শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভিক্ষাবৃত্তি নিরুৎসাহিতকরণ কর্মসূচিতে সমন্বয় নেই

► লোকবলের অভাব
► বরাদ্দ অপর্যাপ্ত
► নতুন নীতিমালা আসছে

নিজামুল হক বিপুল

ঘটনা-১. ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফেরার জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি’র আওতায় ময়মনসিংহের ৩৭ জন ভিক্ষুককে রিকশা ও ভ্যান এবং নগদ পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই ভিক্ষুকদের একটা বড় অংশই পর্যায়ক্রমে তাদের রিকশা ও ভ্যান বিক্রি করে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে যায়।

এ ঘটনা বছর চারেক আগের। ঘটনা-২. বগুড়ার এক ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় গ্রাম উন্নয়ন কর্ম নামে একটি এনজিওর মাধ্যমে। টাকাটা দিয়েছিল পিকেএসএফ। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ওই ভিক্ষুক ভিক্ষাবৃত্তিতে ফিরে যেতে আগ্রহী হয় এবং ওই এক লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে।  ঘটনা-৩. সরকারের ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায়                সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার ৩১টি পরিবারকে ডিমপাড়া হাঁস দেওয়া হয়। তারা ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছে, সবকটি পরিবারই এখন স্বাবলম্বী।  এ ঘটনাও বছর চারেক আগের। ঘটনা-৪. রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়, পান্থপথ মোড়, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মোড়সহ বেশকিছু স্থানে চোখে পড়ে ‘ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকা’ লেখা সাইনবোর্ড। কিন্তু সবকটি মোড়ে প্রতিদিনই ভিক্ষুকরা পেশাগত কাজ করছে। ট্রাফিক সিগন্যালে থামা এ গাড়ি ও গাড়িতে গিয়ে তারা ভিক্ষা চায়।

এ চারটি ঘটনা বলে দিচ্ছে, ভিক্ষাবৃত্তি এবং ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য আট বছর আগে নেওয়া সরকারের নিরুৎসাহিতকরণ কর্মসূচিটি এখনো সাইনবোর্ড আর দাফতরিক কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ। কর্মসূচি চালু থাকলেও নেই পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। আবার যা-ই বরাদ্দ হয় তার যথাযথ ব্যবহারে সমন্বয় নেই।

কর্মসূচিটি বাস্তবায়নের জন্য সমাজসেবা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্যোগ থাকলেও জেলা প্রশাসকরা যার যার মতো করে কাজ করছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয়, দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা কত, তার কোনো সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যান নেই। ভিক্ষুকের সংখ্যা নির্ণয় করতে এখনো পর্যন্ত কোনো জরিপ হয়নি। তবে ঢাকার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদফতর বলছে, শুধু ঢাকায় ভিক্ষুকের সংখ্যা আনুমানিক ২১ হাজার। তবে এটা ২০১১ সালের তথ্য। এরপর আর কোনো তথ্য-উপাত্ত কেউ সংগ্রহ করেনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশকে ভিক্ষুকমুক্ত করতে রাজস্ব খাত থেকে অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে ২০১০-২০১১ অর্থবছরে  ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি’ প্রকল্প নেওয়া হয়। তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত গত প্রায় আট বছরে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রায় সাত কোটি টাকা। যা একেবারেই যৎসামান্য। তবে এই কর্মসূচি চালুর প্রথম দিকে সরকার এই খাতে প্রায় সাত থেকে আট কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল, কিন্তু ওই অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার না করায় এর প্রায় পুরোটাই ফেরত যায়। এরপর থেকে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে কর্মসূচিটি আশানুরূপ অগ্রসর হচ্ছে না।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সাড়ে চারশ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়া গেছে মাত্র তিন কোটি টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৫০ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। পাওয়া যাবে চার কোটি টাকা।

তবে সরকারি এই বরাদ্দের বাইরে দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) নিজেরা চেষ্টা-তদবির করে ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ বরাদ্দ নেন। সমাজ কল্যাণ পরিষদ থেকেও তারা বরাদ্দ নেন। কিন্তু সেই বরাদ্দ কীভাবে ব্যয় হয় তার কোনো স্বচ্ছ চিত্র পাওয়া যায় না।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিয়ে প্রকল্পটি চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকদের কাজের কোনো সমন্বয় নেই। এর ফলে বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতরা থাকেন অন্ধকারে। এখন দুই পক্ষের সমন্বয়ের ভিত্তিতে কর্মসূচিটি বাস্তবায়নে একটি নীতিমালা করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই এই নীতিমালা চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। নীতিমালাটি অনুমোদন হওয়ার পর সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা হবে।

কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও খুবই দুর্বল। কোনো এলাকায় ভিক্ষুককে পুনর্বাসন করা হলেও তারা শেষ পর্যন্ত স্বাবলম্বী হয়েছে কি না কিংবা ফের ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িয়েছে কি না- একটুও খতিয়ে দেখা হয় না। পরিণতিতে যাদের পুনর্বাসন করা হয়, তারা কিছুদিন পরই আবার একই কাজে নিয়োজিত হয়।

এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত প্রকল্প পরিচালক এবং সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. শাহ জাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসনে সবরকম চেষ্টা চলছে। গেল অর্থবছরে পুনর্বাসন করা হয় ২৭১০ জনকে। তবে লোকবলের অভাবে তাদের ওপর যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, শুধু পুনর্বাসন করলেই হবে না, ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। যারা ভিক্ষা দেন তাদেরও নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ এটা একটা সামাজিক ব্যাধি। তিনি আরও জানান, নীতিমালা হওয়ার পর একটা সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করা যাবে। তখন মনিটরিংটাও জোরদার করা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর