শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঝুঁকিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র-সাবস্টেশন

একের পর এক ঘটছে অগ্নিকাণ্ড

জিন্নাতুন নূর

কল-কারখানা, হাসপাতাল, শপিং মলগুলোর পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট দুর্ঘটনা থেকে ঝুঁকিমুক্ত নয় দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও ট্রান্সফরমারগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও এর বাইরে দেশের বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সাবস্টেশনে অগ্নিদুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে। আর দুর্ঘটনার কারণ পর্যবেক্ষণ করে এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট ও পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রান্সফরমার থেকেই অধিকাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন ও ট্রান্সফরমারগুলোর দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্পর্শকাতর এসব স্থাপনার প্রতি অবহেলার কারণেও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটছে। ‘ফাইনাল রিপোর্টস ফর ওল্ড পাওয়ার প্লান্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না। আর কেন্দ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় একটি কেন্দ্র আদৌ ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত নির্দেশিকা না থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ উৎপাদনে যাওয়ার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন করাই কেন্দ্রগুলোর প্রথম চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। এর পরই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সক্ষমতা নিয়ে চিন্তা করা হয়। বিশেষ করে দেশের ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীর অভাব থাকায় অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি বরাবরই অবহেলিত থাকে। আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ ট্রান্সফরমারগুলো বাড়তি চাপ নিতে পারছে না। এতে ঘটছে বিভিন্ন দুর্ঘটনা। বিশেষ করে পুরান ঢাকায় ওভারলোডেড ট্রান্সফরমারের সংখ্যা অধিক। সেখানে দুর্ঘটনার হারও বেশি। ট্রান্সফরমারের ওভারলোড নিয়ন্ত্রণ ও পুড়ে যাওয়া রোধে ২০১৪ সালে একটি নীতিমালা তৈরি করে বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু নীতিমালার অধীনে থাকা নির্দেশনাগুলোর কার্যকর করা হয়নি। বিদ্যুৎ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, সরবরাহ বা বিতরণের ফলে কিংবা বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন বা অন্যবিধ কার্যের ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হলে ক্ষতিগ্রস্ত বা জ্ঞাত কোনো ব্যক্তি উক্ত ঘটনা বা ক্ষতির বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিতভাবে নোটিস প্রদান করতে পারবেন।’ কিন্তু এ ব্যাপারে কখনোই সরকার বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সেভাবে কাউকে অভিযোগ করতে দেখা যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সাবস্টেশন অফিসগুলোর দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্পর্শকাতর  এসব স্থাপনাগুলোর প্রতি অবহেলার জন্য সেখানে অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ওভারলোডিং এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রের স্পার্ক থেকে সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গ থেকেও এসব   স্থাপনায় অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি তৈরি হয়। আগুন লাগলে তাৎক্ষণিকভাবে তা নেভানোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সেখানে থাকে না। এতে আগুনের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায়। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সাবস্টেশনগুলোতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দক্ষ লোকেরও অভাব আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তার মতে, এসব স্থাপনার পুরোপুরি কাজে যাওয়ার আগে সেখানে দুর্ঘটনা রোধে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এগুলো নিয়মিত তদারকও করতে হবে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ভিতরে সৃষ্ট আগুনে পুড়ে যায় কেন্দ্রটির লাখ টাকা মূল্যের কেবল ও কাঠের বাক্স। পরে ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নেভানো হয়। ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগস্থলে সৃষ্ট স্পার্ক থেকে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়ে আগুন ধরেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে অগ্নিকাে  ১৪ মার্চ একজন দগ্ধ হন। গ্যাসক্ষেত্রটির ১ নম্বর লোকেশনে কনডেনসেট ওভার ফ্লো হয়ে ফ্লেয়ার লাইনে ও আশপাশে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় একজন অগ্নিদগ্ধ হন। সম্প্রতি ঢাকার কেরানীগঞ্জে নির্মাণাধীন একটি বিদ্যুতের সাবস্টেশনে আগুনের ঘটনা ঘটে। ২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট তা নিয়ন্ত্রণে আনে। কেরানীগঞ্জের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মালঞ্চ হাসপাতালের সামনে এই সাবস্টেশন নির্মাণ এখনো শেষ হয়নি। আগুনে সাবস্টেশনটির বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেখানে আগুন লাগার কারণ এখনো জানা যায়নি। এর আগে গত বছর মে মাসে রাজধানীর পরীবাগের একটি বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনে আগুন লাগে। সেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে আগুন লেগেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে খুলনার গল্লামারী মোহাম্মদনগর ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রে আগুনের ঘটনা ঘটে। উপকেন্দ্রের সার্কিট ব্রেকারের রাইজিং কেবল থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এর আগে গত বছর অক্টোবরে ধানমন্ডিতে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে নির্মাণাধীন ভবন থেকে রড ছিটকে পড়লে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর প্রাণ যায়। এ ছাড়া চকবাজারের কমলবাগে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণে অহেদুল নামে এক যুবকের শরীর আগুনে ঝলসে গেলে তার মৃত্যু হয়।

সর্বশেষ খবর