মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগ

সভাপতি-সম্পাদকের একতরফা সিদ্ধান্তে এমপিদের সঙ্গে বিরোধ

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের ১৪টি ইউনিটে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মন্ত্রী ও সরকারদলীয় এমপিদের কৌশলে পাশ কাটাতে জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তোড়জোড় শুরু করেছেন। এতে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নেতাদের। ফলে কমিটি থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী। দলীয় সূত্র জানায়, পৌনে চার বছর আগে গঠিত জেলা কমিটি অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনায় উপজেলা, পৌরসভার ১৪টি ইউনিট কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিলে উচ্ছ্বসিত হন নেতা-কর্মীরা। কিন্তু উপজেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠনের পর থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমনসহ দায়িত্বশীল নেতারা নিজেদের পছন্দের লোকদের পদে বসাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন। তাদের একতরফা সিদ্ধান্তের কারণে বিভিন্ন উপজেলায় বঞ্চিত হন সরকার দলের সংসদ সদস্যদের অনুসারী নেতা-কর্মীরা। এতে জেলা নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে সরকার দলের সংসদ সদস্যদের। সংসদ সদস্য ও ধর্মপাশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থাকার পরও মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকে পাশ কাটিয়ে ধর্মপাশা উপজেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করায় উত্তেজনা দেখা দিলে সম্মেলন স্থগিত করে জেলা আওয়ামী লীগ। তবে নেতারা বলছেন, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবীর কারণে সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের সবাইকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। এর জের ধরে শুক্রবার অনুষ্ঠিত মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মঞ্চ দখল করে নেন মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের অনুসারীরা। পরে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় মঞ্চ উদ্ধারের পর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও সম্মেলন শেষে কমিটি ঘোষণা না দিয়েই জেলায় ফিরে আসেন নেতারা।

সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, ওয়ার্ড, ইউনিয়নের কোনো প্রকার কমিটি গঠন না করে মধ্যনগরে সম্মেলনের নামে নাটক করা হয়েছে। জুমার নামাজের সময় কোনো প্রকার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ২০ মিনিটে সম্মেলন শেষ করা হয়েছে। আমি স্থানীয় এমপি থাকার পরও নামাজ পড়ে এসে দেখি সম্মেলন সমাপ্ত। তিনি অভিযোগ করেন, জেলা নেতারা নিজেদের পছন্দের লোকদের বসাতে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও অগঠনতান্ত্রিকভাবে সম্মেলন করে কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই চলে এসেছেন। আমি হাইকমান্ডকে বিষয়টি জানিয়েছি। একইভাবে সুনামগঞ্জ-৫ আসনের ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় সভাপতি সমর্থক আবুল কালাম চৌধুরী ও শামীম আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে কমিটি নিয়ে ঠা-া লড়াই চলছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুহিবুর রহমান মানিকের। অতীত পক্ষপাতিত্বের কারণে এই দুই উপজেলায় মানিকের আস্থাভাজন হওয়ার কারণে গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি থেকে ছিটকে পড়েছিলেন একাত্তরের রণাঙ্গনের সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত ইদ্রিস আলী। তার বিপরীতে উপজেলায় বিদ্রোহী ফরিদ আহমদ তারেককে দোয়ারাবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক করেন মতিউর রহমান। ছাতকেও প্রয়াত লুৎফুর রহমান সরকারের মতো নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগ নেতারা বঞ্চিত হন সভাপতির রোষানলে পড়ে। দলীয় সূত্র জানায়, এবারও ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা আওয়ামী লীগে এমপি মানিকের অনুসারী হওয়ায় অনেক ত্যাগী নেতা দলীয় পদ-পদবি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, ’৭১ সালে পাকিস্তানিদের সহযোগী, ’৭৫ সালে মিষ্টি বিতরণকারী এবং দলের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া দুর্নীতিবাজদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কেউ দেখতে চায় না। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত ছাতক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, বর্তমান জেলা নেতাদের মাধ্যমে তৃণমূলের প্রত্যাশা অনুযায়ী নিরপেক্ষ কমিটি গঠন সম্ভব নয়। কারণ তারা সম্মেলনের নাম করে ঘরে বসে পছন্দের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন শুরু করেছেন। কেন্দ্রের কাছে আমাদের চাওয়া হলো, তৃণমূলের ত্যাগীদের মূল্যায়নের জন্য জেলা নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।  তিনি আরও বলেন, ’৭১ ও ’৭৫-এর  সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিবাজরাই ঘুরেফিরে  কমিটি গঠনের দায়িত্বে রয়েছেন। নেত্রী যাকে যুবলীগ থেকে এনে তরুণ হিসেবে সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন, সে-ই তাদের সঙ্গে  মিশে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদ মনোনয়ন বাণিজ্য করে দলের ভরাডুবি ঘটিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। তিনি বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি বিলুপ্ত করে সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে সর্বজন গ্রহণযোগ্য সৎ ও স্বাধীনতার পক্ষের কাউকে আহ্বায়কের দায়িত্ব দিয়ে উপজেলাগুলোতে কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিলে তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা মূল্যায়িত হবেন।  দলীয় সূত্র আরও জানায়, সুনামগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটির সবাই ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ প্রয়াত আইয়ুব বখত জগলুলের পছন্দের। তার অনুপস্থিতিতে পুরো কমিটিই নিজেদের অনুসারীদের বসাতে চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক- এমন কথা এখন রাজনীতিতে চাউর।

সুনামগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজিদুর রহমান বলেন, সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হলেও জেলার দায়িত্বশীলরা এখনো আমাদের সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ করেননি। এতেই বোঝা যাচ্ছে তারা আমাদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করতে চাইছেন। তিনি বলেন, আইয়ুব বখত জগলুল ও তার পরিবার এই জেলায় আওয়ামী লীগের ভিত্তি রচনা করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই পরিবার অনন্য অবদান রেখেছিল। এখনো তার ভাই পৌরসভার মেয়র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ অনুসারী এই পরিবারকে বাদ দিয়ে কোনো কমিটি গ্রহণযোগ্য হবে না।

দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় সুরঞ্জিত সেনপত্নী সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তার বিপরীতে নিজের আস্থাভাজনদের বসাতে চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান। দিরাইয়ের বর্তমান সভাপতি আসাব উদ্দিন সরদারের স্থলে সাবেক সভাপতি আলতাব উদ্দিন মাস্টারকে চান মতিউর। শাল্লায় তার পছন্দ বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওলিউর রহমান। দুই উপজেলায় সাবেক কমিটিগুলো বহাল রাখার পক্ষে জয়া সেনের অনুসারীরা। জানা যায়, সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের আসনভুক্ত দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলায় নিজের পছন্দের লোকদের বসাতে চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন। সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সভাপতি মতিউর রহমান ও সিনিয়র সহ-সভাপতি নূরুল হুদা মুকুটকে ছাড় দিয়ে এই দুই উপজেলায় নিজের আধিপত্য কায়েম করতে আপসরফা হওয়ার কথা বলছেন অনেকে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান বলেন, ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভার সবগুলো কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হবে। এখানে কে কোন বলয়ের, কার পরিচয় কী সেটা মুখ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না। জেলা দায়িত্বশীলরা কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব করছেন না।

সুনামগঞ্জে ১২ ইউনিটে সম্মেলন স্থগিত : সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ১২টি উপজেলা ও পৌরসভার নির্ধারিত সম্মেলন অনিবার্য কারণে স্থগিত ঘোষণা করেছে কেন্দ্র । সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নূরুল হুদা মুকুট জানান, সুনামগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসাইন টেলিফোনে তাকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ১২ ইউনিটের সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের বরাত দিয়ে আহমদ হোসেন তাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান সম্মেলন স্থগিতের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান। গতকাল সন্ধ্যা ৬টায় তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হবে। পরে এ বিষয়ে জানানো যাবে।

সর্বশেষ খবর