সিলেটে পাথর কোয়ারিগুলোয় কিছুতেই থামছে না মৃত্যুর মিছিল। পাথরখেকোদের তাণ্ডবে কোয়ারিগুলোতে শ্রমিকদের মৃত্যু যেন এখন নৈমিত্তিক ঘটনা। গেল বছর বিভিন্ন কোয়ারি থেকে এবং টিলা কেটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে প্রাণ হারান অন্তত ৩৫ জন শ্রমিক। এ বছরের শুরুটাও হয়েছে একসঙ্গে পাঁচ পাথরশ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনা দিয়ে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, পাথর উত্তোলনে রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা জড়িত, যে কারণে এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটের ভোলাগঞ্জ, জাফলং, লোভাছড়া, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দিসহ বেশ কয়েকটি পাথর কোয়ারি থেকে অবৈধভাবে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে পাথর উত্তোলন করছে। সরকারের পালাবদলের সঙ্গে পাথরখেকো চক্রের নেতৃত্বেও আসে
পরিবর্তন। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, সে দলের স্থানীয় নেতারাই হয়ে ওঠেন পাথরখেকো চক্রের মূল হোতা। এ জন্য কোয়ারিগুলোতে শ্রমিকদের প্রাণহানি অব্যাহত থাকলেও ক্ষমতাসীন দলের দাপটে পার পেয়ে যায় পাথরখেকোরা। পরিবেশ ধ্বংস করে চলতে থাকে তাদের তাণ্ডব। সিলেট জেলা ও পুলিশ প্রশাসন হঠাত্ হঠাত্ অভিযান চালায় কোয়ারিগুলোতে। পুড়িয়ে দেয় পরিবেশবিধ্বংসী বোমা মেশিন। কিন্তু অভিযানের দুই-তিন দিন পর থেকেই ফের সক্রিয় হয়ে ওঠে পাথরখেকোরা। ফলে মৃত্যুর মিছিল থামছে না কিছুতেই। মঙ্গলবার বিকালে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে সাত্তার মিয়া, হেলাল মিয়া, আলীম উদ্দিন, নান্নু মিয়া ও খালেক গংদের গর্ত থেকে পাথর উত্তোলনকালে প্রাণ হারান পাঁচ শ্রমিক। এর আগে গত বছর ২৩ জানুয়ারি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলা কেটে পাথর উত্তোলনের সময় ভূমি ধসে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। একই টিলা থেকে পাথর উত্তোলনকালে গেল বছর আরও অন্তত ছয় শ্রমিক প্রাণ হারান।
এ ছাড়া গত বছরের বিভিন্ন সময় লোভাছড়া, বিছনাকান্দি, জাফলং পাথর কোয়ারিতে মারা যান আরও অন্তত ২৪ জন শ্রমিক।এদিকে মঙ্গলবার পাঁচ পাথরশ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৬ জনকে আসামি করে নিহত জহুর আলীর মেয়ে জকিরুন বেগম গতকাল মামলা করেছেন বলে জানিয়েছেন গোয়াইনঘাট থানার ওসি (তদন্ত) হিল্লোল রায়। ওই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বর্তমানে আরেক মামলায় কারাগারে থাকা সাত্তার মিয়াকে। পুলিশ শাহাব উদ্দিন নামের একজনকে গ্রেফতার করেছে। এ ছাড়া ওই ঘটনায় কাল সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আমিনুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিবেশ ধ্বংস করে সিলেটে বিভিন্ন কোয়ারিতে চলছে পাথর উত্তোলন। পাথরখেকোদের তাণ্ডবে ধ্বংসের মুখে প্রকৃতিকন্যা খ্যাত জাফলং। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম কিম বলেন, পরিবেশ ধ্বংস করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের নেপথ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। ফলে প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নিতে চায় না। মাঝে মধ্যে দুই-একটি অভিযান চালানো হলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জেলা ও পুলিশ প্রশাসন কোয়ারিগুলোতে অভিযান চালালেও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। পরিবেশবিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে জনতার সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা প্রয়োজন।
এদিকে যারা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে গতকাল গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছে বেলা, বাপা, সনাক, ব্লাস্টসহ আটটি সংগঠন।