বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সংকট ও দুর্নীতিতে বেহাল শেবাচিম

রোগীদের নানা অভিযোগ

রাহাত খান, বরিশাল

পদ্মার পশ্চিম পাড় থেকে দক্ষিণের উপকূল পর্যন্ত প্রায় কোটি মানুষের আধুনিক চিকিৎসাসেবার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এখন রোগীতে পরিণত হয়েছে। অর্ধশত বছরেরও বেশি পুরনো পাঁচতলা হাসপাতাল ভবনটির বিভিন্ন অংশ মাঝে মধ্যে খসে পড়ছে, দেবে গেছে ৮ ইঞ্চি। এ কারণে হাসপাতালের ড্রেনেজ ব্যবস্থা কাজ করছে না দাবি স্বয়ং পরিচালকের। সু-পরিকল্পিত ডিজাইন উপেক্ষা করে ভবনটির বিভিন্ন তলায় অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। এরপরও রোগীর সংকুলান হচ্ছে না দক্ষিণ বাংলার মানুষের আধুনিক চিকিৎসাসেবার ভরসাস্থল শেরেবাংলা মেডিকেলে। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালটিকে এক হাজার শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই ৫০০ শয্যার জনবল কাঠামোই কার্যকর হয়নি। তার ওপর ২৮টি আন্ত ও ১২টি বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫ হাজার রোগী। আবার একেক জন রোগীর সঙ্গে গড়ে তিনজন দর্শনার্থীর উপস্থিতি এবং বহিরাগত ও দালালদের উৎপাতে হাটবাজারের মতো হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। এসব কারণে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মানুষের অভাব, অভিযোগ নিত্য দিনের। ১৯৭০ সালে রোগী সেবা চালু হওয়া হাসপাতালের অনিয়মের শুরুটা জরুরি বিভাগ থেকেই। ১০ টাকার প্রেসক্রিপশন ও এক টাকা রোগী কল্যাণ ফিসহ হাসপাতালে ভর্তি হতে একজন রোগীর জন্য ২৬ টাকা নির্ধারিত থাকলেও ভাঙতি না থাকার অজুহাতে অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। জরুরি বিভাগ থেকে ভর্তি হওয়া রোগী ওয়ার্ডে পাঠাতে বকশিশ ছাড়া ঘোরে না ট্রলির চাকা। ওয়ার্ডে গেলে মেলে না শয্যা ও ডাক্তার-নার্সের তড়িঘড়ি সেবা। মহিলা মেডিসিন, মহিলা সার্জারি, গাইনি, প্রসূতি ও শিশু, পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার তিন-চারগুণ রোগী ভর্তি হওয়ায় প্রথমে তাদের ঠাঁই হয় বারান্দায়। অন্যান্য ওয়ার্ডেও শয্যার চেয়ে রোগী বেশি। হাসপাতালের খাবারের মানও যাচ্ছে তাই। সামর্থ্যবানরা হাসপাতালের খাবার চেখেও দেখেন না। অসহায় দরিদ্র্যরা বাধ্য হয়েই গ্রহণ করেন মানহীন খাবার। সরকারি বরাদ্দ করা ওষুধের সিকিভাগও জোটে না তাদের কপালে। ক্ষণে ক্ষণে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হয় রোগীর স্বজনদের হাতে। 

এই হাসপাতালে যত আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ও ভারী যন্ত্রপাতি আছে, তা বরিশালের আর কোথাও নেই। অথচ এই হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতিগুলো বছরের পর বছর ধরে থাকে বিকল। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের এক শ্রেণির টেকনিশিয়ান বাইরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে আঁতাত করে কৃত্রিমভাবে বিকল করে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ রোগ নির্ণয়ের ভারী মেশিনগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মস্তিষ্ক ও হার স্ক্যান করার মূল্যবান এমআরআই মেশিন তিন বছর, ক্যান্সার রোগীর থেরাপির জন্য কোবাল্ট-৬০ মেশিন দুই বছর, তিনটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন বহুদিন এবং হৃদ রোগ নির্ণয়ের ইকো মেশিন দুই বছর ধরে বিকল। এসব যন্ত্রপাতি সচল করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ এসব রোগ নির্ণয়ের জন্য বাইরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।

হাসপাতালে চারটি এক্স-রে মেশিন রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সেকেলে এবং একটি ডিজিটাল। হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে হয় না গুজব ছড়িয়ে রোগীদের পাঠানো হয় বাইরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। হৃদ রোগের চিকিৎসায় একটি এনজিওগ্রাম এবং দুটি সিটি স্ক্যান মেশিন সচল থাকলেও তার পূর্ণ সুবিধা পাচ্ছেন না রোগীরা। জনবল সংকটের কথা বলে দুপুর ১টার পর কোনো পরীক্ষা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া চোখের রোগ নির্ণয়ে লেসিক মেশিন ও ফ্যাকো মেশিন, লিভার সমস্যা নির্ণয়ে এন্ডোসকপি ও  ক্লোনোসকপি সচল রয়েছে। প্যাথলজি বিভাগে সব ধরনের পরীক্ষা হলেও সেবা দেওয়া হয় দুপুর পর্যন্ত। অথচ রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব যন্ত্রপাতি দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সচল রাখার দাবি সর্বমহলের।

হাসপাতালের ২৮টি আন্তঃওয়ার্ড এবং ১২টি বহির্বিভাগসহ ৫০০ শয্যার জন্য মঞ্জুরিকৃত চিকিৎসকের ২২৪টি পদের বিপরীতে কর্মরত ১১৭। সহকারী পরিচালকের দুটি পদের একটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।

সেবিকার ৮০১ পদের বিপরীতে কর্মরত ৭৭৮ জন, ৩য় শ্রেণির ১০২ পদের বিপরীতে ৭২ জন এবং অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা প্রহরী, সরদার-জমাদ্দার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বাবুর্চি ও ওয়ার্ড বয়ের ৪২৬ পদের বিপরীতে কর্মরত ৩১৯ জন।

টেকনিশিয়ানদের ৯টি পদের সবাই কর্মরত থাকলেও রোগীর তুলনায় অন্তত ২০ জন টেকনিশিয়ান প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জনবল সংকটের কারণে ১০৯ জন বহিরাগত হাসপাতালে রোগীর ফুটফরমায়েশ করেন পেটেভাতে অর্থাৎ বকশিশের বিনিময়ে।

হাসপাতালের নানা সংকটের কথা স্বীকার করে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে রোগী সেবা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান পরিচালক ডা. মো. বাকীর হোসেন।

সর্বশেষ খবর