শিরোনাম
রবিবার, ৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

হিজড়াদের অত্যাচার চরমে

চাঁদাবাজি

সাঈদুর রহমান রিমন

নকল হিজড়া, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন অপরাধীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘হিজড়া গ্রুপের’ অত্যাচারে নাগরিক জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রাজধানীর সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিজড়া বাহিনী। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নামে বিভক্ত হয়ে অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে সর্বত্র চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছে তারা। এ ছাড়া শিশু নাচানোর নাম করে বাসাবাড়ি থেকেও জোর করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। হিজড়াদের বেশি অত্যাচার চলছে উত্তরা, গুলশান, ভাটারাসহ কয়েকটি থানা এলাকায়। তারা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে বাসাবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসা কেন্দ্র, এমনকি অফিসেও হানা দিচ্ছে। ধার্য করে দিচ্ছে চাঁদার টাকা। টাকা দেওয়ার সময় পর্যন্ত বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে টাকা না দিলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাচ্ছে তারা। অশ্রাব্য গালাগাল, নগ্ননৃত্য প্রদর্শন, ভাঙচুর চালানো, মারধরসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে হিজড়ারা। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেও কোনো সুফল পাওয়া যায় না। এ জন্য তারা দিন দিনই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অন্যদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হিজড়াদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বিঘ্ন চাঁদাবাজিতে অল্প সময়েই ধনাঢ্য হয়ে ওঠার বাসনায় ইদানীং কিছু পুরুষ অপারেশনের মাধ্যমে নকল হিজড়ায় পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে একশ্রেণির পতিতাও হিজড়া সংগঠনে ঢুকে পড়েছে। সাজগোজ করে তারাও হিজড়া হয়ে যাচ্ছে। এসব ভুয়া ও নকল হিজড়াদের অত্যাচার মাত্রাতিরিক্ত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এলাকার আধিপত্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে মাঝেমধ্যেই হিজড়া গ্রুপগুলো সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এসব বিরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তরায় এক ডজনেরও বেশি মামলা ও জিডি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, হিজড়ারা রাতের বেলায় ছিনতাই, মাদক সেবন ও বিক্রিসহ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। সুযোগ বুঝে এরা পথচারী, রিকশারোহীদের টাকা ও মোবাইল সেট জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

কোটিপতি হিজড়া : হিজড়াদের মধ্যে কারও কারও রয়েছে অঢেল সম্পদ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের আশ্রয়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছে অনেক হিজড়া। খিলক্ষেত এলাকায় দলনেতা নাজমার অধীনে রয়েছে ৪০ জন হিজড়া। ৩০ বছর আগে অপারেশন করে হিজড়া হয়েছে নাজমা। তার প্রায় অর্ধকোটি টাকা বিভিন্ন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর কাছে সুদে লাগানো আছে। খিলগাঁও তিলপাপাড়ার ময়নাও কয়েক বছরের ব্যবধানেই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনেছেন। ময়না দক্ষিণ গোড়ান সিদ্দিকবাজার এলাকায় পাঁচতলা বাড়ির মালিক। কয়েক কোটি টাকা দামে আরেকটি বাড়ি কেনার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এভাবে বৈধ আয় ছাড়াই কীভাবে ময়না-নাজমারা কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে। ধলপুর এলাকার আবুল হিজড়া দুটি বাড়ি ও কয়েক কোটি টাকার মালিক। দক্ষিণখান থানার মধ্য ফায়দাবাদ এলাকার দলনেতা রাহেলা হিজড়াও মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি করে টাকার পাহাড় গড়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

উত্তরায় বড়ই বেপরোয়া : উত্তরার ভুক্তভোগী কয়েকজন জানান, হিজড়ারা সন্ধ্যার দিকে সাজগোজ করে নানা পয়েন্টে শিকারের আশায় থাকে। এদের মধ্যে টঙ্গীর স্টেশন রোড মাছিমপুর এলাকায় কাকলী হিজড়া, অঞ্জনা ও আলাদীর বাড়ি রয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণখানের ফায়দাবাদ, কাঁঠালতলা, কোর্টবাড়ী, আজমপুর কাঁচাবাজার, কসাইবাড়ী, আশকোনা এলাকায় ৩০-৪০ জন পুরুষ ও মহিলা হিজড়া বসবাস করে। এদের মধ্যে ফায়দাবাদ ও কাঁঠালতলা এলাকায় রাহেলা, স্বপ্না, সুমি, প্রেমা, ঊর্মি ও কল্পনা হিজড়ার বাড়ি রয়েছে। হিজড়াদের প্রধান গুরু হিসেবে পরিচিত রাহেলা হিজড়ার আলিশান বাড়ি রয়েছে দক্ষিণখানে। বাড়িটি হিজড়াদের মূল ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে তুরাগের কামারপাড়া, রাজাবাড়ী, ধউর, রানাভোলা ও বাউনিয়া এলাকায় ৩০-৩৫ জন হিজড়ার অবস্থান রয়েছে। তাদের গ্রুপ লিডার হচ্ছে আপন হিজড়া।

রাজধানীতেই চাঁদা দুই কোটি : তদন্ত দলের সদস্যরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, শুধু রাজধানীতেই চিহ্নিত ৩০ গ্রুপের হিজড়া সদস্যরা প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি টাকার চাঁদাবাজি করে। ফুটপাথের পান-বিড়ির দোকান থেকে শুরু করে আধুনিক শপিং মলের বড় ব্যবসায়ীরাও চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পান না। গাবতলী টার্মিনাল, সায়েদাবাদ টার্মিনাল, যাত্রাবাড়ী বাজার, কারওয়ান বাজার, চকবাজার, শ্যামবাজারসহ শতাধিক পয়েন্ট রয়েছে চাঁদাবাজির। দোকানপ্রতি ১০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত ‘দৈনিক চাঁদা’ আদায় করা হয়। এ ছাড়া নগরবাসীর জন্ম, বিয়ে বা অন্য যে কোনো অনুষ্ঠান কোনো কিছুই হিজড়াদের চাঁদার হাত থেকে রেহাই পায় না।

ভারতীয় হিজড়াদের অনুপ্রবেশ : হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন (এইচআরএইচএফ) নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন সম্প্রতি রাজধানীতে হিজড়াদের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। তাদের অনুসন্ধানে বলা হয়, দুই শতাধিক ভারতীয় হিজড়া ক্যাডার খোদ রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছে। তারা পুরান ঢাকার মাহুতটুলী, শ্যামপুর, চকবাজার, শ্যামবাজার, যাত্রাবাড়ী, সূত্রাপুর ও গেন্ডারিয়ার বিভিন্ন পয়েন্টে রীতিমতো ঘাঁটি গড়ে তুলেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মানবাধিকার সংগঠনটির অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, নানা জরিপে দেশে ২০ সহস্রাধিক হিজড়া থাকার কথা উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত হিজড়ার সংখ্যা খুবই কম।

অভ্যন্তরীণ বিরোধ : রাজধানীতে চাঁদাবাজি ও এলাকার আধিপত্য নিয়ে সম্প্রতি হিজড়া সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। হিজড়ারা কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পারস্পরিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে শ্যামবাজার, মাহুতটুলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, বাড্ডাসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে হামলা, মারধর ও সংঘর্ষে নেত্রী দিপালীসহ অন্তত ৩০ জন হিজড়া জখম হয়েছে। আহত হিজড়া সুইটি, নীহার, টুম্পা, সীমা, নদী, চুমকি, রীতু, আঁখি, সুন্দরী, স্বপ্নাসহ কয়েকজন জানান, প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া প্রকৃত হিজড়ারা এখন হিজড়াবেশী পুরুষ মেজবাহ-রমজান চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গচ্ছেদ করে কৃত্রিমভাবে হিজড়ায় রূপান্তর হওয়া পুরুষরা জোট বেঁধে প্রকৃত হিজড়াদের ওপর জোরজুলুম ও নির্যাতন চালাচ্ছে। এসব নিয়ে রাজধানীর ১৭টি থানায় হিজড়া গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্তত ৩০টি মামলা রয়েছে।  চক্রের সদস্যরা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে রাস্তার মোড়, বাজারমুখ, বাসস্ট্যান্ডসহ অলিগলিতে ওতপেতে থাকে। এসব স্থানে একাকী কোনো পথচারীকে পেলেই নানাভাবে নাস্তানাবুদ করাসহ ছিনতাই চালায় তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষরা অতীতে বিভিন্ন রাজদরবারে নিরাপত্তা প্রহরীসহ নানা পদে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। ভারতেও পুলিশ বাহিনীতে তাদের নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে তাদের কাজে লাগানোর তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। তৃতীয় লিঙ্গের এই ব্যক্তিরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে উৎপাত করছে। এসব পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের প্রশিক্ষিত করে কাজে লাগালে তারা সম্পদ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর