বুধবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পলিথিনে সয়লাব ঢাকা দেখার কেউ নেই

জিন্নাতুন নূর

পলিথিনে সয়লাব ঢাকা দেখার কেউ নেই

ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঢাকায় বসবাসরত একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ব্যবহার করে চারটি পলিথিন। এ হিসাবে প্রতিদিন শুধু ঢাকায় ব্যবহৃত হয় দুই কোটিরও বেশি নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ। বর্তমানে সাধারণ মুদিদোকান, বাজার, শপিং সেন্টার, লাইব্রেরি, ফুটপাথের দোকান এবং রেস্টুরেন্টসহ সর্বত্রই পণ্য বিক্রিতে ব্যবসায়ীরা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিব্যাগ ব্যবহার করছেন। বলা যায়, আইন উপেক্ষা করে রাখঢাক না করেই এই ব্যবসায়ীরা পলিথিন ব্যবহার করছেন, এমনকি সচেতন ক্রেতারা আইন আমলে না নিয়ে পণ্য ক্রয়ের সময় বিক্রেতার কাছে পলিথিনের ব্যাগই চাইছেন। এতে করে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি, ডোবা-নালা, ড্রেন, নর্দমা এখন ফেলে দেওয়া পলিথিন ব্যাগে সয়লাব। পানির প্রবাহ আটকে গিয়ে তৈরি হয়েছে জলাবদ্ধতা। পরিবেশবিদদের মতে, যত্রতত্র পলিথিন নিক্ষেপের ফলে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পানি, মাটি ও বাতাস। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চর্মরোগে। এ ছাড়া পলিথিনের অবাধ ব্যবহারের কারণে ঢাকার ড্রেনেজ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাও দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারিভাবে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা এবং একই বছর ৮ এপ্রিল সারা দেশে এইচডিপিই (হাইয়ার ডেনসিটি পলি ইথালিন) পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধনী ২০১০) অনুযায়ী নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের অপরাধে সর্বোচ্চ দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশ অধিদফতরের পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, সততা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণেই বর্তমানে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। পলিথিন ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে মিরপুর এক নম্বর কাঁচাবাজারের এক মাছ বিক্রেতা বলেন, ‘কাস্টমার পলিথিন ছাড়া মাছ নিতে চায় না। এ জন্য আমরাও পলিথিনের ব্যাগে মাছ বিক্রি করি।’ নগরীর আরও কয়েকটি কাঁচাবাজারের পণ্য বিক্রেতা ও দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্রেতারা মাছ-মাংস কেনার পর তা পলিথিনের ব্যাগে করেই বাড়িতে নিয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অধিকাংশ ক্রেতা নেটের ব্যাগ বা পাটের ব্যাগের পরিবর্তে পলিথিনের ব্যাগেই পণ্য নিতে চান। মিরপুর ১০ নম্বরের এক ফল বিক্রেতা জানান, ক্রেতারা পলিথিনের ব্যাগ ছাড়া ফল কিনতে চায় না। পলিব্যাগ রাখলে মাঝে-মধ্যে পুলিশ ঝামেলা করে কিন্তু না রাখলে ব্যবসার ক্ষতি হয়। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্য, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। যার বেশির ভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। শুধু পুরান ঢাকার অলিগলিতে আছে নিষিদ্ধ ৩০০ কারখানা। সংস্থাটির দেওয়া তথ্য, কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশকিছু কারখানা আছে। আর যাত্রাবাড়ী থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে শতাধিক কারখানা। আর ঢাকার পলিথিন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আছে একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। পলিথিন বাজারজাতকরণে ‘পরিবহন সিন্ডিকেট’ নামে আরেকটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কাজ করছে। সিন্ডিকেটটি এই পলিথিনগুলো পরে ‘জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত’ লেখা ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছে। এমনকি পণ্য বহনে পরিবেশবান্ধব পাটজাত ব্যাগ ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা থাকলেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ, উৎপাদন, মজুদ, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য কিছু পণ্য, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণু পোনা পরিবহন ও মাশরুম চাষের জন্য পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে কিছু ব্যবসায়ী পলিথিন ব্যাগ তৈরি করছে। তবে পুরান ঢাকায় পলিথিন তৈরির কারখানাগুলো সম্পর্কে  তথ্য জানলেও স্থানীয় বাসিন্দারা ঝামেলা এড়াতে পুলিশ ও প্রশাসনের লোকদের কাছে লুকানো কারখানা সম্পর্কে কিছু জানাতে চান না।  ইসলামবাগের পলিথিন ব্যবসায়ী মো. মোস্তফা কামাল খান জানান, শুধু ইসলামবাগেই রয়েছে শতাধিকের ওপর পলিথিন কারখানা। এ ছাড়া চকবাজার এলাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ পলিব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল দেওয়ার আগেই ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়। ফলে আগেই তারা কারখানা বন্ধ করে দেন। মোস্তফা কামাল বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত মাসোয়ারা দেওয়ার মাধ্যমেই ব্যবসায়ীরা এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর সাধারণ সম্পাদক ড. আবদুল মতিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরের গৃহস্থালির ময়লা-আবর্জনাসহ অনান্য বর্জ্য পদার্থের অধিকাংশ পলিথিনে করে যত্রতত্র ফেলা হয়। এই বর্জ্য পরে পার্শ্ববর্তী ড্রেন ও নালা-নর্দমায় পড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।

সর্বশেষ খবর