বুধবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নানা সংকটে প্রাথমিক শিক্ষা

রাজশাহীতে শহরে-গ্রামে শিক্ষক ও অবকাঠামো বৈষম্য

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

দুপুর ১২টা। আমবাগানের ভিতরে চলছে শিশু-শিক্ষার্থীদের পাঠদান। অনেকটা শখের বসে হলেও বছরের অন্য সময়গুলোতে আমবাগানেই ক্লাস করতে হয় শিক্ষার্থীদের। কারণ বর্ষায় হাঁটু পানি আর গরমে শ্রেণিকক্ষে থাকা দায়। এমনই হাল রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ভাংগীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। চারজন শিক্ষক পাঠদান করান ১২০ শিক্ষার্থীকে। দীর্ঘদিন প্রধান শিক্ষকের পদটিই শূন্য এই স্কুলে। টিনের চালা আর চাটাইয়ের বেড়ার এ স্কুলে বর্ষা মৌসুমে পানি নিঃষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় শ্রেণিকক্ষের ভিতওে হাঁটু পানি জমে থাকে। ৪ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত সময় লাগে পানি শুকাতে। কয়েক মাস স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে পাশের বাঁশঝাড় অথবা আমবাগানে। স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হচ্ছে। বছরের ২ থেকে ৩ মাস শ্রেণিকক্ষের ভিতরে আর বাঁকি সময় স্কুলের পাশেই বাঁশঝাড় অথবা আমবাগানে পাঠদান করাতে হয়।

শুধু আবাসন নয়, শিক্ষক সংকটও আছে স্কুলগুলোতে। আবার অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদায়ন হলেও তারা ঠিক মতো স্কুলে যান না। চরের স্কুলগুলোর বেহাল দশা। সেখানে স্কুল আছে, শিক্ষার্থী আছে। কিন্তু নেই শিক্ষক। আবার শহরের স্কুলে ১১টি পদের বিপরীতে কর্মরত ১২ জন শিক্ষক।

রাজশাহী জেলায় প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষকসহ মোট শিক্ষকের পদ শূন্য ৫১৬টি। প্রধান শিক্ষককের পদ শূন্য থাকায় সহকারী শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করা হচ্ছে। এর ফলে অফিসের কাজ ও পাঠদান করাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। এ ছাড়া শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পাঠদান কার্যক্রম।

শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ ও শ্রেণিতে শিক্ষার্থী বেশি হওয়ার কারণে শিক্ষকরা চাইলেও ক্লাসে সবার প্রতি মনোযোগ

দিতে পারেন না। ফলে শিক্ষার্থীরাও ভালো শিখতে পারে না। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত নগর ও গ্রামের দরিদ্র পরিবারের সন্তানরাই পড়ালেখা করায় অভিভাবকরাও নজরে রাখতে পারেন না। একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় কম শিক্ষক ও অন্যদিকে ক্লাসে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী। এ জন্য বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা কিছুই শিখছে না। কোনো মতে পাস করছে।

 এই জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণি কক্ষ ও শিক্ষক বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন তারা। ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সাইফুল ইসলাম জানান, আগের চেয়ে স্কুলগুলোতে শিক্ষক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি অনেক বেশি। শূন্যপদগুলো পূরণে সরকারি নিয়োগ অব্যাহত আছে। অবকাঠামো সমস্যা দূর করতে সরকারি নানা উদ্যোগ আছে বলেও জানান তিনি। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার ১০ থানায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪৪টি। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ২৬৬ ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ২৫০টি। নগরীর বোয়ালিয়া থানার সরকারি ৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষক দুটি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ছয়টি। গোদাগাড়ীতে ১৬২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ২৪টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ২৫টি। চারঘাটের ৭৩টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ৩২টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য  ৫টি। তানোরে ১২৭টির মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ৪৭টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ৩২টি। দুর্গাপুরে ৮১টির মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ১৬টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ৩০টি। পুঠিয়ায় ৮৯টির মধ্যে প্রধান শিক্ষকে ২৫টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ১৬টি। পবায় ৮১টির মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ২৪টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ৩৪টি। বাগমারায় ২১৬টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ৫২টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ৬৮টি। বাঘায় ৭৪টির মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ২০টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ২০টি এবং মোহনপুরে ৮১টি বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রধান শিক্ষকের ২৪টি ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য ১৪টি। নগরীর বোয়ালিয়া থানা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বোয়ালিয়ার সরকারি স্কুলগুলোতে শিক্ষকের সংকট তেমন নেই। তবে শিক্ষার্থীর সংকট আছে। কারণ নগরীতে সরকারি স্কুলের বাইরেও বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ২৬৬টি। এ জন্য বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ান। নগরীর দরগাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুমোদিত শিক্ষকের পদ সংখ্যা ৬ জন। সেখানে শিক্ষক আছেন পাঁচজন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০৪ জন। ওই বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন শামীমা আক্তার। নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনুমোদিত শিক্ষকের পদ সংখ্যা ১১ জন। বর্তমানে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১২ জন শিক্ষক। এর সঙ্গে আর একজন শিক্ষক ডেপুটেশনে কর্মরত আছেন। ওই বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬০০ জন। বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. মাসুদুন্নবী বলেন, ‘শিক্ষকের সংকট না থাকলেও শ্রেণি কক্ষ সংকট প্রকট। একই কক্ষে পাল্টাপাল্টি করে ক্লাস নিতে হয়।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর