মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

অনিশ্চিত লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল

পিপিপির ভিত্তিতে পাঁচ বিদেশি প্রতিষ্ঠান তালিকায়

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

অনিশ্চিত লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল প্রকল্প নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও লালদিয়ার চরে বসবাসরতদের অন্যত্র পুনর্বাসন নিশ্চিত না হওয়ায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়েছে। এমনিতে প্রকল্পটি নিয়ে বন্দর ব্যবহারকারীদের মাঝেও রয়েছে এক ধরনের অসন্তোষ। ফলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষের। চট্টগ্রাম বন্দরের একটি সূত্র জানা গেছে, বন্দরের প্রায় সবকটি প্রকল্প রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে বাস্তবায়িত হলেও লালদিয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে বিদেশি অর্থায়নে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর যে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে তাদের কিছু শর্ত চট্টগ্রাম বন্দরের স্বার্থ পরিপন্থী হিসেবে দেখছেন বন্দর-সংশ্লিষ্টরা। দেশের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে এই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পাঁচ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট মাল্টি পোর্ট অপারেটর আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড, দুবাইভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ড, ফ্রান্সের বোলোর, বেইজিংভিত্তিক চায়না হারবার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক গ্লোবাল পোর্ট সার্ভিসেস। এ তালিকার যে প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্প নির্মাণের দায়িত্ব পাবে তারাই টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। টার্মিনালটি পরিচালনায় যেসব শর্ত রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে, এই টার্মিনালে বছরে অন্তত তিন লাখ টিইইউজ কনটেইনার হ্যান্ডলিং হতে হবে। এ লক্ষ্য পূরণ সম্ভব না হলে এর ক্ষতিপূরণ চট্টগ্রাম বন্দরকেই বহন করতে হবে। ২৫ বছরের জন্য লালদিয়া চরের ৫৭ একর জায়গা দেওয়া হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যোগ্য বিবেচিত বা নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানকে। সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানটি টার্মিনাল নির্মাণ এবং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করবে। ২৫ বছর পর বিদেশি ওই প্রতিষ্ঠান ইকুইপমেন্টসহ টার্মিনালটি বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে চলে যাবে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত পণ্যের কনটেইনার হ্যান্ডলিং কোথায় করা হবে তা আমদানিকারকের একান্ত এখতিয়ার। লালদিয়া টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে কোনো আমদানিকারক যদি সেখানে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে রাজি না হয়, এর দায়ভার কেন বন্দর নেবে? এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালসহ বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন চলমান থাকায় এ মুহূর্তে ঝামেলাপূর্ণ লালদিয়া প্রকল্প নিয়ে এগোতে চাইছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ।

বন্দর-সংশ্লিষ্টরা জানান, এ প্রকল্পের বড় বাধা লালদিয়ার চরে উচ্ছেদ অভিযান। কারণ প্রকল্পটি যে এলাকায় বাস্তবায়িত হবে সেই এলাকায় অন্তত ১৭০০ পরিবার বসবাস করে আসছে। এ পরিবারগুলো এর আগে পতেঙ্গা বিমানবন্দরের কারণে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে একবার উচ্ছেদ হয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় লালদিয়ার চরে বসতি স্থাপন করে। লালদিয়া টার্মিনাল প্রকল্প এলাকায় উচ্ছেদ অভিযানের জন্য একাধিকবার নোটিস দেওয়া হলে তারা যে কোনো মূল্যে উচ্ছেদ প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই বাস্তবতায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ওই জয়গায় প্রকল্পের কাজ শুরু করা আদৌ সম্ভব কি না তা নিয়ে রয়েছে মহা অনিশ্চয়তা। যদিও এই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরকে নির্দেশনা দিয়েছে হাই কোর্ট। ওই আদেশের কপি পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা রয়েছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি ম্যানেজার (স্টেট) জিল্লুর রহমান বলেন, উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে আদালতের রায়ের কপি পাওয়ার পর উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১১ মার্চ ক্যাবিনেট কমিটি অন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স লালদিয়া প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়। প্রথমদিকে এটাকে শুধু বাল্ক টার্মিনাল করার পরিকল্পনা থাকলেও পরে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন নিয়ে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এসব জটিলতা শিগগিরই দূর হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে আমরা এখনো আশা ছাড়িনি।’

প্রসঙ্গত, লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনালে মোট ১ হাজার মিটার দীর্ঘ স্থানজুড়ে পাঁচটি জেটি এবং ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্য ও ৩০০ মিটার প্রস্থের ব্যাকআপ ইয়ার্ড নির্মাণ করা হবে। পতেঙ্গা এলাকার ১৪ ও ১৫ নম্বর খালের মাঝামাঝি নির্মিত হওয়ার কথা রয়েছে লালদিয়া প্রকল্পটি। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সহজতর করতে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল আর আউটার রিং রোডের নিকটবর্তী পতেঙ্গার লালদিয়ায় ৫৭ একর জমির ওপর টার্মিনালটি নির্মিত হবে। প্রায় আট লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতাসম্পন্ন এই মেগা টার্মিনাল চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর