শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
প্রশ্ন ওয়াশিংটন ডিসির সভায়

ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে জামায়াতিরা আমন্ত্রণ পাচ্ছে কীভাবে?

নিউইয়র্ক প্রতিনিধি

বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের জামায়াতিরা যুক্তরাষ্ট্রে এসে ছদ্মনামে ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে চরমপন্থি তথা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিতদের মদদ দিচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, জামায়াতিদের সে সব সংগঠনের লোক দেখানো কার্যক্রমে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে মার্কিন প্রশাসন।

গত অর্থ বছরে ৬১টি ইসলামিক প্রতিষ্ঠানকে ৪৭ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এগুলো দেওয়া হয় ৪১১টি সেবামূলক প্রকল্পে।               

সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই মার্কিন সরকার এমন অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছে। তবে ইসলামিক কর্মকা-ের আড়ালে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কে সম্পৃক্তরাও পেয়েছে অনুদানের এ অর্থ। ফেডারেল সরকারের অনুদান পাওয়া সংস্থাগুলোর ৩৬% হচ্ছে মুসলমানদের সমন্বয়ে গঠিত এবং তারা পেয়েছে মোট বরাদ্দের ৪৪% অর্থ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির সঙ্গে চরমপন্থি সংগঠনের সম্পর্ক রয়েছে। ১৪% শুধু প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে। ফেডারেল সরকারের ডাটা অনুযায়ী, ৪৭ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৪১ মিলিয়ন ডলার অনুদান পাওয়া সংস্থাগুলো পরিচালিত হচ্ছে সরাসরি মুসলিম ব্রাদারহুড, জামায়াতে ইসলামী, সালাফি, দেওবন্দ (যারা তালেবানের জন্ম দিয়েছে) এবং ইরানের একটি সংস্থার মাধ্যমে।

শুধু তাই নয়, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের অনুষ্ঠানে এখনো জামায়াতিরা দাওয়াত পাচ্ছে, আতিথেয়তা পাচ্ছে। উদ্বেগজনক এসব তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে গত ১৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল হিলে আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে।

‘দেশে ও বিদেশে জামায়াতে ইসলামী হুমকি’ শীর্ষক এ আলোচনার আয়োজন করে মধ্যপ্রাচ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা-অগ্রগতি নিয়ে কর্মরত ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ‘মিডলইস্ট ফোরাম’। সহযোগিতায় ছিল থিঙ্কট্যাংক ‘লিবার্টি সাউথ এশিয়া’ ‘দ্য ইনভেস্টিগেটিভ প্রজেক্ট অন টেররিজম’ এবং ‘দ্য সাউথ এশিয়ান মাইনোরিটিজ এলায়েন্স ফাউন্ডেশন’।

বিষয়বস্তুর ওপর এসব সংস্থার সরেজমিন গবেষণামূলক তথ্য উপস্থাপন করেন টেররিজম নিয়ে অনুসন্ধানী প্রকল্পের সিনিয়র ইনটেলিজেন্স এনালিস্ট আভা শংকর, মিডল ইস্ট ফোরামের ইসলামিস্ট ওয়াচ ডিরেক্টর স্যাম ওয়েস্ট্রপ, লিবার্টি সাউথ এশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শেথ ওল্ডমিক্সন এবং সাউথ এশিয়া মাইনোরিটিজ এলায়েন্সের চেয়ারম্যান নাদিম নূশরাত।

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ ধর্মীয় উগ্রপন্থি সংগঠনের তৎপরতা নিষিদ্ধ এবং একাত্তরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অংশ নিয়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ায় প্রায় এক কোটি বাঙালিকে বসতবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করার জন্য অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী যে মানবতার জন্যে ভয়ঙ্কর- তা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন ও জনগণকে অবহিত করতে মার্কিন কংগ্রেসে বিল উত্থাপনকারী (এইচআর-১৬০) রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাংকস বিস্তারিত আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের আলোচনা-বিশ্লেষণ যত বেশি হবে তত দ্রুত বিলটি পাস হবে এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচিত হবে সর্বত্র।

কংগ্রেসম্যান ধন্যবাদ জানিয়েছেন আয়োজকদের। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার প্রশাসনের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ধর্মীয় কারণে বিতাড়িত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপদ-আশ্রয় দানের জন্যে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের প্রশাসনেও জামায়াতিদের প্রভাব রয়েছে। কংগ্রেসম্যান বলেন, আমেরিকায় ইকনাসহ বিভিন্ন নামে জামায়াতিরা সংগঠিত রয়েছে। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে ঝোলা অথবা বিচারাধীনদের সন্তানরাও পালিয়ে কিংবা অন্য কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে। তারা নানাভাবে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে কাজ চালাচ্ছে উগ্রপন্থিদের পক্ষে। এদের ব্যাপারে সমাজের সবাইকে সচেতন করার দায়িত্ব প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষদের।

কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাংকস বলেন, জামায়াতিদের ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। এ ধরনের সংগঠনের ওপর কড়া নজরদারির বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন ইন্ডিয়ানার এই কংগ্রেসম্যান।

আভা শংকর বলেন, ১৯৭৭ সালে নিউইয়র্কে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী ইকনা সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন। বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত থাকার দায়ে ফাঁসিতে ঝোলার কয়েক বছর আগে একাত্তরের সেই ঘাতকেরা ইকনা সম্মেলনে নিয়মিতভাবে অতিথি থাকত। এগুলো কল্পকাহিনি নয়।

অপর আলোচকরা বলেন, জামায়াতে ইসলামী পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা কর্মকা- পরিচালনা করে বিভিন্ন নাম ধারণ করে। মানবাধিকারের জিকিরও তোলে। বিশেষ করে বর্তমানে সাউথ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মের নামে তাদের বর্বরতা অব্যাহত রয়েছে। ভারতের কাশ্মীরে তারা জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালনা করছে দীর্ঘদিন থেকে। পাকিস্তানে তারা লস্কর-ই-তৈয়বার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের অপর নাম জামায়াতে ইসলাম। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সংগঠনের নাম ইকনা অর্থাৎ ইসলামী সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা। বর্তমানে সংগঠনটি এখান থেকে মানবতার সেবার নামে অনুদান সংগ্রহ করে সাউথ এশিয়ায় তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাে  সহায়তা করে। মুনার সঙ্গেও রয়েছে এদের ঘনিষ্ঠতা।

প্যানেল আলোচনার পরে প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট অমর ইসলাম জানতে চান যে, কীভাবে কত দ্রুত সময়ের মধ্যে জামায়াতিদের ছদ্মবেশী সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করা যাবে। সে ব্যাপারে এসব থিঙ্কট্যাংকের ভূমিকা কী?

বাংলাদেশ থেকে আসা সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ আরাফাতও জানতে চান ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসে জামায়াতিরা আমন্ত্রণ পাচ্ছে কীভাবে? তিনি বলেন, আমরা যতই আলোচনা করি, প্রতিবাদ জানাই, তারা বিরত হচ্ছে না। অধিকন্তু প্রতিটি দূতাবাস এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টে তাদের পছন্দের লোকদের দ্বারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে মার্কিন প্রশাসনের কোনো কোনো অংশ মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্তদের আশকারা দিচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতির অবসানে সবাইকে আরও সোচ্চার হতে হবে। অধ্যাপক আরাফাত বাংলাদেশে জামায়াতিদের কর্মকৌশলের আলোকপাতকালে বলেন, ওরা ইসলামের নামে যা বলে তা বাস্তবায়নে বিশ্বাসী নয়। ওরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত বর্বরতা চালাচ্ছে। ওরা জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে জঙ্গি-বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের পর নানা পথে যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিভিন্ন ব্যানারে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। ওরা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্যে হুমকি নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যেও মারাত্মক হুমকি।

কমিউনিটি লিডার দস্তগীর জাহাঙ্গীরও ভিন্ননামে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-কে চিহ্নিত করার প্রসঙ্গ আলোকপাত করেন। এ আলোচনা অনুষ্ঠানে বিশিষ্টজনদের মধ্যে আরও ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. খন্দকার মনসুর, মেট্রো ওয়াশিংটন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলাউদ্দিন আহমেদ, যুবলীগের সভাপতি দেওয়ান আরশাদ আলী বিজয়। আরও ছিলেন ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপপ্রধান মাহবুব হাসান সালেহ। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকজনও ছিলেন এ আলোচনায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর