শনিবার, ১৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে বরিশালে সবজি বিপ্লব

রাহাত খান, বরিশাল

ভাসমান চাষ পদ্ধতিতে বরিশালে সবজি বিপ্লব

বছরের অর্ধেকটা সময়, বিশেষ করে বর্ষায় জলাবদ্ধতার কারণে দেশের প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে। এই সময়ে জলাবদ্ধ জমিতে কোনো কৃষি হয় না। ফলে ওইসব এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কর্মের ব্যবস্থা নেই। জমিতে কৃষি ফলন না হওয়ায় লোকসান হতো কৃষকের। ঘাটতি দেখা দিত শাক-সবজিসহ খাদ্য সামগ্রীর।  আগে বরিশালের নিম্নাঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত বানারীপাড়া ও আগৈলঝাড়া, ঝালকাঠী সদর এবং পিরোজপুরের নেছারাবাদসহ আশপাশের এলাকার কৃষকরা জলাবদ্ধ জমিতে স্থানীয় পদ্ধতিতে কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান ধাপ (বেড) তৈরি করে শুধু সবজির চারা উৎপাদন করতেন। বাকি সময় একেবারেই অনাবাদি থাকত জলাবদ্ধ প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমি। এবার গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে ওইসব জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি ও মসলা চাষ করে সাফল্য পেয়েছে বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। মাটি ছাড়া ভাসমান পদ্ধতিতে বিষমুক্ত উপায়ে লাউ, শসা, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, লতিরাজ কচু, পিয়াজ-রসুন, পিয়াজের                কলিসহ বিভিন্ন সবজি ও মসলার ব্যাপক উৎপাদনের খবর ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিদিন আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে ভিড় করছেন আশপাশের কৃষকরা। তারা এই পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

ভাসমান ধাপে শুধু চারা নয়, এবার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সবজি এবং মসলার সফল উৎপাদনের কৌশল উদ্ভাবন করে সবার নজর কেড়েছেন বরিশাল আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘সবজি ও মসলা চাষে গবেষণা সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্পের আওতায় এখনকার বিজ্ঞানীরা ২০১৭ সাল থেকে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা চাষ এবং এই ধাপে কৃষির রোগবালাই নিয়ে গবেষণা করেন। ৩ বছরে এবার কাক্সিক্ষত সাফল্য এসেছে তাদের। গবেষণা কেন্দ্রের একটি পুকুরে ১৫টি মাচায় ঝুলে আছে সারি সারি লাউ, শসা, কুমড়াসহ শোভা পাচ্ছে পিয়াজ, রসুন, লাল শাকসহ বিভিন্ন সবজি।

আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলীমুর রহমান জানান, একটি প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রের মধ্যে একটি পুকুরে কচুরিপানা দিয়ে বিশেষ কায়দায় ভাসমান ধাপ তৈরি করে তার ওপর পরীক্ষামূলকভাবে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শসা, টমেটো, চিচিংগাসহ বিভিন্ন সবজি ও মসলা চাষ করেছেন। ৩ মাস আগে তৈরি করা ভাসমান ধাপগুলোতে যেন বিষমুক্ত সবজির বিপ্লব হয়েছে। প্রতিদিন এই প্রদর্শনী দেখতে আসছেন আশপাশের আগ্রহী অনেক কৃষক। তারা আগামীতে ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন।

ভাসমান ধাপে কৃষি কাজে নিয়োজিত কেন্দ্রের কর্মচারী আল আমিন বলেন, কচুরিপানা দিয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট উঁচু স্তূপ বানিয়ে কিছুটা পচে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট দূরত্বে ধাপের দুইদিকে সবজি চারা রোপণ করা হয়। একবার কিছু সার পানিতে গুলিয়ে চারার আশপাশে দেওয়া হয়। প্রতিদিন পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয় ধাপ। চারাগুলো বড় হতে থাকলে ধাপের দুই পাশে মাচা তৈরি করে দিতে হয়। এভাবে ৩ মাসের মধ্যেই ফলন হয় ভাসমান ধাপে। প্রদর্শনীতে বিষ ছাড়া উৎপাদিত সবজি খেতেও সুস্বাদু বলে তিনিসহ অন্যরা জানান।

পিরোজপুরের নাজিরপুর থেকে ভাসমান সবজি চাষ দেখতে এসেছেন ফেরদৌস হাওলাদার। তিনি বলেন, আগে তারা এই পদ্ধতি সম্পর্কে জানতেন না। ২/৩ বছর ধরে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের পরামর্শে স্বল্প পরিসরে ভাসমান কৃষি করছেন। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের ভাসমান ধাপের ফলন দেখে আগামীতে আরও বড় পরিসরে ভাসমান কৃষি করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তিনি।

পিরোজপুরের নেছারাবাদ থেকে ভাসমান কৃষি দেখতে আসা কৃষক আবদুল মালেক বলেন, আগে তারা বংশ পরম্পরায় জলাবদ্ধ জমিতে ভাসমান ধাপ তৈরি করে শুধু সবজি চারা উৎপাদন করতেন। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ পেয়ে আগামীতে ভাসমান ধাপে দীর্ঘমেয়াদি সবজি উৎপাদনের চিন্তা করছেন তিনিসহ অনেক কৃষক।

প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, দেশের ১৩ জেলার ২৫ উপজেলায় ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষে গবেষণা সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে বরিশাল কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রদর্শনীতে ব্যাপক ফলন হয়েছে। কৃষকরা আগ্রহ ভরে এই প্রদর্শনী দেখতে আসছেন। ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি ও মসলা উৎপাদনের উদ্যোগ নিলেই কৃষক লাভবান হবে বলে আশা তার।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল ওহাব বলেন, বর্ষার সময় দেশের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৩০ লাখ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে। এ সময় কৃষকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। শাক-সবজির অভাব হয়। শত বছর ধরে বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান ধাপে বিভিন্ন সবজি চারা উৎপাদন হলেও এখন থেকে গবেষণার মাধ্যমে ভাসমান ধাপে কোনো সবজি ভালো ফলন হয় কিংবা ভাসমান ধাপে সবজির রোগবালাই শনাক্ত করে প্রতিকার করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর