শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাবধান! ফুটওভার ব্রিজে ছিনতাইকারী

নিরাপত্তাহীনতায় ৪৫ শতাংশ পথচারী ব্যবহার করেন না

সাখাওয়াত কাওসার

সাবধান! ফুটওভার ব্রিজে ছিনতাইকারী

২৫ এপ্রিল রাত ১০টা ৫০ মিনিট। রাজশাহীগামী পদ্মা এক্সপ্রেস ধরতে এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশনে যাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সাইফুজ্জামান। বাসে করে এয়ারপোর্ট গোলচত্বরে নেমে ফুটওভার ব্রিজে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। ওভারব্রিজে ওঠার পরপরই পাশে হাঁটা এক যুবকের আবির্ভাব। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পেটে চাকু ঠেকায়। টুঁ শব্দ না করে সঙ্গে থাকা মানিব্যাগ, মোবাইল ও হাতঘড়ি খুলে দিতে বলে। উপায় নেই। ওই যুবকের নির্দেশই মানতে বাধ্য হন তিনি। ছিনতাইকারী ওই যুবকের পাশেই ছিল তার এক সহযোগী। ছিনতাইয়ের শিকার সাইফুজ্জামান থানায় সাধারণ ডায়েরি কিংবা কোনো মামলা করেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলছিলেন, বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল তার। ৫ মে একই স্থানে ভোর সোয়া ৬টায় ঘটে আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। ইকবাল হোসেন নিপ্পন তার স্ত্রী হেনাকে নিয়ে সিলেট থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। ওভারব্রিজে রাস্তা পার হওয়ার সময় দুজন লোক তাদের গায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে সবকিছু দিয়ে দিতে বলে। প্রাণের ভয়ে কোনো চিৎকার না করেই তারা তাদের সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল ফোন এবং সোনার অলঙ্কার দিয়ে দেন। তবে তারাও এ ঘটনায় থানায় কোনো অভিযোগ করেননি। রবিবার রাতেও অজ্ঞাত এক যুবক একই ওভারব্রিজে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে কিছুটা অবাক করা বিষয় হলো, ওভারব্রিজের ছিনতাইকারীরা কারও কাছ থেকেই তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগ নিচ্ছে না। এত গেল মাত্র তিনটি ঘটনা।

রাজধানীর ওভারব্রিজগুলোতে ওত পেতে থাকে পথচারীবেশী ছিনতাইকারী। রাতে ও ভোররাতে রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বাস টার্মিনালমুখী ঘরমুখো যাত্রীদের টার্গেট করে হাতিয়ে নেয় তাদের সর্বস্ব। তবে মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরির ক্ষেত্রে উল্টো পুলিশি ঝামেলার ভয়ে অনেকে থানামুখী হতে চান না। অন্যদিকে নিরাপত্তার কারণে ৪৫ ভাগ পথচারী ওভারব্রিজে উঠতে চান না বলে জানা গেছে। বিমানবন্দর মোড়ের ওভারব্রিজে ছিনতাইয়ের বিষয়ে খোঁজ নিলে স্থানীয়দের অভিযোগ, এমন ছিনতাই ওই ওভারব্রিজে হরহামেশাই ঘটে। বিশেষ করে রাতে এবং ভোরে ট্রেনের যাত্রীরাই হয় তাদের টার্গেট। তাদের কেউ কেউ বলছিলেন, এখানে ছিনতাইয়ের খবর কি পুলিশের কাছে যায় না? এর পরও তারা কেন কোনো ব্যবস্থা নেয় না? এটা কী প্রমাণ করে? এদিকে রাজধানীর বাংলামোটর ও ফার্মগেটের দুটি ওভারব্রিজেও রাতে এবং সকালে এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ফুটওভার ব্রিজের বাইরেও রাজধানীর মানুষ থাকে ছিনতাইকারীর আতঙ্কে। বিশেষ করে ভোরের ঢাকা রাজধানীবাসীর কাছে আতঙ্কের নাম। লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে করে ঢাকায় আসা মানুষরাই হয় ছিনতাইকারীদের টার্গেট। শান্ত, নির্মল বাতাসের ভোরের ঢাকায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার ঢিলেঢালা নিরাপত্তাকে পুঁজি করেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ছিনতাইকারীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীতে ৪১টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও গত দুই বছরের তথ্যানুযায়ী ঢাকায় মাসে গড়ে অন্তত ১৫টি ছিনতাই মামলা রেকর্ড হয়। তবে ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী রাজধানীতে ছিনতাইয়ের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। অধিকাংশ সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়লে অনেকেই পুলিশের দ্বারস্থ হন না। কোনো কোনো ঘটনায় পুলিশের কাছে গেলে ছিনতাই মামলা না নিয়ে জিডি নিতে উৎসাহী হয় থানা পুলিশ। শুধু চাঞ্চল্যকর বড় ঘটনা বা ছিনতাইকারীদের হাতে খুনের পরই তোলপাড় হয়। তবে র‌্যাব সদর দফতরের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে র‌্যাব সারা দেশে ছিনতাই, মলম ও অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে ১৩০টি সফল অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় ৩১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা হয়েছে ১১২টি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেখুন, এবারের রমজানে বিগত যে কোনো বছরের চেয়ে ছিনতাই কমেছে।

উল্লেখ করার মতো কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনাই ঘটেনি। তবে বিমানবন্দর সড়কের ওভারব্রিজসহ রাজধানীর অন্য ওভারব্রিজগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।’

সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক পারাপার কমিয়ে আনতে রাজধানীতে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয়েছে ৯১টি ফুটওভার ব্রিজ। তবে সম্প্রতি মেট্রোরেলের কাজ শুরু হওয়ার কারণে অন্তত ১০টি ওভারব্রিজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজের যথাযথ ব্যবহারের জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বিভিন্ন সময় সচেতনতামূলক নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, ছিনতাইকারীর ভয় ও ফুটওভার ব্রিজের বেহাল দশার কারণে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে মূল সড়ক দিয়ে চলাচলকেই বেছে নিচ্ছেন তারা।

ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) একটি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ৪৫ শতাংশ মানুষ নিরাপত্তার কারণে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। ১৪৩ জন পথচারীর ওপর জরিপটি পরিচালনা করে ডুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ পথচারী বলেছেন, ফুটওভার ব্রিজে নিরাপত্তার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে তারা ফুটওভার ব্রিজ এড়িয়ে চলেন। ৩৪ ভাগ পথচারী বলেছেন, ফুটওভার ব্রিজের প্রবেশমুখ খুবই সংকীর্ণ থাকে। ৬২ ভাগ পথচারী বলেছেন, ফুটওভার ব্রিজ হকারদের দখলে থাকায় তা ব্যবহার করা যায় না। ফুটওভার ব্রিজ স্থাপনের জায়গা সঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন ৩৭ শতাংশ পথচারী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর