শুক্রবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আলো ছড়াচ্ছে ‘স্বপ্নপূরণ বিদ্যানিকেতন’

মা-ছেলে একই স্কুলের শিক্ষার্থী

রাহাত খান, বরিশাল

আলো ছড়াচ্ছে ‘স্বপ্নপূরণ বিদ্যানিকেতন’

সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ‘স্বপ্নপূরণ বিদ্যানিকেতন’ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগ যখন ফেসবুক আর ইন্টারনেটে আসক্ত, ঠিক সেই সময় নীরবে-নিভৃতে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন বরিশালের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একদল উদ্যমী শিক্ষার্থী। কারও প্ররোচনা কিংবা উৎসাহ ছাড়াই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে উচ্ছ্বাস নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে বরিশালের স্টেডিয়াম বস্তির (বঙ্গবন্ধু কলোনি) শিক্ষার আলো বঞ্চিত নারী ও শিশুদের অক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন করে তোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। ‘স্বপ্ন দেখি-স্বপ্ন দেখাই’ স্লোগান নিয়ে গত ২৬ মার্চ থেকে উচ্ছ্বাসের ‘স্বপ্নপূরণ’ বিদ্যানিকেতনের যাত্রা শুরু। বর্তমানে তাদের কাছে প্রতি সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার বিকালে ক্লাস করছেন অর্ধ শতাধিক নিরক্ষর নারী এবং শতাধিক শিশু। ছোটবেলায় নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হতে না পারলেও পড়ন্ত বেলায় এসে নিজের নাম লেখাসহ ‘অ আ ক খ, ১ ২ ৩’ শিখতে পেরে গর্বিত সুবিধাবঞ্চিত নারীরা। আর শিশুরা স্বপ্ন দেখছে বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার। শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বরিশালের উদ্যমী শিক্ষার্থীরা সারা দেশের জন্য অনুকরণীয় হতে পারেন বলে মন্তব্য করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর। 

মা ও ছেলে একই স্কুলের শিক্ষার্থী : নগরীর চাঁদমারী মাদ্রাসা রোডে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন আর চটের ওপর বসে একপাশে আদর্শলিপি শিখছেন স্টেডিয়াম বস্তির বাসিন্দা রিকশা চালক আজিবর রহমানের স্ত্রী ত্রিশোর্ধ্ব হালিমা আক্তার ইতি। অপর পাশে আদর্শলিপি শিখছে তার ৫ বছর বয়সের ছেলে আবদুল কাদির আল আরাফ। ছোটবেলায় লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও মধ্য বয়সে লেখাপড়া শিখতে পেরে আনন্দিত ইতি। ক্লাসের পড়া বাসায় গিয়ে ছেলের সঙ্গে পুনরাবৃত্তি করেন তিনি। এতে তিনি এবং তার ছেলে দুজনই উপকৃত হচ্ছেন বলে জানান ইতি। ইতির মতো ওই বস্তির অর্ধ শতাধিক সুবিধাবঞ্চিত নারী প্রতি সপ্তাহের দুই দিন ক্লাস করছেন। নিজের নাম লেখাসহ শিখছেন আদর্শলিপি, নামতাসহ হিসাব কিতাব। ওই স্কুলের শিক্ষার্থী পঞ্চাশোর্ধ্ব আকলিমা বেগম জানান, ছোটবেলায় পড়ালেখার সুযোগ পাননি। নিজের নামটাও লিখতে পারতেন না। এই স্কুলে এসে অ আ ক খ এবং ১ ২ ৩ লেখাসহ শিখেছেন হিসাব-কিতাব। এই শিক্ষা তিনি তার বাসায় সন্তানদেরও শেখাতে পারবেন।

 গৃহস্থালি কাজকর্ম ফেলে এবং সময় নষ্ট করে এই স্কুলে এসে কিছু শিখতে পেরে লাভবানই হচ্ছেন বলে তিনি জানান। ষাটোর্ধ্ব শিক্ষার্থী জরিনা বেগম জানান, আগে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের স্কুলে এসে কিছু শিখতে পেরে আনন্দে তার মনটা ভরে যাচ্ছে। তিনি এই স্কুলের উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ জানান। পঞ্চাশোর্ধ্ব জ্যোত্স্না বেগম জানান, এই স্কুলে পড়ানোর জন্য আগে তাদের সন্তানদের নাম নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। তখন তিনিও লেখাপড়া শেখার আবদার করেন তাদের কাছে। স্যারেরা খুশি হয়ে তাদেরও পড়াতে শুরু করেন। এখন তিনি অনেক কিছুই লিখতে এবং পড়তে পারেন বলে জানান। শিশুসন্তান কোলে নিয়ে ওই স্কুলে পড়তে আসেন স্টেডিয়াম বস্তির শিরিন বেগম। তিনি বলেন, আগে নামটাও লিখতে পারতেন না। এখন নাম লিখতে পারেন। ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনতে পারেন। এই শিক্ষা তিনি তার শিশুসন্তানকেও শেখাতে পারবেন। বাজারঘাট করতে গেলে টাকা গুনে আনতে পারবেন। একই বস্তির মুক্তা বেগম জানান, আগে লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। এই স্কুলে এসে অনেক কিছু শিখেছেন। বিনা খরচে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে তিনি এবং তার মতো অনেকেই উপকৃত হয়েছেন। বস্তির ৬৫ বছর বয়স্ক ফিরোজা বেগম বলেন, ছোটবেলায় বড়ওয়ানে পড়ার সময় বাবা মারা যায়। এরপর আর পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। এই স্কুলে এসে অ আ নামতা শিখে অনেক উপকার হচ্ছে। স্কুলে আসতে লজ্জা-শরমের কোনো বিষয় নেই বরং শিখতে ভলো লাগছে। 

বয়স্ক নারীদের পাশেই পলিথিনের ওপর বসে পড়াশোনা করছে শতাধিক শিশু। তাদের একজন ইয়াসিন আরাফাত বলে, এই স্কুলে লেখাপড়া, আদব-কায়দা এবং ভালো কাজ করতে শেখানো হয়। বড় হয়ে আমি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখি।

শিশু সুমাইয়া জানায়, এই স্কুলে এসে লেখাপড়ায় অনেক উন্নতি  হয়েছে তার। শুধু লেখাপড়াই নয়, মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে, গুরুজনের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে- সবই শেখানো হয় এই স্কুলে। ‘ঘোরাফেরা খেলাধুলা বাদ দিয়ে এই স্কুলে এসে লাভ নাকি ক্ষতি হলো’- জানতে চাইলে শিশু সুমাইয়ার উত্তর- ‘তাহলে তো কিছু শিখতে পারতাম না, বড় হতে পারব না। এখন লেখাপড়া শিখেই বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখি।’

‘স্বপ্নপূরণ’ স্কুলে পড়ানো হয় নারী ও শিশুদের। কিন্তু নিরক্ষর পুরুষদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে। তাই স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা সত্তর ছুঁই ছুঁই আবদুল মজিদ হাওলাদার সপ্তাহের দুই দিন এসে বসে থাকেন স্কুলের পাশে। অন্যদের দেওয়া শিক্ষা দূর থেকে আয়ত্তে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। তিনি জানান, শিক্ষাবিদ্যা জীবনে কিছুই পারছিলেন না। এই স্কুল থেকে নাম-দস্তখত এবং অফিস আদালতের কাজ সারতে পারেন মোটামুটি। তিনি এই স্কুলের উদ্যোক্তাদের মনভরে দোয়া করেন সৃষ্টিকর্তার কাছে।

স্বপ্নপূরণ বিদ্যানিকেতনের অন্যতম উদ্যোক্তা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমেস্ট্রি এবং বায়ো টেকনোলজি বিভাগের ছাত্রী মৌরি বিনতে আজাদ বলেন, লেখাপড়ার প্রয়োজনে পরিবার-পরিজন ছেড়ে একা থাকি। প্রতি সপ্তাহের ক্লাসে এসে মায়ের বয়সীদের কিছু শেখাতে পেরে আত্মতৃপ্তি বোধ করি। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তানজিলা বিশ্বাস মুনা বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখন ফেসবুক ইন্টারনেট নিয়ে পড়ে থাকেন। ওরা থাকুক ফেসবুক-ইন্টারনেট নিয়ে। নিরক্ষর মানে কালার ব্লাইন্ড।’ কেউ কেউ বলেন, তারা সমাজের অন্ধকার দূর করছেন, না তারা অন্ধকার দূর করছেন না। তারা কিছু মানুষের জীবনে রং দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের কালার ব্লাইন্ড দূর করতে পারাটা অনেক আনন্দের বলে তারা জানান।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মমিন ইউ আহম্মেদ, ইয়াসিনুর রহমান এবং সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের ছাত্র সাদমান রেজোয়ান জানান, বিভিন্ন বয়সের নারী ও শিশুদের পড়ানো একটা চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তাদের অনেকেই ক্লাসে এসে ঘাবড়ে যায়, পারব না পারব না বলে চলে যেতে চায়। তাদের বোঝানো হয় যে, আপনি পারবেন, তাদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। অনেক কষ্ট করে তাদের শেখাতে হয়। তারপরও কিছু শেখাতে পেরে তারা আনন্দিত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আল আমিন জানান, যারা লিখতে পারেন না তাদের হাত ধরে লেখা শেখানো হয়, কেউ কেউ পড়াচ্ছেন শিশুদের। শিশুদের মধ্যে আবার যারা দুর্বল তাদের আলাদা করে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আবার তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পুরস্কারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

প্রতিবন্ধকতা : স্বপ্নপূরণ বিদ্যানিকেতনের রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। বসার ব্যবস্থা এবং শিক্ষা উপকরণসহ তাদের রয়েছে নানা সংকট। ছাত্র হওয়ায় নিজেদের টাকায় এর বেশি উপকরণ কিনে দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন উচ্ছ্বাসের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র প্রসেনজিৎ কুমার সাহা বলেন, যাদের দেওয়া রাজস্বের টাকায় তারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন সেই মানুষদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? তাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের এই উদ্যোগ।

শুধু শিক্ষা নয়, বছরের বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবের সময় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে খাবার এবং পোশাকও বিতরণ করে থাকেন তারা। এখন তারা নিজেরা চাঁদা তুলে প্রতি মাসে একজন দুজন করে স্বাবলম্বী করার প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।

শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এস এম ইমামুল হক। তিনি বলেন, ফেসবুক, ইন্টারনেট নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকেন, তারা হলো সেলফ ওরিয়েন্টেড। তারা সামাজিক চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তারা নিজেদের নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। অন্যের কথা চিন্তা করেন না। বরিশালের তরুণ শিক্ষার্থীরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন- এটি যদি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সমাজ আরও ভালোভাবে এগিয়ে যাবে। সমাজের বঞ্চিত গোষ্ঠী উপকৃত হবে।

২০১৭ সালের ৬ মে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন উচ্ছ্বাসের পথ চলা শুরু হয়। ওই সংগঠনের উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চলতি বছরের ২৬ মার্চ শুরু হয় ‘স্বপ্নপূরণ বিদ্যানিকেতনের’ যাত্রা।

সর্বশেষ খবর