মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাজশাহী আওয়ামী লীগে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে এ জয়ের পরও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি রাজশাহী আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা নিয়ে নির্ভার আওয়ামী লীগ এখানে দুই ভাগে বিভক্ত। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত। একটি পক্ষ মেয়র-এমপির পক্ষে। অন্যরা নিজেদের ‘বঞ্চিত’ বলে দূরে সরে আছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় তাদের ক্ষমতায়িত করলেও কমেছে সাংগঠনিক শক্তি। কারণ এমপিরা বিজয়ী হওয়ার পর তাদের বিরোধিতাকারীদের এখনো দূরে সরিয়ে রেখেছেন, যার প্রভাব দেখা গেছে উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নের ক্ষেত্রেও।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে দুই ভাগ। এখানে তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রাব্বানী গত সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে রাজশাহী-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরোধিতা করেছিলেন। সেই ক্ষোভ থেকে এখনো গোলাম রাব্বানীকে দলের কর্মকা- থেকে বিরত রেখেছেন এমপি। উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের সভায় তাকে সভাপতিত্ব করতে দেননি এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ। গোদাগাড়ীতে উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থী নিয়ে এমপির বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বদিউজ্জামান।

রাজশাহী সদরে নগর সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ও সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের মধ্যে চলছে শীতল সম্পর্ক। ডাবলু সরকারকে সাংগঠনিক কর্মকা- থেকে কৌশলে দূরে রেখেছেন লিটন। অবশ্য ডাবলু সরকার এমন শীতল সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘নগর কমিটিতে কোনো বিরোধ নেই। ক্ষমতায় যারা থাকেন, তাদের কাছে নেতা-কর্মীদের ভিড় একটু বেশিই থাকে।’

রাজশাহীর পবা ও মোহনপুর নিয়ে রাজশাহী-৩ আসন। এখানে এমপি লীগ আর আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত কর্মীরা। একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মনোনয়নের সময় যারা বিরোধিতা করেছিলেন বর্তমান এমপি আয়েন উদ্দিনের, তাদের এখনো দূরে ঠেলে রেখেছেন এমপি। ফলে দলের ত্যাগী কর্মীরা নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ফারুক হোসেন ডাবলু জানান, এমপির দায়িত্ব কর্মীদের একত্র করা। কিন্তু পবা-মোহনপুরে এখনো দলের কর্মীরা বিভক্ত।

বাগমারায় এমপিবিরোধীরা এখনো কোণঠাসা। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও মনোনয়ন পাননি এমপিবিরোধী হিসেবে পরিচিত বর্তমান চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান এমপি এনামুল হক জানান, তিনি দলকে সংগঠিত করতে সব সময় কাজ করছেন। কয়েকজন নেতা সংগঠিত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছেন। এ কারণে দলের কর্মীরাই তাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলা নিয়ে রাজশাহী-৫ আসন। নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে ওই আসনে মনোনয়ন পাননি গতবারের এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারা। তবে মনোনয়ন পেয়েই নিজের বলয় গড়ে তুলেছেন বর্তমান এমপি ডা. মনসুর রহমান। পুঠিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি দারা। কিন্তু তাকে বাদ দিয়েই সভা করে কেন্দ্রের কাছে প্রার্থী তালিকা পাঠান ডা. মনসুর রহমান।

চারঘাট ও বাঘা উপজেলা নিয়ে রাজশাহী-৬ আসন। এ আসনটিতে প্রকাশ্যে বিরোধ থাকলেও গত সংসদ নির্বাচনে তা দূর হয়েছে। বাঘা উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন শাহরিয়ার আলমের বিরোধী হিসেবে পরিচিত অ্যাডভোকেট লায়েব উদ্দিন লাভলু। স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিনের বিরোধ মেটাতে এবার লাভলুর পক্ষেই ছিলেন শাহরিয়ার আলম। তবে দলের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে চারঘাটে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট টিপু সুলতান। এখানে মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন শাহরিয়ার আলমের ঘনিষ্ঠ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকরুল ইসলাম।

উপজেলা আর ইউনিয়নের মতো দলটির জেলা ও নগর কমিটির শীর্ষ নেতাদের দ্বন্দ্বও এখন প্রকাশ্য। দুই বছর ধরে সভাপতিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলে আসছে সাধারণ সম্পাদকদের। জেলার সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের। আর নগর সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারের।

একজন এমপি, অন্যজন মেয়র। ফলে জেলা ও নগর সভাপতির কাছে অনেকটা কোণঠাসা সাধারণ সম্পাদকরা। কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কেন্দ্রের ঘোষণার অপেক্ষায় আগামীর কাউন্সিল। ইতিমধ্যে জেলা ও নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে আসাদ ও ডাবলুকে সরাতে প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করেছেন ফারুক চৌধুরী ও লিটন। ফলে রাজশাহীর রাজনীতির মাঠের আলোচনায় এখন ‘মাইনাস’ আসাদ-ডাবলু।

পাঁচ বছর চার মাস আগে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে প্রথমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে তিন বছর মেয়াদি একটি কমিটি আংশিকভাবে গঠন করা হয়। এর প্রায় এক বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। সে হিসেবেও বর্তমান কমিটির মেয়াদ তিন বছর পার হয়ে প্রায় সাড়ে চার বছরে পড়েছে। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়েই চলছে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ। এর ফলে দলে বেড়েছে কোন্দল। দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।

দলীয় সূত্রমতে, দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহী জেলা কমিটির তেমন কোনো যৌথ কার্যক্রম নেই। সাধারণ সম্পাদকনির্ভর হয়ে আছে কমিটি। জেলা সভাপতি ও রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে শুরু থেকেই বনিবনা হয়নি সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের। সভাপতি চলেন ‘একলা চলো’ নীতিতে। জেলার রাজনীতিতে তার তেমন কোনো সক্রিয় অংশগ্রহণও চোখে পড়ে না। ফলে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন ফারুক চৌধুরী ও আসাদ। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। দ্বন্দ্বের মাত্রা চরমে উঠলে জেলার সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ‘রাজনীতি থেকে অবসর নেব কি না ভাবছি’ বলে ফেসবুকে একটি পোস্টও করেন। এর পর থেকেই মূলত রাজশাহীতে আলোচনায় আগামীতে সাধারণ সম্পাদক পদে থাকছেন না আসাদ। আসাদ যাতে ওই পদে আর থাকতে না পারেন, সে জন্য ফারুক চৌধুরীও তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে গুঞ্জন আছে।

জেলা আওয়ামী লীগের মতো নগর আওয়ামী লীগে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেন না। তবে দলীয় ও সরকারি নানা কর্মসূচিতে সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারকে এড়িয়ে চলেন নগর সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে দলের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের জন্য বসার ব্যবস্থা থাকলেও ডাবলুর জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকে না। ওই সব অনুষ্ঠানে লিটন উপস্থিত থাকলেও তিনি কোনো কথা বলেন না। মূলত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে থেকেই লিটন-ডাবলু বিরোধ। নির্বাচনের পর লিটন বিজয়ী হলে সেই বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।

দলীয় সূত্র জানায়, এই কমিটির মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়েছে। এ বছরের অক্টোবরের দিকে হতে পারে কাউন্সিল। এবার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ডাবলু সরকারকে চান না লিটন। কেন্দ্রেও বিরোধিতা করেছেন। ফলে আগামীর সাধারণ সম্পাদক কে- এমন প্রশ্ন এখন দলীয় নেতা-কর্মীদের মুখে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর