বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

জয়পুরহাটে দাদনের জালে নিঃস্ব সহস্রাধিক পরিবার

কিডনি বিক্রি ঘরছাড়া অনেকে

মাজেদ রহমান, জয়পুরহাট

দাদনই সর্বনাশ ডেকে এনেছে এলাকার সহস্রাধিক পরিবারে। দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব জেলার কালাই উপজেলার অন্তত ১০ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ। মূল টাকা পরিশোধের পর সুদের অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে না পারায় এদের মধ্যে অনেকে এখন বাড়িছাড়া, আবার অনেককে জড়ানো হয়েছে মিথ্যা মামলায়, নিজের কিডনি পর্যন্ত বিক্রি করেছেন কয়েকজন। খোদ পৌরসভা সদরেই রয়েছেন অন্তত ২০ জন বড় দাদন ব্যবসায়ী। আর উপজেলার আহম্মেদাবাদ, মাত্রাই, উদয়পুর, পুনট ও জিন্দারপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে রয়েছেন দাদন ব্যবসায়ীদের অন্তত ৫০ জন।  দাদন ব্যবসায়ীরা প্রথমে একটি সমিতি করেন, যা রেজিস্ট্রেশনবিহীন। এরপর ওই সমিতি থেকে চালানো হয় অবৈধ এ ব্যবসা। অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও টাকা খাটান দাদনে। এই নামসর্বস্ব সমিতির মালিকরা সাধারণ মানুষদের ব্যবসা প্রসার, কৃষি, বিবাহ, অসুখ-বিসুখ কিংবা বিপদে পড়া মানুষদের টার্গেট করে ফাঁদে ফেলেন। এরপর ব্যাংকের ফাঁকা চেক এবং স্ট্যাম্প স্বাক্ষর নিয়ে মাসিক শতকরা ২০ থেকে ৩০ টাকা সুদে টাকা ধার দেন। এভাবে মূল টাকা ও সুদ ওঠানোর পর অতিরিক্ত সুদ দিতে না পারলে ওই স্ট্যাম্পে ইচ্ছেমতো টাকা বসিয়ে গদ লিখে এবং চেক ডিজঅনার করিয়ে মামলা করেন। এমন ফাঁদে পড়া জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বাগইল গ্রামের কিডনি বিক্রেতা মিজানুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, উদয়পুর ইউনিয়নের সারুঞ্জা গ্রামের ফিরোজ কবিরের কাছ থেকে অভাবের কারণে তিনি দুবারে ৫৫ হাজার টাকা নিয়েছিলেন দুই বছর আগে। এ পর্যন্ত সুদে-আসলে ১ লাখ ৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। এখনো দাদন ব্যবসায়ীর দাবি ১ লাখ ৬০ হাজার। দাদন ব্যবসায়ীর চড়া সুদের টাকার জোগান দিতে তিনি একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে কিডনি বিক্রি করেছেন। কিন্তু এখনো ঋণ শোধ হয়নি। তার মতে, দাদন ব্যবসা বন্ধ করা না গেলে কিডনি বিক্রি বন্ধ করা যাবে না।

এমন আরেকজন মাজেদুর রহমান মিঠু জানান, কালাই হাসপাতাল সড়কে তার হার্ডওয়্যার ব্যবসার উন্নতির জন্য দাদন ব্যবসায়ীরা দোকানে বেশি মালামাল তোলার পরামর্শ দেন। মাসিক শতকরা ২০ টাকা সুদে কালাইয়ের কাজীপাড়া মহল্লার বাবুল শিকদার ও মুন্সিপাড়া মহল্লার মিজানুর রহমান তার কাছ থেকে স্বাক্ষর করা ব্যাংকের ফাঁকা চেক এবং স্ট্যাম্প নিয়ে ৫০ হাজার করে ১ লাখ টাকা দেন। তিন বছর ধরে ওই দুই দাদন ব্যবসায়ীকেই সুদে-আসলে পৃথকভাবে আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করেছে তিনি। মুন্সিপাড়া মহল্লার মিজানুর রহমানের কাছ থেকে স্বাক্ষর করা ব্যাংকের ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প ফেরত পেলেও কালাইয়ের কাজীপাড়া মহল্লার বাবুল শিকদার তার বিরুদ্ধে সাড়ে তিন লাখ টাকা পাওনা দাবিতে মামলা করেছেন। মামলার ভয়ে এখন তিনি পলাতক। দোকান ছেড়ে দিয়েছেন।

দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে এমন ভাবে নিঃস্ব হয়ে বাড়িছাড়া এবং মামলায় জড়িয়ে পড়ার মধ্যে রয়েছেন কালাই পৌর এলাকার থুপসাড়া মহল্লার মাহবুবুল আলম, একই গ্রামের সউদ হোসেন, খোসালপুর নওপাড়ার উজ্জ্বল, একই গ্রামের আব্বাস আলী; হাতিয়র কাজীপাড়ার হাব্বুল, একই গ্রামের রেজাউল; বামন গ্রামের সোহরাব, একই গ্রামের হাফিজার; বলিগ্রামের পল্লী চিকিৎসক শেখর চন্দ্র সরকার; বিনইল গ্রামের রিপন, একই গ্রামের আবদুল কাদের এবং তার ভাই দুলালসহ অনেকে।

কিডনি বিক্রির কারণ ও দাদন ব্যবসা নিয়ে গবেষণা কাজে কালাইয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (উন্নয়ন অধ্যয়ন) বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজুল হক বলেন, কালাইয়ে যে দাদন ব্যবসা হচ্ছে, এর জন্য দায়ী এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনে থাকা কর্তাব্যক্তিরা। এখনে যে অবস্থা, তাতে কিডনি বিক্রি করলেও এদের ঋণ শেষ হবে না। সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই এখানকার জনপ্রতিনিধিদের। দুষ্টচক্রকে প্রতিহত করা না গেলে এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং কিডনি বিক্রি রোধ সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল লতিফ খান জানান, দাদন এখন দেশব্যাপী চলমান একটি সামাজিক ব্যাধি। থানা এলাকায় যারা দাদন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর