বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কৃষকরা কোনো ফসলেই স্থির থাকতে পারছেন না

নানামুখী সংকট

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

বিপদে আছে কৃষক। স্থির হতে পারছে না কোনো ফসলেই। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, সংরক্ষণ ও বাজারজাত সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কৃষক কৃষিকাজই ছেড়ে দিচ্ছেন। যারা এখনো কৃষিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছেন, লাভের আশায় তারা কখনো ধান, কখনো পাট, কখনো গম বা ভুট্টা, আবার কখনো সব ছেড়ে সবজি চাষে মনোযোগী হচ্ছেন। কেউ আবার ধানের জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ শুরু করেছেন, পুকুর পাড়ে লাগিয়েছেন সবজিসহ বিভিন্ন ফলের গাছ। বর্গাচাষিদের বড় একটা অংশ কৃষি ছেড়ে অন্য কাজের আশায় পাড়ি জমিয়েছেন রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে। কেউ ধরেছেন রিকশার হ্যান্ডেল, কেউ চাকরি নিয়েছেন হোটেল-রেস্তোরাঁয়, আবার কেউ স্বল্প পুঁজিতে ফুটপাথে দোকান সাজিয়ে বসেছেন। গ্রাম থেকে আসা রাজধানীর শ্রমজীবী মানুষ এবং দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। পাটের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও প্রতি বছরই কমছে এর আবাদ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১১-১২  মৌসুমে ৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হলেও ২০১৮-১৯ মৌসুমে এসে কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৫১ হাজার হেক্টর। সাত বছরের ব্যবধানে পাটের আবাদি জমি কমেছে এক লাখ হেক্টরের বেশি। একই সময়ে গমের আবাদ কমেছে ২৯ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। ২০১১-১২ মৌসুমে আউশ ধান আবাদ হয় ১১ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে। কমতে কমতে ২০১৬-১৭ মৌসুমে দাঁড়ায় ৯ লাখ ৪১ হাজার হেক্টর। এর পর আবার বাড়তে শুরু করে। প্রতি বছর ওঠানামা করেছে বোরো ও আমন আবাদ। গম কমলেও ভুট্টার আবাদ বেড়েছে প্রতি বছর। সাত বছরের ব্যবধানে ভুট্টার আবাদি জমি ২ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৭ হাজার হেক্টর। কমেছে চীনাবাদাম, তিসি, অড়হড় ডালের আবাদ। বাড়ছে অন্যান্য ডাল ও সবজির আবাদ। সরেজমিন ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে দেখা গেছে, অনেক কৃষক বারবার ফসল পরিবর্তন করছেন। কেউ পাট থেকে কচু, আবার কেউ ধান বাদ দিয়ে আম চাষ শুরু করেছেন। অনেকে আবার কৃষি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন। নওগাঁর বদলগাছি থানার কৃষক অশ্বিনী গত সাড়ে চার বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান। বলেন, ‘কৃষিতে লাভ নেই। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে ঢাকায় আসি। পরিবার ছাড়া ঢাকায় মন না টিকলেও থাকতে হচ্ছে। রিকশা চালিয়ে ঋণ প্রায় শোধ করে ফেলেছি। কৃষিকাজ করলে সারা জীবনেও হয়তো পারতাম না।’ নাটোরের গুরুদাসপুরের চলনবিলে অন্যতম ফসল রসুন, তরমুজ এবং বাঙ্গী। সরেজমিন দেখা গেছে, রসুন-তরমুজের বদলে সমতল জমিতে পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ করছেন অনেকে। পাড় ঘেঁষে লাগানো হয়েছে কলাগাছ। পেশা পরিবর্তন করে অনেক কৃষক মৎস্য চাষিতে পরিণত হয়েছেন। কৃষক রমিজ আলী বলেন, রসুন, তরমুজে এক বছর লাভ হলে পরের বছর হয় না। কিন্তু আশপাশের অনেকে মাছ চাষ করে লাভ করছেন। সে জন্য পুকুর করে মাছ চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, জেলার অনেক কৃষক এখন ধান ছেড়ে অন্য ফসলে ঝুঁকেছেন। মহেশপুর উপজেলার নেপা ইউনিয়নের কুল্লাহ গ্রামের মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘এই উপজেলার কৃষকেরা ধানের ওপর নির্ভরশীল। আমি ছয় বিঘা জমিতে এবার ইরি মৌসুমে ধান করেছিলাম। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৭ হাজার টাকা। বিঘায় ধান পেয়েছি ২০ মণ। লাভের বদলে ৩ হাজার টাকা করে লোকসান হয়েছে। তাই ধান ছেড়ে ভুট্টা, তুলা, ফুল ও তামাক চাষ শুরু করেছি। এক বিঘা জমিতে তুলা চাষ করলে ২৫-৩০ হাজার টাকা লাভ হয়।’ একইভাবে সদর উপজেলার বাড়ি বাথান গ্রামের মীর সেলিম হোসেন ধান চাষ বাদ দিয়ে কলা, পান ও সবজি চাষ শুরু করেছেন।

রংপুর প্রতিনিধি জানান, রোগের আক্রমণ ও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় জেলার অনেক কৃষক গমের আবাদ ছেড়ে দিচ্ছেন। গঙ্গাচড়া উপজেলার গজঘণ্টা গ্রামের কৃষক আবু জাফর প্রতি বছর চার বিঘা জমিতে গমের আবাদ করলেও গত বছর নিজে খাওয়ার জন্য শুধু আধা বিঘা জমিতে গম চাষ করেন। বাকি জমিতে সবজি ও হাড়িভাঙ্গা আম গাছ লাগিয়েছেন। তিনি জানান, গম চাষে লাভ হয় না বললে চলে। শুনেছি গমচাষিদের সরকার ভর্তুকি দেয়। কিন্তু আমি কখনো পাইনি। তাই সবজি ও আম চাষ শুরু করেছি।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, পাটের জন্য বিখ্যাত ফরিদপুরের অনেক কৃষক পাট ছেড়ে কচু, পিয়াজের বীজ, আম চাষ করছেন। সদর উপজেলার অম্বিকাপুর ইউনিয়নের কৃষক বক্তার হোসেন বলেন, গত বছর ২ একর (নিজের ও বর্গা মিলিয়ে) জমিতে পাট চাষ করেছিলেন। এবার বর্গা জমি ছেড়ে দিয়ে শুধু নিজের জমিতে পিয়াজের বীজ আবাদ করেছেন। কারণ হিসেবে পোকার আক্রমণে পাট নষ্ট হওয়া ও পাট পচাতে পানি না পাওয়াকে দায়ী করেন তিনি।

নাটোর প্রতিনিধি জানান, সময়মতো দাম না পাওয়ায় নাটোরের আখচাষিরা এখন অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। উত্তর বড়গাছার আখচাষি আবদুল আজিজ মন্ডল বলেন, তিনি প্রতি বছর ২০ বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন। কিন্তু, মিলে আখ দেওয়ার পর দাম পেতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। এ বছর তাই পুরো জমিতে পাট চাষ করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মীর নূরুল আলম বলেন, নানা প্রযুক্তি দিয়ে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফলে কৃষিজমি কমলেও উৎপাদন বাড়ছে। কিন্তু রপ্তানি বাজারটা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। এত কৃষিপণ্য স্থানীয় বাজারেও খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দাম কমে যাচ্ছে। এ কারণে কৃষক নতুন নতুন ফসলে ঝুঁকছে। রপ্তানি বাড়াতে পারলে কৃষক লাভবান হতো।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর