর বহির্ভূত সূত্র হতে কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া, কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরিত হবে আরো ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

মাননীয় স্পিকার

৫১। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার বা মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ লক্ষ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ১৭.৫ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লক্ষ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।

৫২। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, কৃষি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির খাতওয়ারি বরাদ্দ পরিশিষ্ট ‘ক’ এর সারণি ৬ এ তুলে ধরা হয়েছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মানবসম্পদ (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) খাতে ২৯.৪ শতাংশ, সার্বিক কৃষি খাতে (কৃষি, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানিসম্পদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ২১.৭ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ১২.১ শতাংশ, যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে (সড়ক, রেল, সেতু এবং যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য) ২৬.৪ শতাংশ এবং অন্যান্য খাতে ১০.৪ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।

৫৩। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৬.২ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য, এই হার গত বাজেটে ছিল ৬.১ শতাংশ। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক উৎস হতে ১ লক্ষ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস হতে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সংগৃহীত হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংক-বহির্ভূত খাত হতে আসবে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা।

মাননীয় স্পিকার

৫৪। সামগ্রিক ব্যয় কাঠামো : প্রস্তাবিত বাজেটের সামগ্রিক ব্যয় কাঠামো (উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয়) এখন তুলে ধরব। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সম্পাদিত কাজের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী কাজগুলিকে ৩টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়, যথা: সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো ও সাধারণ সেবা খাত।

৫৫। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৮.২৫ শতাংশ; এর মধ্যে মানবসম্পদ খাতে (শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত) বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। ভৌত অবকাঠামো খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বা ২৯.৭৬ শতাংশ; যার মধ্যে সার্বিক কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৭৪ হাজার ১০২ কোটি; যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে ৬৯ হাজার ৪৭৪ কোটি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। সাধারণ সেবা খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৪.০৪ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP), বিভিন্ন শিল্পে আর্থিক সহায়তা, ভর্তুকি, রাষ্ট্রায়ত্ত, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের জন্য ব্যয় বাবদ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫.৭৪ শতাংশ; সুদ পরিশোধ বাবদ প্রস্তাব করা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৩৬ শতাংশ; নিট ঋণদান (Net lending) ও অন্যান্য ব্যয় খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ০.৮৫ শতাংশ। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য পরিশিষ্ট ‘ক’ এর সারণি ৭ এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগভিত্তিক বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব পরিশিষ্ট ‘ক’ এর সারণি ৮ এ উপস্থাপন করা হলো।

অষ্টম অধ্যায়

খাতভিত্তিক নীতি-কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও সম্পদ সঞ্চালন

মাননীয় স্পিকার

৫৬। এখন আমি আগামী অর্থবছরসহ মধ্যমেয়াদে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নীতি-কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ আপনার মাধ্যমে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতে চাই। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ও দীর্ঘায়িত প্রভাব মোকাবেলা, আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার, ২০১৮-এ বর্ণিত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ২য় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১) বাস্তবায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ও লক্ষ্যসমূহ অর্জনের প্রয়াস চালানো হবে এ বাজেটের মাধ্যমে। আমরা ইতোমধ্যে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করেছি। সুতরাং আগামী বাজেটে এর বাস্তবায়ন বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে। তাছাড়া, করোনা ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবেলায় জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করার বিষয়টি এ বাজেটে সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করার চেষ্টা করেছি।

 

মধ্যমেয়াদি নীতি-কৌশল

৫৭। বিগত এক দশকে বাংলাদেশের ক্রমাগত উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন কোভিড-১৯-এর প্রভাবে সাময়িক বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গত ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে করোনা ভাইরাসের কারণে তা হ্রাস পেয়ে ৫.২ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে কোভিড-১৯-এর প্রভাব হতে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার হবে ধরে নিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮.২০ শতাংশ। কিন্তু এ মহামারির প্রভাব দীর্ঘতর হওয়া এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ এবং পুনরায় লকডাউন ঘোষণার কারণে অর্থনেতিক কর্মকান্ডে শ্লথ অবস্থা বিরাজমান এবং রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে কাঙ্খিত গতি ফিরে পায়নি। তবে প্রবাস আয়ে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হওয়া এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকার ঘোষিত বৃহৎ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের বিষয়গুলো বিবেচনা করে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সংশোধন করে ৬.১ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ পরবর্তী উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশ হবে মর্মে আশা করছি।

৫৮। মধ্যমেয়াদে আমাদের প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস হলো শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধিতে ভোগ ও বিনিয়োগ এবং বহিঃস্থ চাহিদা বৃদ্ধিতে রপ্তানি হবে আমাদের মনোযোগের ক্ষেত্র। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি মধ্যমেয়াদেও অব্যাহত থাকবে। সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের লক্ষ্য। অন্যদিকে সরবরাহের দিক থেকে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর মাধ্যমে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

৫৯।       আগামী বাজেট অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দ্বিতীয় বছর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর আলোকে প্রণীত ২য় প্রেক্ষিত পরিকল্পনার (২০২১-২০৪১) প্রথম ধাপ বাস্তবায়িত হবে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন রূপকল্প ২০৪১ এর ভিত রচিত হবে অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্যসমূহ এবং বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর লক্ষ্যসমূহ অর্জনে সহায়ক হবে। তাছাড়া, কোভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলার মাধ্যমে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসৃজন এবং দারিদ্র্য হ্রাসের কৌশল বাস্তবায়নের উপরও এ পরিকল্পনায় বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শ্রমঘন ও রপ্তানিমুখী শিল্পের উন্নয়ন, কৃষির বহুমুখীকরণ, সেবাখাতের উন্নয়ন, ৪র্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণ করার জন্য আইসিটি ভিত্তিক উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বিষয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ নির্দেশনা রয়েছে। এই পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের মূল ভিত্তি হলো বেসরকারি খাতের দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করা এবং সে লক্ষ্যে সরকার বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে ভূমিকা পালন করবে। পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগ বিশেষ করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বৃদ্ধির বিষয়ে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো শক্তিশালীকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার জন্য অবকাঠামোগত বাধা দূরীকরণের উপর। এছাড়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি এজেন্ডাকেও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

মাননীয় স্পিকার

৬০। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস এর প্রাদুর্ভাব সঠিকভাবে মোকাবেলা এবং জীবন ও জীবিকাকে প্রাধান্য দিয়ে এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সাথে কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে আমরা বিগত বছরের ন্যায় চলতি বছরেও বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ব্যবস্থা হতে কিছুটা সরে এসেছি। এ প্রসংগে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, আগামী বাজেটে সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগামী বাজেটে কোভিড-১৯ এর প্রভাব মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতকে সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার প্রদান করে এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। আমাদের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার খাত হলো কোভিড-১৯ মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষি হচ্ছে আমাদের তৃতীয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত। এ লক্ষ্যে আমরা অধিক খাদ্য উৎপাদনকল্পে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ ও বীজে প্রণোদনা, কৃষি পুনর্বাসন, সারের উপর ভর্তুকি প্রদান, ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো। আমাদের চতুর্থ অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ সার্বিক মানবসম্পদ উন্নয়ন। পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসৃজনকে আমরা পঞ্চম অগ্রাধিকার প্রদান করেছি। সে লক্ষ্যে আমরা কোভিড-১৯ এর প্রভাবে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাহত হওয়ায় শিল্প উৎপাদন, সিএমএসএমই, সেবা খাত ও গ্রামীণ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মহীনতা এবং কর্মহীন হয়ে দেশে ফেরত আসা প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়নের উপর আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব প্রদান করেছি। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণ করাসহ গৃহহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য গৃহনির্মাণ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে খাদ্য বিতরণের উপরও আমরা অগ্রাধিকার প্রদান করেছি।

মাননীয় স্পিকার

৬১। আমাদের সরকারের অন্যতম মৌলিক অঙ্গীকার হলো টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন। বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার, ব্যবসাবান্ধব কর ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতের সংস্কার, সরকারি বিনিয়োগ, তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি’র আকার বৃদ্ধি ইত্যাদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়ে থাকে। তাছাড়া, অবকাঠামো খাতের মেগা প্রকল্পসমূহ, যেমন : পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ, দোহাজারী হতে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা মেট্রোরেল, ইত্যাদিসহ অবকাঠামো খাতের সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহ যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্পন্ন করার মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালানো আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হবে। শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি অর্জনই নয়, পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও অসমতা হ্রাস করে জনগণের জীবনমানে গুণগত পরিবর্তন আনাই আমাদের লক্ষ্য। এ জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্রঋণ ও দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কৌশল অধিকতর গুরুত্ব পাবে। প্রতি বছরের মতো এবারও বাজেট বক্তৃতার সাথে আমাদের মধ্যমেয়াদি নীতি কৌশল সম্বলিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতি’ পেশ করা হয়েছে।

৬২। পরবর্তী অংশে খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরছি।

কর্মপরিকল্পনা সম্পদ সঞ্চালন

স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ

মাননীয় স্পিকার

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলা ও জনজীবন সুরক্ষা

৬৩। আপনি জানেন যে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধ হতে কোভিড-১৯ মহামারির প্রকোপে সংকটাপন্ন সময় পার করছে গোটা বিশ্ব। বর্তমানে এ মহামারির দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ বিশ্বব্যাপী জনজীবন সুরক্ষাকে আরো কঠিনতর ও সংকটময় করে তুলেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশে মার্চ ২০২০ হতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির সংক্রমণ চলতি বছরের শুরুতে কিছুটা কমে এলেও মার্চ ২০২১ এর দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে, যা এখনো চলমান রয়েছে। জনস্বাস্থ্য ও জনজীবনের উপর এ মহামারির প্রভাব বিবেচনায় আমরা প্রথম ঢেউ এর সময়ে কোভিড মোকাবেলার প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম। ৬৬ দিনের দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনায় সংক্রমণ হ্রাস ও আক্রান্তদের চিকিৎসার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে সে সময়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছিল।

৬৪। এ মহামারির চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে সংক্রমণের হার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পুনরায় দেশজুড়ে ৫ এপ্রিল হতে ৩০ মে ২০২১ পর্যন্ত লকডাউন বলবৎ করা হয়। জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন সুরক্ষার লক্ষ্যে এসময় মানুষের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এবং গণপরিবহণ, রেল পরিবহণ ও অভ্যন্তরীণ পথে বিমান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। তবে সাধারণ মানুষের জীবিকা বজায় রাখার মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে কলকারখানা চালু রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শপিংমল, মার্কেট ও অফিস খোলা রাখা হয়। এ সকল পদক্ষেপের কারণে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভবপর হয়েছে। আমরা এ সংকটকালে জনস্বাস্থ্য ও জনজীবন সুরক্ষার জন্য কৌশল অবলম্বন অব্যাহত রাখবো এবং পাশাপাশি মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ খাতের কার্যক্রম বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেবো।

৬৫। করোনা মহামারির এ ক্রান্তিকালে সরকার স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সকল নাগরিকের জন্য সুলভে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা আরো জোরদার করেছে। ফলে সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার যে লক্ষ্য সরকারের রয়েছে তার অর্জন সহজতর হবে। বিগত বছরের মার্চ-এ দেশে কোভিড-১৯ প্রথম শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথেই এ ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে National Preparedness and Response Plan প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে তার কিছুটা সংশোধন করে Bangladesh Preparedness and Response Plan তৈরিকরত সে পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।  বিগত অর্থবছরে কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের সময় জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চালুকৃত বিশেষায়িত আইসোলেশন ইউনিট, রাজধানীতে স্থাপিত ১৪টি এবং অন্যান্য জেলা শহরে স্থাপিত ৬৭টি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে বর্তমান দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি, বিগত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠিত ৫৫টি ল্যাবরেটরীর কার্যক্রম ও উন্নততর সেবা প্রদান প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসমূহ কোভিড-১৯ এর সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। নতুন ৯টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। ফলে, দেশব্যাপী সর্বমোট ৮৯টি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে আক্রান্তদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন স্পেশালাইজড হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টার চালু করা হয়েছে। এ হাসপাতালে ২০০টি আইসিইউ বেড, ২৫০টি হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) বেড, ৫৬ শয্যার জরুরি ওয়ার্ড ও ৩৯৫টি সাধারণ বেড রয়েছে। [অসমাপ্ত]

সর্বশেষ খবর