বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা
রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

উপাচার্যের পছন্দে নিয়োগ পাচ্ছেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। তবে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পুরোদমে। আর নিয়োগের ক্ষমতা পেয়েই উপাচার্য বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়েছেন জামায়াত-বিএনপির কট্টর সমর্থকদের। অভিযোগ উঠেছে, এসব নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি। এ নিয়ে হাই কোর্টে মামলাও হয়েছে।

তবে রামেবির উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মাসুম হাবিব জানান, নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হয়নি। কিন্তু সিন্ডিকেট সদস্য ও মন্ত্রণালয়ে তার বিরুদ্ধে কিছু লোক অভিযোগ করেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন সেটি জানা গেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছিটকে পড়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রামেবির কার্যক্রমের শুরুতে অনেকটা বিতর্কের মধ্যেই উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মাসুম হাবিবকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি নিয়োগ পাওয়ার পর নিজের ইচ্ছামতো ডিনের নয়টি পদের পাঁচটিতে কট্টরপন্থি জামায়াত-বিএনপি সমর্থক ও নিজের পরিচিতদের নিয়োগ দেন। এর মধ্যে প্রিভেনটিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন অনুষদ, ডেন্টাল অনুষদ ও নার্সিং অনুষদের তিনটি ডিন পদে জামায়াত সমর্থক এবং মেডিকেল টেকনোলজি অনুষদ, বেসিক সায়েন্স ও প্যারাক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের দুটি ডিন পদে বিএনপি সমর্থিত ড্যাবের সাবেক এক নেতাকে নিয়োগ দেন। ডিন নিয়োগে আওয়ামী লীগ সমর্থক স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এবং বিএমএর নেতৃবৃন্দের কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০১৭ সালের ৪ জুলাই ‘উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার’ শর্তে রামেবির জন্য ৫১টি পদে জনবল নিয়োগের অনুমোদন দেয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় চিঠিতে অ্যাডহক ও মাস্টাররোলে নিয়োগ বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়। রামেবি আইনের ১৩(১০) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘ভাইস-চ্যান্সেলর সিন্ডিকেটের পূর্বানুমোদনক্রমে অনুমোদিত শূন্য পদে সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে অনধিক ছয় মাসের জন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রয়োজনে নিয়োগের মেয়াদ অনধিক ছয় মাস পর্যন্ত বাড়াতে পারবেন।’ কিন্তু রামেবির আইন (সিন্ডিকেটের পূর্বানুমোদন) এবং ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অ্যাডহক নিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন উপাচার্য। গত এক বছরে ১০ দফায় অন্তত ৩০ জনকে অ্যাডহক নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। কয়েকজনকে আবার প্রথম অ্যাডহক থেকে দ্বিতীয় অ্যাডহকে পদোন্নতিও দিয়েছেন।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রথম দফায় আটজনকে অ্যাডহকে নিয়োগ দেন উপাচার্য। এদের মধ্যে প্রেষণে থাকা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) দশম গ্রেডের কর্মকর্তা একরামুল হককে নিয়ম লঙ্ঘন করে সপ্তম গ্রেডের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দিয়ে পঞ্চম গ্রেডের ডেপুটি রেজিস্ট্রারের (ভারপ্রাপ্ত) দায়িত্ব দেন। দ্বিতীয় দফায় ২০১৮ সালের ১ মার্চ রামেকের এক উচ্চমান সহকারীকে একই কায়দায় সেকশন অফিসার পদে অ্যাডহকে নিয়োগ দেন। এরপর একই বছরের ২২ এপ্রিল ৩ জন, ৫ মে ১ জন, ২৭ জুন প্রথম অ্যাডহকের ৪ জনকে পদোন্নতিসহ নতুন ৩ জন এবং ১ জুলাই ৩ জনকে অ্যাডহকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৮ জুলাই ৩৪টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও ২১ জুলাই আরও ৩ জনকে অ্যাডহকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিলেকশন বোর্ড অ্যাডহকের ১৭ জনসহ ২৬ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে, যা ৮ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন করা হয়। ২০ ডিসেম্বর অ্যাডহকের ১৫ জনসহ ২৪ জনকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হলেও সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশ ও সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে সেকশন অফিসার পদে দুই মেয়াদে অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া একজনকেও স্থায়ী নিয়োগ দেননি উপাচার্য।

সিন্ডিকেটে অনুমোদন হওয়ার পরও নিয়োগ না দেওয়ায় জামাল উদ্দিন নামের ওই কর্মকর্তা সম্প্রতি হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাই কোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ স্বাস্থ্য সচিব, রামেবির ভিসি ও রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে রুল জারি এবং রিট আবেদনকারীর সেকশন অফিসার পদে চাকরি অব্যাহত রাখার বিষয়ে ছয় মাসের স্থিতাদেশ দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এ বছরের ৩০ জানুয়ারি ৩ জন, ২৩ ফেব্রুয়ারি ৫ জন এবং মার্চে ১ জনকে অ্যাডহকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে আগে সেকশন অফিসার পদে দুবার অ্যাডহকে নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষার্থীকে তৃতীয়বারের মতো নিম্নপদে অ্যাডহকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ নয়জনের অ্যাডহক নিয়োগে এখনো সিন্ডিকেটের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে প্রেষণে আনা চারজন ও চুক্তিভিত্তিক দুজনসহ অ্যাডহকে নিয়োগ করা দুজনকে কৌশলে বাদ দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

উপাচার্যের এমন নিয়োগকান্ডের ঘটনায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে ফেব্রুয়ারিতে সিন্ডিকেট সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন দফতরে বেনামি দরখাস্ত পাঠানো হয়। তাতে ভিসির স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া যারা টাকা দেননি, তারা স্থায়ী নিয়োগ পাননি বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

রামেবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম সদস্য ও স্বাচিপ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার সভাপতি ডা. খলিলুর রহমান বলেন, ‘রামেবি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেনদরবার করেছি। এখন সেখানে আমাদের মূল্যায়ন নেই। কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে সবকিছুই উপাচার্য নিজের ইচ্ছামতো করেন।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চিহ্নিত জামায়াত নেতাকে উপাচার্য রামেবিতে নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ স্বাচিপের কেউ রামেবিতে চাকরি পাননি।

উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মাসুম হাবিব জানান, বিভিন্ন অনুষদের ডিন পদে শিগগিরই পরিবর্তন আনা হবে। টাকা নিয়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর