শনিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘আত্মহত্যা’য় খুন রহস্য

পিবিআইর উদ্ঘাটন

নিজস্ব প্রতিবেদক

কোনো কোনো লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে স্পষ্ট আঘাতের কথা বলা হয়। কোথাও কোথাও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় খুনের ইঙ্গিতও তুলে ধরা হয়। এসবের কোনো কিছুকে আমলে না নিয়ে শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন তারা। জানিয়ে দেন আত্মহত্যাই মৃত্যুর কারণ। অথচ পরে জানা যায়, লাশের ময়নাতদন্তই ছিল ভুল। পুনরায় তদন্তে ওই আত্মহত্যায় বেরিয়ে আসে হত্যার রহস্য। গত বছর জুলাই থেকে চলতি বছর জুলাই পর্যন্ত এমন অন্তত ৩০টি ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে সংস্থাটি খুনের এ রকম ১৩টি ঘটনার কথা উল্লেখ করে ১৯ মার্চ একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে। একই সঙ্গে নির্ভুল ময়নাতদন্তের জন্য ১১টি সুপারিশ দিয়েছে। পিবিআইর প্রধান পুলিশের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সম্প্রতি জানান, লাশের ময়নাতদন্তে প্রযুক্তিগত কিছু ভুলত্রুটি রয়েছে। এ জন্য মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে বের হয় না। এগুলোর মান উন্নয়নের জন্য তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশও দিয়েছেন। সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আশ্বাসও দিয়েছে মন্ত্রণালয়। পিবিআই সূত্র জানায়, যশোরের অভয়নগরে গত বছর ২১ মার্চের একটি মামলা তদন্ত করে হত্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়। সিরাজগঞ্জে একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বরের একটি মামলায়ও হত্যারহস্য বের হয়। ২৭ জুন ঝিনাইদহের আরেকটি মামলায়ও আত্মহত্যা থেকে হত্যা প্রমাণিত হয়। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি বগুড়ার একটি মামলায়ও হত্যার রহস্য বের হয়। দিনাজপুরে গত ৩ মার্চে, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলায় ১৬ জুলাই এবং ২৪ জুলাই আত্মহত্যার প্রাথমিক অভিযোগ তদন্ত করতে গিয়ে হত্যার প্রমাণ পায় পিবিআই। জানা যায়, পুরান ঢাকার চকবাজারের একটি বাসা থেকে ২০১০ সালের ২৩ জুন আনিসুর রহমান নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঢামেক মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসক মতামত দেন আনিস আত্মহত্যা করেছেন। থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তদন্ত শেষে একই মতামত দেয়। কিন্তু মামলার বাদী আনিসের ভাই জাহাঙ্গীর মিয়া তৃতীয়বারের মতো নারাজি দিলে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। পাঁচ বছর পর তদন্তে বেরিয়ে আসে প্রেমের সম্পর্কের জেরে আনিসুর রহমান খুন হয়েছিলেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই আসামি গ্রেফতারের পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়। ২০১৫ সালের ১৯ জুন গাজীপুরের শ্রীপুরে সুমাইয়া আক্তার ফারহানা নামের এক গৃহকর্মীর লাশ সুরতহালে শরীরে বিভিন্ন আঘাতের কথা উল্লেখ ছিল। অথচ ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে মতামত দেওয়া হয়, সুমাইয়া আত্মহত্যা করেছিলেন। থানা-পুলিশও সে অনুযায়ীই ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। ঘটনার এক বছর পর তদন্তে বেরিয়ে আসে দাম্পত্য কলহের জেরে তার স্বামী শরিফুল তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধে হত্যা করে। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে শ্বশুরবাড়িতে তিন সন্তানের জননী নিলুফা আখতার বাখারাকে (২৫) শ্বাসরোধে হত্যা করেন তার দেবর। নিলুফারের ময়নাতদন্ত এবং ভিসেরা ও হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের এক চিকিৎসক মতামত দেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশ ও সিআইডি তাদের তদন্তে আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করে। পরে পিবিআইর তদন্তে আসে ধর্ষণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিলুফারের দেবর তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পিবিআইর সুপারিশ : ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা ডোমদের ওপর ‘অতিমাত্রায়’ নির্ভরশীল। এ ছাড়া প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন দেওয়া, সাক্ষী হওয়ার ভয়ে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের ময়নাতদন্তের কাজে অংশ না নেওয়া, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক না থাকাও ময়নাতদন্ত ভুল হওয়ার কারণ বলে মনে করে সংস্থাটি।

ময়নাতদন্তের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আলাদা স্থাপনা প্রয়োজন। ময়নাতদন্তে একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপস্থিত থাকতে হবে। ডোমদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও দায়িত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের আর্থিক বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা থাকা উচিত। বিচারক, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নিয়মিত সেমিনার বা ওয়ার্কশপের আয়োজন করা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর