শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিরাপত্তাহীন কোটি কোটি টাকার পণ্য

দিন দিন বাণিজ্য বাড়ছে বেনাপোল বন্দরে, তবু কমছে না সংকট

রুহুল আমিন রাসেল

নিরাপত্তাহীন কোটি কোটি টাকার পণ্য

পণ্য খালাসের অপেক্ষায় বেনাপোল বন্দরে ট্রাকের সারি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণ ও প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলে দিন দিন বাড়ছে বাণিজ্য। তবে কমছে না সংকট। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনা ও পণ্যের নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। খোলা আকাশের নিচে পণ্য রাখায় আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। পণ্য খালাসে জটিলতার কারণে বাড়তি ব্যাংক সুদ গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর এ বন্দরে চোরাচালানের কারণে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা করছে কাস্টমস। এ প্রসঙ্গে বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের পণ্য আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজতর করতে প্রতিদিনই পণ্য খালাসের উদ্যোগ নিয়েছি। গঠন করা হয়েছে তদন্ত ও গবেষণা টিম। এর সঙ্গে চোরাচালান প্রতিরোধ ও পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখার জন্য বসানো হয়েছে সিসিটিভি। জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বেনাপোল বন্দরটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরের মাধ্যমে মোট ৪ হাজার ৮৭২ দশমিক ৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হয়েছে। অথচ বন্দরটিতে ভোগান্তির শেষ নেই বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। ডিসিসিআই সহসভাপতি ইমরান আহমেদ গতকাল বলেন, পণ্য খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকছে হরহামেশাই। এটা দেখার যেন কেউ নেই। দিনের পর দিন পণ্য বন্দরে থাকায় খরচ বাড়ছে ব্যবসায়ীদের। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি- ডিসিসিআই সাম্প্রতি বেনাপোল বন্দরের উন্নয়নে দেওয়া প্রস্তাবনায় বলেছে, বর্তমানে বন্দরের ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪০ হাজার টন হলেও, প্রতিদিন দেড় থেকে ২ লাখ টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। তাই বন্দরের ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।

এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, ওয়্যার হাউস উন্নয়ন, পর্যাপ্ত শেড নির্মাণ, আমদানি পণ্যের মূল্যায়নে এইচএস কোড ব্যবহারের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ, বন্দরের সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসা, পণ্য খালাসের সময় কমিয়ে আনতে হবে। খাদ্য ও যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে টেস্টিং সার্টিফিকেট প্রাপ্তির জটিলতা দূরীকরণ করতে হবে। ডিসিসিআই বলেছে- বন্দরে পর্যাপ্ত শেড না থাকায় অনেক পণ্যই খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকে। এতে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়। আর পণ্য খালাসের বিলম্বের কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণের বাড়তি সুদের বোঝা বহন করতে হয়। ডিসিসিআই যশোর-বেনাপল সড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ, বন্দরে উচ্চ গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন, বন্দরের জন্য বিশেষায়িত বিদ্যুৎ সংযোগ ও বিজ্ঞান গবেষণাগারের শাখা স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের পেট্রাপোল বন্দরে বাংলাদেশি পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত শেড ও ওয়্যার হাউস নির্মাণ এবং বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা চালু রাখার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নিয়োগের সুপারিশ করেছে ডিসিসিআই। বেনাপোল কাস্টমস সূত্র জানায়, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার কারণে বেনাপোল সীমান্ত চোরাকারবারিদের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। মাঝে মধ্যে কিছু চালান আটক হলেও অধিকাংশই থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট বেনাপোল-শার্শা উপজেলার পুটখালী, দৌলতপুর, সাদীপুর, রঘুনাথপুর, ঘিবা এবং শিকারপুর সীমান্ত থেকে ভারতের কলিকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। ফলে এসব রুটে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় চোরাচালানিরা নিরাপদ রুট হিসেবে এ পথকে বেছে নিয়েছে। বেনাপোল কাস্টমসের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেনÑ চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য এত বেশি বেড়েছে যে, এই বন্দরে চোরাকারবারিরা অবৈধ মালামাল নিয়ে প্রকাশ্যেই যাতায়াত করেন। অনেক সময়ে চোরাকারবারিরা খোদ কাস্টমস অফিসের মধ্যেই ঢুকে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডÑ এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গত অক্টোবরে একপত্র দেন বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী। তার স্বাক্ষরিত ওই পত্রে বলা হয়Ñ যাত্রী সেবা, জন ও জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনায় বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। এই চেকপোস্ট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার পাসপোর্টধারী যাত্রী যাতায়াত করেন। তাদের যাতায়াতের সময় আগমনী ও নির্গমনী হলে দুটি স্ক্যানিং মেশিনের মাধ্যমে ব্যাগেজ স্ক্যানিং করা হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে খুলনা থেকে কলিকাতা দ্বিতীয় মৈত্রী যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। বেনাপোল রেল স্টেশনে যাত্রীদের কাস্টমস সংক্রান্ত যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে তাদের ব্যাগেজ পরীক্ষা করা হয়। চোরাচালানরোধ ও প্রয়োজনীয় কার্যার্থে এবং জাতীয় রাজস্ব সুরক্ষার স্বার্থে সর্বাধিক গুরুত্ব বিবেচনায় বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনে একটি স্ক্যানিং মেশিন বসানো হয়েছে। কোনো ব্যাকআপ স্ক্যানিং মেশিন না থাকায় একটি মেশিন বিকল বা নষ্ট হয়ে গেলে সামগ্রিক কার্যক্রম বন্ধের উপক্রম হয় এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থায় দুটি স্ক্যানিং মেশিন কিনতে এক কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন বলে জানিয়েছে বেনাপোল কাস্টমস হাউস।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর