মঙ্গলবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সরকারি চিকিৎসাযন্ত্রের সুবিধা পাচ্ছেন না রোগী

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি হাসপাতালে রোগ পরীক্ষার যন্ত্রগুলো বেশিরভাগই অকেজো থাকে। আবার কিছু কিছু যন্ত্র খোলাই হয় না বছরের পর বছর। অনেক ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি চালানোর মতো টেকনিশিয়ান থাকে না। আবার টেকনিশিয়ান থাকলেও থাকে না প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। এসব কারণে ঢাকার প্রায় সব সরকারি বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রসহ সারা দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সুযোগ-সুবিধা রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না। ফলে ন্যূনতম রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্যান্সার নির্ণয় পর্যন্ত যাবতীয় টেস্টের জন্য রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপরই নির্ভরশীল হচ্ছে।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রায় ১২ কোটি টাকা দামে কেনা ল্যাসিক মেশিনটি রোগীদের চিকিৎসার কাজে লাগছে না। চাহিদা না থাকলেও তিন বছর আগে ডিজিটাল কম্পিউটারাইজ রেডিওগ্রাফি নামে একটি মেশিন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কোটি টাকা মূল্যের ওই মেশিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তরের পর থেকেই অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চারটি লাইনাক মেশিনের একটি পড়ে আছে বিকল হয়ে। অন্য তিনটি লাইনাক ও দুটি কোবল্ট মেশিন চালানো হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর কোবল্ট মেশিনগুলো ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো এবং অনেকটা নিম্নমানের হওয়ায় এগুলো দিয়ে রোগীর প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। রাজধানীর একটি অন্যতম চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেশির ভাগ সময়ই বিকল থাকে জরুরি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনসহ অন্যান্য সব মেশিন ডিজিটাল হলেও সেগুলো অনেক আগের। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের বেশির ভাগ চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসাসেবার নামে হাসপাতালের বাইরের প্যাথলজিক্যাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে রোগীদের পাঠিয়ে দেন। হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি বছরের পর বছর ধরে নষ্ট থাকে বলে কর্মচারীরা জানিয়েছেন। বর্তমানে সিটিস্ক্যান ও ক্যাথল্যাব মেশিনটিও বিকল হয়ে গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইকো মেশিন কখনো সচল কখনো অচল। এনজিওগ্রামের যন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে আছে।

 সিটি এমআরআই, সিটিস্ক্যান মেশিনও নষ্ট। ফলে রোগীদের বাইরে থেকে বাড়তি টাকায় এসব টেস্ট করতে হচ্ছে। সরকারিভাবে হাসপাতালে তিনটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সচল রয়েছে মাত্র একটি। এই একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে হাজার হাজার রোগীর সেবা করাটা অসম্ভব। ফলে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে হাসপাতালে।

ডায়ালাইসিসের অপেক্ষা আর শেষ হয় না : ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে (নিকডু) কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় হাসপাতালে যে ১৪টি মেশিনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তাতে প্রতিদিন মাত্র ১১৫ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পাচ্ছেন। ৪০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করার সুবিধা পাওয়ার কারণে রোগীর উপচে পড়া ভিড় কিডনি হাসপাতালে। প্রতি ডায়ালাইসিসে সরকার ভর্তুকি দেয় ১ হাজার ৭৯০ টাকা। ফলে আক্রান্তরা মন্ত্রী, এমপিসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালীদের সুপারিশ নিয়ে ডায়ালাইসিসের সিরিয়াল পেতে আবেদন করেন। প্রতিদিন গড়ে অর্ধশত রোগী আবেদন করলেও সক্ষমতার অতিরিক্ত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তা গ্রহণ করতে পারছে না। হাসপাতালটিতে শয্যা আছে মাত্র দেড়শ। অথচ ভর্তিচ্ছু রোগীর সংখ্যা অনেকগুণ বেশি। আউটডোরেও গড়ে প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ রোগী চিকিৎসা নেন। লজিস্টিক সাপোর্টের তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

ডাক্তারদের পকেটে টেস্টের কোটি কোটি টাকা : নাম ঝুঁকিভাতা। বাস্তবে অযথাভাতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোটি কোটি টাকা ডাক্তারদের পকেটে যাওয়ার ঘটনায় সেখানে রোগীদের মুখে মুখে চলছে এমন মন্তব্য। এই পরীক্ষার টাকার আরেক নাম ইউজার ফি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা এ হাসপাতালে এলে রোগ নির্ণয়ের জন্য দেওয়া হচ্ছে একগাদা টেস্ট। আর সেই টেস্ট করাতে রোগীরা যাচ্ছে প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, হেমাটলজি, রেডিওলজিসহ বিভিন্ন বিভাগে। সেখানে যাওয়ার পর রোগীদের কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি বাবদ মোটা অঙ্কের যে টাকা আদায় হচ্ছে তা ঝুঁকিভাতার নামে চলে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারীর পকেটে।

তবে এই ঝুঁকিভাতা আসলে কমিশন হিসেবেই বেশি পরিচিত। এমন খবরও রয়েছে যে, একজন অধ্যাপক যা বেতন পাচ্ছেন তার পাঁচগুণ নিচ্ছেন কমিশন। যেমন একজন অধ্যাপকের বেতন ৮০ হাজার টাকা হলে মাসে কমিশন বা ঝুঁকিভাতা পান অন্তত পাঁচ লাখ টাকা। আবার যে কর্মচারীর বেতন ২০ হাজার টাকা তার কমিশন কমপক্ষে এক লাখ টাকা। তবে এই কমিশনের ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মেডিসিন, জেনারেল সার্জারি, গাইনি, নিউরো-সার্জারিসহ ক্লিনিক্যাল বিভাগের ডাক্তার-নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে বাধা না থাকলেও এত টাকা কমিশন অযৌক্তিক। এর বিরুদ্ধে অডিটেও অনেকবার আপত্তি উঠেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যাপকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকার বড় ভাগ নিলেও তাদের অনেকেই সরাসরি এক্স-রে, এমআরআই করেন না। শুধু রিপোর্ট দেন। তাতে রোগব্যাধির ঝুঁকি নেই। অথচ ঝুঁকিভাতার ভাগ বেশি। এ কাজগুলো সর্বক্ষণ করে যাচ্ছেন রেডিওগ্রাফার। রক্তসহ অন্যান্য পরীক্ষার বেশিরভাগ করেন টেকনোলজিস্টরা। কোনো সমস্যা হলে বা জটিল মনে হলে অধ্যাপকরা স্লাইট দেখতে আসেন। নইলে নিজের কক্ষে বসে রিপোর্টে স্বাক্ষর করছেন।

সর্বশেষ খবর