দেশের জাতীয় রাজনীতিতে একসময় দাপুটে অবস্থান ছিল সিলেটের রাজনীতিবিদদের। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বে ছিল তাঁদের অবস্থান। দলগুলোর নীতিনির্ধারণী ফোরামে প্রভাব ছিল বৃহত্তর সিলেট থেকে উঠে যাওয়া এসব রাজনীতিবিদের। কিন্তু সেই দাপুটে অবস্থান এখন আর নেই। দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পদে দেখা মিলছে না সিলেটীদের। সময়ের পরিক্রমায় রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে শূন্যতায় পৌঁছাচ্ছে সিলেট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিলেট থেকে জাতীয় পর্যায়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ দেখা না যাওয়ার যে শূন্যতা, সে শূন্যতা নিকট ভবিষ্যতে পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন ঘিরে যে আশার বেলুন উড়ছিল, সেই বেলুনও সম্মেলন শেষে চুপসে গেছে অনেকটাই।
তারা বলছেন, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ যখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, তখন তাঁকে কেন্দ্র করে জাতীয় পর্যায়ে সিলেটের অবস্থানের আশা করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের ঝড়ে সুলতান ‘লাইনচ্যুত’ হয়ে পড়ায় সেই আশা মিইয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। তাঁকে ঘিরেও জাতীয় রাজনীতিতে সিলেটের শূন্যতা পূরণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এবারের সম্মেলনে পদ হারিয়েছেন মিসবাহ, নতুন কোনো পদেও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি তাঁকে। এর ফলে মিসবাহকে ঘিরে থাকা সম্ভাবনা ডানা মেলার আগেই ভূপাতিত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির রাজনীতিতে এম ইলিয়াস আলীকে ঘিরে প্রবল সম্ভাবনা ছিল। ক্রমেই নিজেকে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বিএনপির সাবেক এই সাংগঠনিক সম্পাদক। কিন্তু ‘নিখোঁজ রহস্যে’ হারিয়ে যাওয়ায় ইলিয়াসকে ঘিরে সম্ভাবনাও পুরোদমে প্রস্ফুটিত হয়নি। পরে ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও ইলিয়াসের মতো অবস্থান এখনো গড়তে পারেননি তিনি। এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ ও বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ছিলেন জাতীয় পর্যায়ে সিলেটের প্রতিনিধি। কিন্তু নাহিদ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও সিলেটে তাঁর শক্তিশালী অবস্থান নেই। আর শমসের রাজনীতি থেকে এখন অনেকটাই আড়ালে। সূত্রে জানা গেছে, বৃহত্তর সিলেট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণে প্রভাবশালী অবস্থান রাখা রাজনীতিবিদদের তালিকা নেহাতই ছোট নয়। এ তালিকায় থাকা আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন আওয়ামী লীগের দাপুটে প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিএনপির এম সাইফুর রহমান জাতীয় সংসদে সর্বোচ্চবার বাজেট পেশে প্রথম স্থানে ছিলেন। গেল বছর আরেক সিলেটী আবুল মাল আবদুল মুহিত পেছনে ফেলেন সাইফুরকে। এ ছাড়া প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া, সাবেক মন্ত্রী ফরিদ গাজী, এরশাদ আমলের রিয়াল অ্যাডমিরাল এম এ খানÑ প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদদের সবাই ছিলেন সিলেটের কৃতীসন্তান। এসব রাজনীতিবিদ স্বমহিমায় উদ্ভাসিত ছিলেন নেতৃত্বগুণে।
নিজ দলের নীতিনির্ধারণে তাঁরা রাখতেন অগ্রণী ভূমিকা। তাঁদের হাত ধরেই সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছিল বৃহত্তর সিলেট। এ তালিকার একমাত্র মুহিত ছাড়া বাকি সবাই না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁদের মৃত্যুতেই মূলত জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বশূন্যতায় পড়ে যায় সিলেট।এদিকে, বাম রাজনীতিতেও সিলেটী নেতাদের শক্ত অবস্থান ছিল একসময়। কমরেড বরুণ রায়, পীর হবিবুর রহমান প্রমুখ দেশপ্রেমিক নেতা দেশের বামধারার রাজনীতিতে এখনো পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁদের কাতারে যেতে পারেননি সিলেটের অন্য কেউ।