সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রেমিকযুগল হত্যা মামলায় চার্জশিট

অভিযুক্ত চার ছাত্র ও দুই হোটেল বয়

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

রাজশাহীর হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালে চাঞ্চল্যকর ‘ক্লুলেস’ জোড়া খুনের মামলায় চার ছাত্র ও হোটেলের দুই কর্মচারীকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গতকাল দুপুরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মহিদুল ইসলাম রাজশাহীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযুক্তরা হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ (২১), রাজশাহী কলেজের             প্রাণিবিদ্যার চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বোরহান কবীর ওরফে উৎস (২২), একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল-আমিন (২০) ও রাবিতে দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি প্রার্থী আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০) এবং নাইস হোটেলের বয় নয়ন (৩২) ও বখতিয়ার (৩২)। এদের মধ্যে আহসান হাবিব, বোরহান ও নয়ন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ছাত্ররা সবাই জামিনে আছেন।

তবে হোটেল বয়রা গ্রেফতারের পর থেকে কারাগারে। ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিল নগরীর সাহেববাজারের হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের ৩০৩ নম্বর কক্ষে প্রেমিকযুগলকে হত্যা করা হয়। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল রাবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমানকে। আর তার প্রেমিকা সুমাইয়া নাসরিনকে হত্যা করা হয়েছিল ধর্ষণের পর বালিশ চাপা দিয়ে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সুপরিকল্পিতভাবে ঠা-া মাথায় অভিজাত আবাসিক হোটেল কক্ষের মধ্যে দুজনকে খুন করা হয়েছিল। ভারতীয় সনি টিভির ‘ক্রাইম পেট্রোল’ অনুষ্ঠান দেখে খুনের পর স্বাভাবিক থাকার এই কৌশল রপ্ত করেছিল তারা। ভেবেছিল তাদের চতুরালি কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর পিবিআই টিমের ফাঁদে ধরা পড়ে তারা। এরপরই বের হয়ে আসে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক সব তথ্য।

রাজশাহী পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলাম চার্জশিট দাখিলের জন্য গত ১৫ এপ্রিল রাজশাহীর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। এছাড়া চার্জশিট দাখিলের জন্য সময় নেন। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় আদালতে আলাদাভাবে দুটি চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। একটি সুমাইয়া নাসরিনকে ধর্ষণের পর বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা এবং দ্বিতীয়টি মিজানুরকে হত্যা। দুই মামলাতেই ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

প্রথমে এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুই হোটেল বয়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর মধ্যে দুজন আগে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে আদালতে জবানবন্দি দেন নয়ন। এর আগে চাঞ্চল্যকর এই হত্যার তদন্ত করে বোয়ালিয়া থানা পুলিশ। তদন্ত করে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে সুমাইয়াকে খুন করে মিজানুর আত্মহত্যা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের সময় মিজানুরের দুই হাত পেছন দিকে বাঁধা ছিল। হাত বাঁধা অবস্থায় কোনো লোক তো ফ্যানের সঙ্গে অন্যকে ঝুলাতে পারবে না। তদন্তে এই ত্রুটির কথা উল্লেখ করে আদালত পিবিআইয়ের কাছে মামলাটি তদন্তের জন্য পাঠায়। পরে পিবিআই তদন্ত শুরু করলে বেরিয়ে আসে মূল রহস্য। দেড় বছর পর ধরা পড়ে এ ঘটনায় জড়িত চার তরুণ। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একটি ‘ক্লুলেস’ হত্যাকা- ছিল।

তবে ঘটনার তদন্তে থানা পুলিশের গাফিলতিও ছিল। তাছাড়া ত্রুটি ছিল ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এবং ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলেও। থানা পুলিশ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছিল, সুমাইয়াকে মাথায় আঘাত করেছিলেন মিজানুর। এরপর মিজানুর বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন। আর সুমাইয়াকে শ্বাসরোধে হত্যার আগে তার সঙ্গে যৌন কর্ম করা হয়েছে। এমনকি ডিএনএ টেস্টেও সুমাইয়ার শরীরে শুধুমাত্র মিজানুরের ডিএনএ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এছাড়া মিজানুরের মরদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এটাকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করে। কিন্তু পিবিআইয়ের তদন্তে আসল রহস্য বেরিয়ে আসে।

নিহত যুবক মিজানুর রহমান ও রনির একটি ফোনকলের সূত্র ধরে পিবিআই চারজনকে গ্রেফতার করে। পিবিআই কর্মকর্তারা ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর আহসান হাবিবকে ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন রাজশাহীর দুটি ছাত্রাবাস থেকে বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের তথ্য মতে দুই হোটেল বয়কে গ্রেফতার করে পিবিআই।

গ্রেফতারের পর তারা জানায়, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এর প্রতিশোধ নিতে চার বন্ধু মিলে ওই তরুণীকে ধর্ষণের পর তার প্রেমিককেও হত্যা করা হয়। এ কাজে তাদের হোটেল বয়রা সহায়তা করেন।

সর্বশেষ খবর