মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

শাস্তি হয় না ভুল চিকিৎসার

প্রমাণও পায় না বিএমডিসি

মাহবুব মমতাজী

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা বা ভুলের অভিযোগের শেষ নেই। তবু এসবের প্রমাণ পায় না বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)। স্বাধীনতার পর থেকে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলা ও ভুলের কত অভিযোগ জমা পড়েছে, সেই হিসাব এ প্রতিষ্ঠানে নেই। নানা অভিযোগের হিসাব রাখা হচ্ছে ২০০৪ সাল থেকে। তবে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ-সংক্রান্ত বিচার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে চিকিৎসা যে ভুল হয়েছে সেটি প্রমাণ করার জন্যও নেই কোনো নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ধর্মঘট বা চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়ার চাপ সৃষ্টি করে অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়ে যান সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। চিকিৎসকদের পেশাচর্চার অনুমতি দেয় বিএমডিসি। অসদাচরণ, অবহেলা বা ভুলের কারণে রোগীর ক্ষতি হলে সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে তারা। এমনকি নিবন্ধন বাতিল করতে পারে বিএমডিসি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র দুজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল করেছে এই প্রতিষ্ঠান। ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৮৭টি অভিযোগের হিসাব আছে তাদের কাছে। এই সময়ে মাত্র ছয়টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করেছে সংস্থাটি। ভুল চিকিৎসার অভিযোগের যেসব তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে নিষ্পত্তি হয়েছে, এর মধ্যে কিছু চিকিৎসকের ছয় মাস থেকে এক বছরের জন্য নিবন্ধন স্থগিত এবং কোনো কোনো ঘটনায় আর্থিক ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সমঝোতা হয়েছে। বিএমডিসি তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-২০১৮ সালে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ৫১টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির অভিযোগে ডা. সাদিকুর রহমানের নিবন্ধন তিন বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ছিল। একই বছরের ৪ জানুয়ারি শিশু ডেলিভারিতে ভুল করায় শাহাবুদ্দিন মেডিকেলের ডা. রোদিয়ার নিবন্ধন ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। ওই বছরের ২৫ জুলাই শিশুকে ভুল চিকিৎসা দেওয়া এবং ভুল পদ্ধতিতে ডেলিভারি করার অভিযোগ ওঠে একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। পরে সেটি ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণে সমঝোতা হয়ে যায়। ১০ জুলাই ভুল চিকিৎসার অভিযোগের জন্য রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. নাজমুল হকের নিবন্ধন ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। ১৯ নভেম্বর নাদিয়া হক নামে এক নারীর ভাঙা হাতে ভুল চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে রাজশাহীর একটি ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে। সেটি পরে ৫ লাখ টাকায় সমঝোতা হয়ে যায়। এর আগে ১৯ জুলাই রাজশাহীর আরেকটি ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. খন্দকার গোলাম মো. কবিরের বিরুদ্ধেও অভিযোগ পাওয়া যায়। সেটিও ৪ লাখ টাকায় সমঝোতা হয়। এদিকে গ্রিন আই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ২৫ মার্চ চোখের ছানি অপারেশন করে লেন্স না লাগিয়ে টাকা আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে বিএমডিসিতে একটি অভিযোগ দেন কাজী নবীন নামে এক ব্যক্তি। এর পরিপ্রেক্ষিতে জবাব চাইতে এপ্রিলে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কিউ এম ইকবাল হোসেনের কাছে চিঠি পাঠায় বিএমডিসির রেজিস্ট্রার। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব চিঠির কোনো উত্তর মেলে না, ফলে তদন্তও ঠিকমতো নিষ্পত্তি হয় না। চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব এ প্রতিবেদককে বলেন, স্বাস্থ্যসেবা পেতে সাধারণ মানুষ পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিএমডিসি নৈতিক ব্যবস্থা নিতে পারলেও ফৌজদারি অপরাধের ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই।

বিএমএর বর্তমান সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘একটা বিষয়ের ম্যারিট-ডিম্যারিট থাকতে পারে। চিকিৎসকদের ভুল থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসার বেসিক বুঝতে হবে। বিষয়টা তো এমন নয় যে চিকিৎসক দেখলেও রোগী ভালো হবে। ভালো-মন্দ তো আল্লাহর হাতে। তবে কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে বিএমএ, বিএমডিসি কিংবা আদালতে যে-কেউ যেতে পারে।’

২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট প্রতিবন্ধীর মধ্যে ৩ শতাংশ ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধিত্ব বরণ করেছেন। গত দুই বছরের ব্যবধানে দেশে ভুল চিকিৎসার হারও বেড়েছে।

মেয়েকে নিয়ে ভুল চিকিৎসার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রসায়ন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ড. আবিদা সুলতানাকেও। তার তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনামতে, এসএসসি পরীক্ষা চলার সময় তার মেয়ে আফরিদা ফারহীনের বমি শুরু হয়। বমি না কমায় এক আত্মীয়ের সাহায্যে তিনি মেয়েকে কমফোর্ট হাসপাতালে ভর্তি করান। হাসপাতালে দুই দিন থাকার পর বাসায় আনা হয়। এরপর আফরিদা বহু কষ্টে ১৪ ফেব্রুয়ারির পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা দেয়। বমি না থামায় পরদিন আবার সেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এদিন ডা. ফোয়াজ হোসেন শুভকে ভিজিটিং ডাক্তার হিসেবে আনা হয়। তার দেওয়া ওষুধ খাওয়ার পর মেয়ে শুধু ঘুমাতে থাকে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ওই চিকিৎসক আবার চেক করতে আসেন। বলেন, রোগী সুস্থ হয়ে গেছে, চাইলে পরদিন সকালে ছুটি নিতে পারবেন। এ ডাক্তার বিভিন্ন ওষুধের সঙ্গে ট্রাইফ্লুওপেরাজিন দেয়। এ ওষুধ খাওয়ার পর তার মেয়ের আরও নানা সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এ দৃশ্য দেখে তিনি দিশাহারা হয়ে পড়েন। দ্রুত ওই হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে মেয়েকে স্কয়ার হাসপাতালের ভর্তি করান। এখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, আগের ডাক্তারের দেওয়া ওষুধগুলোর মধ্যে ট্রাইফ্লুওপেরাজিন ছিল পাগল রোগীদের জন্য।

আরেক ভুক্তভোগী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মাসুদ রানা জানান, হঠাৎ তার স্ত্রী বুকের ডান পাশে ব্যথা অনুভব করেন। স্ত্রীকে মনোয়ারা অর্থোপেডিক অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে ডা. নিলুফার শবনমের কাছে নিয়ে যান তিনি। ডাক্তার ১৫ দিনের ওষুধ দিয়ে দেখা করতে বলেন। ওই ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথার স্থানটি আস্তে আস্তে লাল বর্ণ হতে থাকে। ফের সাক্ষাতে গেলে তিনি দ্রুত অপারেশন করতে বলেন। কোনো ধরনের টেস্ট ছাড়াই ডাক্তার সরাসরি অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের প্রায় ৪-৫ বছর পর একই জায়গায় আবার দানার মতো হয়ে যায়। শুরু হয় ব্যথা। আবারও ওই চিকিৎসকের কাছে গেলে তিন দিনের মধ্যে ফের অপারেশন করতে বলেন। ডাক্তার রাজধানীর পল্টনে তার হেলথ এইডে অপারেশন করাবেন বলে জানান। ডাক্তারের কথায় তাদের একটু সন্দেহ হওয়ায় সালাউদ্দিন জেনারেল হাসপাতালে আরেকজন চিকিৎসক দেখানো হয়। এই ডাক্তার জানান, অপারেশন ছাড়াই এ রোগী ভালো হবে।

জানা গেছে, ২১ মে গোপালগঞ্জে নার্স ভুল ইনজেকশন পুশ করায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মরিয়ম সুলতানা মুন্নীর অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। পরে ওই ছাত্রীকে খুলনা শেখ আবু নাসের হাসপাতালে পাঠানো হয়। ২৮ মে লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জের রয়েল হাসপাতালে সিজারের পর রুবিনা নামে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়। ভুল চিকিৎসায় তিনি মারা গেছেন বলে অভিযোগ স্বজনদের। প্রতিবাদে বিক্ষোভও করেন তারা। একই দিন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ফয়লাহাটে সুন্দরবন ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড প্রাইভেট হাসপাতালে ভুল অপারেশনে প্রসূতি ও নবজাতক মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া যায়। এর আগে উপজেলার চিত্রা গ্রামের রিকশাভ্যান চালক মোজাম্মেল শেখের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মুসলিমা বেগমকে ২৫ মে ভোর ৬টায় ফয়লাহাটে সিঅ্যান্ডবি মোড় সুন্দরবন ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর