সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
যশোর

অভাবনীয় অগ্রযাত্রা হালকা প্রকৌশল শিল্পে

নিজস্ব প্রতিবেদক, যশোর

অভাবনীয় অগ্রযাত্রা হালকা প্রকৌশল শিল্পে

যশোরে তৈরি গাড়ি ও কৃষি যন্ত্রাংশ যাচ্ছে সারা দেশে। কয়েক বছর আগেও যেখানে এ ধরনের যন্ত্রাংশ ১০০ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো, এখন তা যশোরেই তৈরি হচ্ছে। গুণগত মানে অনেক ভালো কিন্তু দাম কম হওয়ায় স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশের প্রতিষ্ঠিত পরিবহন ব্যবসায়ীরা তাদের গাড়ির জন্য এসব যন্ত্রাংশ ব্যবহার করছেন। যশোরের হালকা প্রকৌশল জগতের কিছু পণ্য বিদেশেও রপ্তানি শুরু হয়েছে। যশোরে বর্তমানে এ বাজারটির আকার হাজার কোটির অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সরকারি সহযোগিতা পেলে এসব গাড়ি ও কৃষি যন্ত্রাংশ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে স্থানীয় উৎপাদকরা জানিয়েছেন। এর ফলে এসব যন্ত্রাংশ আর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে না। বরং রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। বিশ্ববাজারে প্রায় সাত ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের হালকা প্রকৌশল শিল্পপণ্যের চাহিদা রয়েছে। বিপরীতে বাংলাদেশে এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ মাত্র ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যশোরের উৎপাদকরা জানান, এখানে বিভিন্ন গাড়ির স্প্রিংপাতি থেকে শুরু করে শতাধিক ধরনের যন্ত্রাংশ, গাড়ির বডি, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট ও পাথরভাঙা মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত শ্যালো মেশিনসহ নানা যন্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে যশোরে তৈরি ইট ও পাথরভাঙা মেশিন কয়েক বছর ধরে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে।

যশোরে যারা গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে তাদের মধ্যে এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা অন্যতম। কারখানাটির স্বত্বাধিকারী আক্তার হোসেন ২০১১ সালে যশোরের বিসিক শিল্পনগরীতে এক বিঘা জমির ওপর এটি গড়ে তোলেন। তার কারখানায় কাজ করেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। এখানে তৈরি হয় বিভিন্ন গাড়ির শতাধিক ধরনের যন্ত্রাংশ। আক্তার হোসেন বলেন, গাড়ির ব্রেক ড্রাম, পেসার প্লেট, গিয়ার বক্স, ব্রেক ডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, গিয়ার বক্সের বডি থেকে শুরু করে দরকারি প্রায় সব ধরনের যন্ত্রাংশ তার কারখানায় তৈরি হয়। এসব যন্ত্রাংশের মূল্য ৫০০ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। তার কারখানার পণ্য স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানের খ্যাতনামা পরিবহন ব্যবসায়ীরাও কিনছেন। তরুণ উদ্যোক্তা কামরুল হাসান সোহেল বছর তিনেক আগে যশোরের উপশহর এলাকায় এস কে মেটাল ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন। তার কারখানায় তৈরি হয় পিকআপের স্প্রিংপাতি, যা এস পিকআপ, টি-কিং পিকআপ, জেক ও আইশার পিকআপে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার স্প্রিংপাতি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে এ কারখানার। এ কারখানায়ও অর্ধশতাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। কামরুল হাসান বলেন, গ্যাস, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ আর স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা পেলে তার কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা আরও অনেক বাড়ানো সম্ভব।

১৯৯৫ সালে যশোর শহরের এক প্রান্তে রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ নামে একটি কারখানা গড়ে তোলেন আশরাফুল ইসলাম বাবু। তার কারখানায় এখন তৈরি হচ্ছে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত স্টোন মিনি ক্রাশার, ইট ও পাথরভাঙা মেশিন, ইস্পলার, প্রেশার পুলি, লাইনার ¯øট প্লেট, পানির পাম্প, শ্যালো ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন মেশিনারিজ। এ প্রতিষ্ঠানের তৈরি ইট ও পাথরভাঙা মেশিন কয়েক বছর ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে। আশরাফুল ইসলাম বাবু বলেন, তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে গড়ে ১৫টি করে পাথরভাঙা মেশিন ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। এসব মেশিনের প্রতিটির দাম চার লাখ টাকা। দেশেও এ মেশিনের বাজার ভালো। অগ্রণী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক শমসের আলী বলেন, তাদের কারখানায় তৈরি হচ্ছে সরিষা ভাঙানো মেশিন, যা দেশের ৪০টি জেলায় যাচ্ছে। বিসিক শিল্পনগরীর ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং তৈরি করছে টিউবওয়েল, বিচালি কাটা মেশিন, বড় গাড়ির ড্রাম আর অটোবাইকের পার্টস। চট্টগ্রাম থেকে ভাঙা জাহাজের লোহা কিনে এনে তা গলিয়ে এসব পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। জেলায় এ রকম অন্তত ৩০০ হালকা ও ভারী প্রকৌশল শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

শুধু যন্ত্রাংশ নয়, গাড়ির বডি নির্মাণ শিল্পেও সারা দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে যশোর। গাড়ির বডি নির্মাতা মোহাম্মদ শাহিন জানান, সারা দেশের প্রায় সব বড় গাড়ির বডি যশোরে তৈরি হয়। স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশের বড় পরিবহন ব্যবসায়ীরাও তাদের গাড়ির বডি নির্মাণ করেন যশোর থেকে। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি যশোর জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদক সিরাজ খান মিন্টু বলেন, যশোরে তিন শতাধিক হালকা ও ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি প্রতিষ্ঠান ভারী শিল্পপণ্য উৎপাদন করছে, যার মধ্যে রয়েছে পাথর ও খোয়াভাঙা মেশিন, কৃষি যন্ত্রপাতির পার্টস, রাইস মিলের যন্ত্রাংশ, বড় গাড়ির যন্ত্রাংশ প্রভৃতি। এসব প্রতিষ্ঠানে বছরে হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করা হয়। যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, যশোরের হালকা প্রকৌশল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক আগে থেকেই জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত যন্ত্রাংশের মান খুবই ভালো। ব্যাংকগুলো যদি এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়, তাহলে এদের উৎপাদন সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। বিদেশে এসব পণ্যের বিশাল চাহিদা রয়েছে। সেই বাজারে যাতে সহজে এসব পণ্য রপ্তানি করা যায় সে ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর