শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ম্যানেজার হাফিজের সাম্রাজ্য

সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

বৃহত্তর সিলেটের কয়েক লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছেন। এসব প্রবাসী দেশে আসা কিংবা দেশ থেকে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করেন ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। প্রতিদিন অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতেও হাজারো মানুষ এ বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াত করেন। কিন্তু সিলেট বিভাগের একমাত্র এ বিমানবন্দরটিতে অনিয়মের যেন শেষ নেই। যাত্রী হয়রানি এখানে নিত্যদিনের বিষয়। বিমানবন্দরের ভিআইপি গেটে বাশারের হাতে টাকা দিলেই বিনিময়ে ওই গেট দিয়ে অবাধে যাতায়াত, ডিউটি ফ্রি শপ থেকে বাইরে থেকে মদ নেওয়া, টেন্ডার ছাড়াই লাগেজ র‌্যাপিংয়ের কাজ দেওয়া- এসব যেন এখন ওপেন সিক্রেট। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এ বিমানবন্দরে চাকরি করে ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ অনিয়মের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য থেকে দেশে আসেন হুমায়ুন কবির নামে এক প্রবাসী। ওসমানী বিমানবন্দরে আসার পর তার লাগেজ ধরে শুরু হয় কর্মচারী, আনসার ও দালালদের দৌরাত্ম্য। কনকোর্স হল থেকে সহযোগিতার নাম করে লাগেজ বাইরে এনে তার কাছে দাবি করা হয় টাকা। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে আনসার সদস্যরা লাগেজ আটকে রাখার হুমকি দেন। চার হাজার টাকা দিয়ে নিস্তার পান তিনি। এভাবে শুধু হুমায়ুন কবিরই নন, ওসমানী বিমানবন্দর দিয়ে যাতায়াত করা প্রবাসীরা প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন হয়রানির। যাত্রীদের অভিযোগ, বিমানবন্দরে নামার পরই তাদের লাগেজ ধরে টানাটানি শুরু হয়। বিমানবন্দরের কর্মচারী ও আনসাররা সহযোগিতার নাম করে লাগেজ বাইরে এনে টাকা দাবি করেন। না দিলে হয়রানি ও দুর্ব্যবহার করা হয়। অসুস্থ কোনো যাত্রী এলে হুইল চেয়ার সার্ভিস দেওয়ার নামে তাদেরও হয়রানি করা হয়। এ ‘টানাটানি সিন্ডিকেটকে’ বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জনশ্রুতি আছে। এখানে দালালদের দৌরাত্ম্যও প্রকট।

অভিযোগ আছে, প্রবাসী স্বজনকে বিদায় দিতে কিংবা স্বাগত জানাতে যারা গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে ঢুকতে চান, তাদের গাড়ি মূল সড়কেই আটকে দেন আনসার সদস্যরা। শুধু যাত্রীকে যাওয়ার সুযোগ দেন তারা। অথচ বিমানবন্দরের ঠিক বাইরে গাড়ির জন্য পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এ ক্ষেত্রে আনসারদের টাকা দিলে তারা গাড়ি পার্কিং পর্যন্ত যেতে দেন। বিমানবন্দরে ভিআইপি গেট দিয়ে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ থাকলেও টাকা দিয়ে যে কেউ এ গেট ব্যবহার করতে পারেন। গেটে বাশার নামের একজনের হাতে ৫০০-১০০০ টাকা গুঁজে দিলেই মেলে ভিতরে ঢোকার সুযোগ। বাশার ব্যবস্থাপকের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। অনেকে আবার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে বিমানবন্দরের রানওয়ের র‌্যাম্পেও ঢুকে পড়েন। এতে হুমকিতে পড়ছে নিরাপত্তাব্যবস্থা। নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগে এ বিমানবন্দর দিয়ে সোনা ও মাদক চোরাচালান হয় বলেও অভিযোগ আছে। শুল্ক গোয়েন্দাদের নজরদারিতে বছরে কোটি কোটি টাকার সোনা ও মাদক এখানে ধরা পড়ে। বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে মদ বাইরে নিয়ে আসা হয় এবং ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদও এখান থেকে মদ পাশের একটি ক্লাবে নিয়ে যান বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরে লাগেজ র‌্যাপিংয়ের কাজ টেন্ডার ছাড়াই একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। প্রতি লাগেজে ২০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। টেন্ডার ছাড়াই এ কাজ করানোয় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

জানা গেছে, বিএনপি সরকার আমলে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান টাওয়ার কন্ট্রোলার হিসেবে হাফিজ আহমদকে ওসমানী বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। তাদের উভয়ের বাড়িই মৌলভীবাজারে। ২০০৮ সালে স্টেশন ম্যানেজার পদে উন্নীত হন হাফিজ। এ পদটি তিনি প্রায় এক যুগ ধরে আঁকড়ে আছেন। ২০১৬ সালে তাকে চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বদলি করা হয়েছিল। কয়েক মাস আগেও একবার বদলির আদেশ এসেছিল। একাধিকবার বদলির আদেশ এলেও তদবিরের মাধ্যমে তিনি তা বাতিল করিয়েছেন বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বে থাকায় হাফিজ ওসমানীতে অনিয়মের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। তার ইশারাতেই বিমানবন্দরের সব অনিয়ম সংঘটিত হয় বলেও অভিযোগ আছে। তিন-চার মাস আগে বিমানসচিব সিলেট সফরকালে হাফিজের মেয়াদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ১১ বছর ধরে থাকার কথা শুনে সচিব বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এত দিন ধরে কীভাবে থাকো!’

ওসমানী বিমানবন্দরকেন্দ্রিক বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ। তিনি বলেন, কখনো তার বদলির আদেশ এসেছিল কিনা, তা জানেন না। ভিআইপি গেট দিয়ে টাকা দিয়ে যাতায়াতের বিষয়টি তার জানা নেই বলে মন্তব্য করে হাফিজ বলেন, ‘অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ টেন্ডার ছাড়াই লাগেজ র‌্যাপিংয়ের কাজ একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘অনেক আগে একবার টেন্ডার হয়েছিল। এরপর আর হয়নি। অথরিটি মনে করছে টেন্ডারের দরকার নেই। মূল লক্ষ্য যাত্রীদের সেবা দেওয়া।’ বিমানবন্দরের ডিউটি ফ্রি শপ থেকে মদ বাইরে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে হাফিজ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।’

সর্বশেষ খবর