শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
সাগর-রুনি থেকে তনু মিতু হত্যার তদন্ত

নথি ঘোরে দুয়ারে দুয়ারে

পুলিশ-ডিবি-র‌্যাব-সিআইডিতে ঘুরপাক খায় তদন্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

তোলপাড় করা সাংবাদিক-দম্পতি সাগর-রুনি ও তনু-মিতু হত্যাকাণ্ডের নথিপত্র শুধুই ঘুরছে থানা-পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব আর সিআইডিতে। কিন্তু তদন্ত শেষ হচ্ছে না, নথি ঘোরাও বন্ধ হচ্ছে না। ফলে মামলারও গতি হচ্ছে না।

এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন হয়, কিন্তু তদন্ত এগোয় না। কোনো একটি জায়গায় এসে তদন্ত পুরো থমকে যাচ্ছে। ফলে কারা এবং কী কারণে এই খুনের ঘটনাগুলো ঘটাল—এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। অথচ ঘটনার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলে এসেছে, খুনিরা গ্রেফতার হবে যখন-তখন। সব প্রশ্নের জবাব মিলবে শিগগিরই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চার বছরেও সাগর-রুনি হত্যার কোনো আসামি যেমন ধরা পড়েনি, তেমনি নয় মাসেও ধরা পড়েনি কুমিল্লার কলেজছাত্রী তনু হত্যার আসামিরা। একই পথে যাচ্ছে পাঁচ মাস আগে চট্টগ্রামে খুন হওয়া পুলিশের সাবেক এসপি বাবুলের স্ত্রী মিতুর ঘটনাও। এখনো রহস্যের ঘেরাটোপে রয়েছে মামলাগুলোর তদন্ত। কোনো কোনো সূত্র মতে, খুনের ঘটনায় যতটুকু রহস্যের সৃষ্টি করেছে, তার চেয়ে বেশি রহস্য রয়েছে পুলিশের ভূমিকায়।

মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি না হলেও অন্তহীন অপেক্ষায় রয়েছেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা। ন্যায় বিচারের আশা ছাড়েননি এখনো। তারা কেবলই আশার প্রহর গুনছেন। তাদের এখনো বিশ্বাস, কোনো একদিন হয়তো খুনের রহস্য উন্মোচিত হবে। খুনিরা ধরা পড়বে, বিচার হবে।

পুলিশ বলছে, স্পর্শকাতর এসব খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তদন্তের এমন কোনো পর্যায় নেই, তা তারা প্রয়োগ করেননি। কিন্তু এখনো তারা খুনিদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারেননি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো ক্লু-লেস মার্ডার অর্ধেক ডিটেক্ট হয়েছে আর অর্ধেক হয়নি—এমন নজির নেই। ক্লু-লেস মার্ডার ডিটেক্ট হলে আদ্যোপান্ত হয়। কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতুর হত্যাকারীচক্রের ৩ সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তারপরও আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড রহস্যের ঘেরাটোপে রয়ে গেল! এমনটি বিস্ময়কর! কুমিল্লার তনু হত্যা মামলা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একেকজন একেক ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।

সাগর-রুনি হত্যা মামলা : ২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতের কোনো এক সময় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানাধীন পশ্চিম রাজাবাজারের শাহজালাল প্রপার্টিজ নির্মিত রশিদ লজের ৫৮/এ/২ নম্বর ৬ তলা বাড়ির চতুর্থ তলার এ-৪ নম্বর ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সরোয়ার হোসেন সাগর ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনিকে। ওই সময় বাসায় সাগর-রুনির একমাত্র  ছেলে মেঘ ছিল। পরবর্তীতে তার মাধ্যমেই সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি পরিবার জানতে পারে। এ ব্যাপারে  শেরেবাংলা নগর থানায় রুনির ভাই রুমান বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১৯ মে হাইকোর্টের নির্দেশে বর্তমানে মামলাটি র‌্যাব তদন্ত করছে। তদন্তের ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৬ মে ভিসেরা আলামতের জন্য সাগর-রুনির লাশ কবর থেকে ওঠানো হয়। লাশ থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়। চাঞ্চল্যকর মামলাটির উন্নত তদন্তের জন্য ওই বছরের ১২ জুন প্রথম দফায় ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত আলামত হিসেবে জব্দ করা একটি ছুরি, ছুরির বাঁট, সাগরের জুতোর মোজাসহ পরনের প্যান্ট এবং রুনির পরনের প্যান্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফোকল্যান্ড ফরেনসিক ও ডিএনএ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ওই বছরের ১৭ জুলাই হত্যাকাণ্ডের সময় যে কাপড় দিয়ে সাগরের হাত ও পা বাঁধা ছিল, সেই কাপড় এবং রুনির টি-শার্ট পাঠানো হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই একই পরীক্ষাগারে। প্রথম দিকে হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে বাড়িটির নিরাপত্তারক্ষী হুমায়ুন কবির ওরফে এনামুল হককে (২৩) শনাক্ত করা হয়। তাকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এনামুল র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারও হয়। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে পাঠানো সব আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট তাদের কাছে এসেছে। সে সব রিপোর্টের পর্যালোচনা চলছে। পর্যালোচনায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মামলার তদন্ত এগুচ্ছে। যদিও তদন্ত নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন মামলার বাদী নওশের আলম রুমান। তিনি বলেন, প্রতিবারই আশার কথা শুনি। কিন্তু সে আশার কথা বাস্তবে কবে রূপ নেবে তা অজানা।

তনু হত্যা : চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ওই রাতেই কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভিতরের ঝোপ থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। লাশের ময়নাতদন্ত হয় পরদিন। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা মির্জানগর গ্রামে দাফন করা হয়। ময়নাতদন্ত নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে আদালতের নির্দেশে ২৮ মার্চ লাশ তুলে দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। পরবর্তী সময়ে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। ওই সময় লাশ থেকে ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। গত ১ এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তরিত হয়। গত মে মাসে ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে পায় সিআইডি। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহমেদ। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, তনুর পোশাক থেকে ধর্ষণের আলামতসহ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগৃহীত আলামতে তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা পাওয়া গেছে। কিন্তু ওই তিন ব্যক্তি কে তা এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তদন্তের স্বার্থে তনুর মা-বাবাসহ পরিবারের অনেকের সঙ্গেই একাধিকবার কথা বলা হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তনুর মা সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তির সঙ্গে আলামত হিসেবে পাওয়া ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন। মামলার তদারক কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলার দায়িত্বে থাকা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ব্যারিস্টার মোশারফ হোসেন বলেন, মামলার তদন্ত সঠিকভাবেই এগুচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলাটির তদন্ত চলছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আশা করছি, স্বল্প সময়ের মধ্যেই মামলাটির তদন্তে আরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে। যদিও তনুর পিতা মামলার বাদী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন মামলার তদন্ত নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘তদন্তের কোোন কিছুই ঠিক পাচ্ছি না।’

মিতু হত্যা : গত ৫ জুন সকালে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু চট্টগ্রামের জিইসি মোড়ে একমাত্র ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একটি মোটরসাইকেলে তিন যুবক মিতুকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় এক হত্যাকারী মিতুর ছেলেকে একপাশে সরিয়ে রাখে। ঘটনার সময় এসপি পদে পদোন্নতি পাওয়া বাবুল আক্তার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে যোগদান করতে এসেছিলেন। স্ত্রী হত্যার পর থেকেই তিনি রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন মেরাদিয়ার ভুঁইয়াপাড়ার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর অঞ্চলের ২২০/এ নম্বর দোতলা বাড়িটিতে অবস্থান করছেন।

এদিকে ঘটনার পর চট্টগ্রামে ১৮ কেজি সোনার চালান ধরা, জঙ্গিদের সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গি নিহত হওয়ার জের ধরে জঙ্গি অথবা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রতিশোধ হিসেবে বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করা হতে পারে বলে প্রচার পায়। ওই সময় ব্যাপক অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার হয় ছাত্রশিবিরের সাবেক কর্মী আবু নসুর গুন্নুু (৪৬), ইব্রাহিম, শাহ জামান ওরফে রবিন (২৮), নসুর, রবিন,  জেএমবি সদস্য বুলবুল আহমেদ ওরফে ফুয়াদসহ অনেকেই। পরবর্তীতে দুজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারাও যায়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও আনোয়ার হোসেন নামে দু’জন হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ২৬ জুন আদালতে জবানবন্দি দেয়।

পুলিশ সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুসার নাম আসে। মুসা রাঙ্গুনিয়ার ছাত্রলীগ নেতা রাশেদ হত্যাসহ ছয় মামলার আসামি। সে বাবুল আক্তারের সোর্স। মিতু হত্যাকাণ্ডের অস্ত্রের জোগানদাতা হিসেবে গ্রেফতারকৃত এহতেশামুল হক ভোলাও পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের সোর্স হিসেবে পরিচিত।

এদিকে বাবুল আক্তারকে গভীর রাতে শ্বশুরবাড়ি থেকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে টানা প্রায় চৌদ্দঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করায় মিতু হত্যাকাণ্ডের মোড় ঘুরে যায়। স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাবুল আক্তার জড়িত বলে বিভিন্ন সময় প্রকাশ পায়। যদি বাবুল আক্তার ও তার স্ত্রীর পরিবার এমন তথ্য ভিত্তিহীন বলে দাবি করে আসছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর