শিরোনাম
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

রেলের ভূমি নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি

দুদকের ১৫ দফা সুপারিশ মন্ত্রীকে হস্তান্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। রেল বিভাগের শত শত একর ভূমি বেদখল হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে নিয়েছেন খোদ রেলের কর্মচারীরাই। পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের অধীনে রেলের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লিজ ও হস্তান্তরে অনিয়ম হয়ে থাকে। রেলওয়ের দুর্নীতির ওপরে দুদকের অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এমন দশটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক টিমের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলোকে সরকারের কাছে ১৫ দফা সুপারিশ করেছে দুদক। গতকাল রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের কাছে এ রিপোর্ট হস্তান্তর করা হয়েছে। 

দুদকের সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- রেলের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আইবিএ, বুয়েট ও বিএমসির মতো বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেওয়া। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে নিয়োগের প্রতিটি পদক্ষেপে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করতে হবে। স্বল্প সময়ের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা। বিভিন্ন ধরনের ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রকাশ্য বা ই-টেন্ডারিং ও দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন সিনিয়র কর্মচারীদের দায়িত্ব প্রদান। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পিপিআর অনুযায়ী পরামর্শক নিয়োগে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা। কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের বাসা ও অফিস স্থাপনার সম্পত্তিসমূহ  ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রির মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। অবৈধভাবে দখলে রাখা সম্পত্তিসমূহ রেলের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে নিতে হবে। প্রয়োজনে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে নিয়মিত মনিটরিং করা যেতে পারে। রেলের সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষের জন্য ডাটাবেজ করতে হবে। অবৈধ দখলে থাকা সম্পত্তির দখল উচ্ছেদের জন্য তালিকা করে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। উদ্ধার করা সম্পত্তি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এনে রক্ষার প্রয়োজনে সেল গঠন করতে হবে। ওয়ার্কশপ ও স্লিপার ফ্যাক্টরিগুলো সচল এবং কার্যকর করার ব্যবস্থা নেওয়া। আমদানি নিরুৎসাহিত করে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে কোচ নির্মাণের সক্ষমতা সৃষ্টি করা। একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণে পিপিএ এবং পিপিআর অনুসরণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন লাইন নির্মাণ বা সংস্কার কাজ তদারকির ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

অডিট কার্যক্রম জোরদার এবং অডিট আপত্তি জরুরিভাবে নিষ্পত্তির করা। পিপিআর অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে  রেলের পুরনো মালামাল বিক্রির ব্যবস্থা নিতে হবে। কালোবাজারি ঠেকাতে টিকিট বিক্রিতে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার ও নিয়মিত মনিটরিং করা। সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার ভিত্তিতে পদোন্নতি ও বদলি হবে। আধুনিকায়নের মাধ্যমে যাত্রীসেবা বাড়াতে হবে। নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রী নিরাপত্তা ও মালামাল পরিবহনে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। পর্যাপ্ত বগি, লোকোমোটিভ ও ওয়াগন ক্রয়সহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা প্রয়োজন। আন্তঃনগর ট্রেনসহ অন্যান্য ট্রেনে সরবরাহ বা বিক্রি করা খাবার মানসম্মত বা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রেনের পরিচালকের নেতৃত্বে তদারকির ব্যবস্থা থাকা দরকার। সব কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির আওতায় আনা যেতে পারে।

দুদকের দৃষ্টিতে রেলের দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে, অনেক জলাশয় বা পুকুরের লিজ প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়ম ঘটে। ফলে সরকারি রাজস্ব যথাযথভাবে আদায় হয় না। রেলের জায়গায় রেল সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে স্থাপনা নির্মাণ করতে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, এতে রেলের কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন। সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা, যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাবে শত শত একর ভূমি বেদখল হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করে কর্মচারীরা বাসাবাড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছেন। রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয় ও সংগ্রহসহ অন্যান্য ক্রয় বা সংগ্রহে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে। রেলের বিভিন্ন সেকশনের স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে। ডবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণেও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে। রেলের অধীনে ওয়ার্কশপগুলো কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। স্লিপার ফ্যাক্টরি অকার্যকর রেখে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়ে থাকে বলে জনশ্রুতির কথা জানিয়েছে দুদক। টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে কালোবাজারি হয়ে থাকে। কর্মচারীদের সহযোগিতায় বেশিসংখ্যক টিকিট কিনে কিছু দালাল আন্তঃনগর ট্রেনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। টিকিটের অভাবে জনগণকে দুর্ভোগে পড়তে হয়। যাত্রীবাহী ট্রেনের ইজারায়ও দুর্নীতি হয়ে থাকে। যাত্রীবাহী ট্রেনের কর্মচারীদের কাছ থেকে জনসাধারণ কাক্সিক্ষত সেবা পায় না। আন্তঃনগরসহ অন্যান্য ট্রেনে সরবরাহ ও বিক্রি করা খাবার নিম্নমানের। দামও তুলনামূলক বেশি। এক্ষেত্রে যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা প্রতিষ্ঠানের আইন ও বিধিবিধানের পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব এবং জনবল সংকট থেকে সৃষ্ট দুর্নীতির ক্ষেত্র ও উৎস চিহ্নিত করতে ২০১৭ সালে দুদক ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করেছে। দুর্নীতির উৎস বন্ধ বা প্রতিরোধে বাস্তবতার নিরিখে সুপারিশ প্রদান এই টিমের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এর মধ্যে রেলের অনুরূপ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং সুপারিশ প্রণয়নের জন্য কমিশনের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক টিম অনুসন্ধানে গিয়ে রেলের অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কর্মকর্তা এবং এ বিষয়ে যারা ভালো ধারণা রাখেন তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর