বৃহস্পতিবার, ১৮ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

দুই বছরে গ্রাহক সংযোগ সাড়ে আট হাজার

সাবমেরিন ক্যাবলে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় সন্দ্বীপে

সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

দেশে প্রথমবারের মতো সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ১৬ কিলোমিটার সমুদ্রের তলদেশে ক্যাবল স্থাপন কাজ শেষ করে। কিন্তু সংযোগ স্থাপনের প্রায় দুই বছরেও গ্রাহক সংযোগ দেওয়া হয়েছে মাত্র সাড়ে আট হাজার। লক্ষ্যমাত্রার বাকি পরিবারগুলোতে সংযোগ দিতে নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। দ্বীপের বিভিন্ন ইউনিয়নে বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন ও মিটার সংযোগে অস্বাভাবিক অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এতে প্রকল্প শেষেও সংযোগ কাজের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। অন্যদিকে প্রথমে তেলে চালিত জেনারেটরের মাধ্যমে ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে মাত্র আড়াই হাজার গ্রাহককে দৈনিক ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করত পিডিবি। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনজর ও স্থানীয় এমপি মাহফুজুর রহমান মিতার আন্তরিক প্রচেষ্টায় সন্দ্বীপের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে তৎপর রয়েছেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি সন্দ্বীপের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের ছয়জন বাসিন্দা সন্দ্বীপে পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষে। ৪ জুন পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলীর কাছে দেওয়া লিখিত ওই অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়, সঞ্চালন লাইন স্থাপনে খুঁটিপ্রতি নগদ অর্থ দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। স্থানীয় সাবেক জনপ্রতিনিধি বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইউনিয়নের ১৫টি পরিবারের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন। এরই মধ্যে অন্যান্য এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর জন্য খুঁটিপ্রতি ৫ হাজার টাকা করে দাবি করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলী ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘নতুন বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ চলমান প্রকল্পের। ওই প্রকল্পের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের সম্পর্ক নেই। তবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সবার আগে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এ কারণে কেউ কেউ না চাইলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পে কর্মরতদের নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেওয়ার বিষয়টি শুনেছি।’ মিটার স্থাপন বা সংযোগ নিতে অর্থ দাবির বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। পিডিবি ও স্থানীয় সূত্র জানায়, সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ১৪৪ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাবমেরিন ক্যাবল প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘জেডটিটি’ নামের একটি কোম্পানি সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের কাজ পায়। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি চীনের এসবি সাবমেরিন সিস্টেমস কোম্পানি লিমিটেডের সহযোগিতা নেয়। চট্টগ্রামের স্থলভাগ থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের তলদেশের কয়েক ফুট মাটির গভীরে দুটি ক্যাবল স্থাপন করা হয়।

সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বর্তমানে ১০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব। তবে সক্ষমতা বাড়ানো হলে এই লাইনের মাধ্যমে ৬০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া যাবে। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহের আগে দুটি জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মাত্র আড়াই হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। বর্তমানে প্রায় আট হাজার গ্রাহকের কাছে ২ দশমিক ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সন্দ্বীপের একাধিক ভুক্তভোগী বাসিন্দা বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জোগসাজশে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা বৈদ্যুতিক খুঁটি স্থাপন এবং সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে দফায় দফায় অর্থ আদায় করছেন। মূল সড়ক থেকে গ্রামাঞ্চলের উপসড়কগুলোতে বিদ্যুতের খুঁটি বসাতে তারা দুই দফায় অর্থ আদায় করছেন। এ ক্ষেত্রে খুঁটিপ্রতি ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের এসব অনিয়ম নিয়ে একাধিক আন্দোলন হলেও বিদ্যুৎ সংযোগ এবং খুঁটি বসানোর কাজ বন্ধ রাখার মাধ্যমে আগ্রহী গ্রাহকদের টাকা প্রদানে বাধ্য করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুর রহিম ক্ষোভের সঙ্গে অভিযোগ করে বলেন, ‘বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানের জন্য প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা। বর্তমানে প্রতিটি খুঁটি বসাতে ২ হাজার টাকা হিসাবে ৩২ হাজার টাকা দাবি করা হচ্ছে। আমরা স্থানীয়ভাবে টাকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে খুঁটি স্থাপনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’

পিডিবির চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্যুৎ সংযোগ বৃদ্ধি প্রকল্পের উপ-প্রকল্প প্রধান মো. শহীদুল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে ১ হাজার ৪২১ কোটি টাকার প্রকল্প চলমান রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের অধীনে চলতি জুন মাসের মধ্যে চট্টগ্রামে নতুন ৫ লাখ বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। সন্দ্বীপের গ্রাহকসংখ্যা ২০ হাজারে উন্নীত করা হবে। ফলে গ্রাহকদের কাছ থেকে খুঁটি স্থাপন কিংবা বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানে অর্থ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে স্থানীয়ভাবে কোনো প্রভাবশালী কিংবা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করলে আমাদের কিছুই করার নেই।’

পিডিবি, স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ পায় চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রায় ৫ লাখ পরিবার বা নতুন সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক মেগা প্রকল্পের অধীনে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে ২০ হাজার বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয় প্রকল্পের অধীনে। এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে আট হাজার পরিবার বা গ্রাহককে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি নতুন সংযোগ দিতে মিটার স্থাপনে পিডিবি নির্ধারিত অর্থের চেয়েও বেশি টাকা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি সন্দ্বীপের বিভিন্ন ইউনিয়নে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিতে পিলার স্থাপনে দ্বীপের জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে। এই প্রচেষ্টায় বাধার সৃষ্টি করে নানা কৌশলে সাধারণ মানুষদের ভুল বুঝিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এতে ক্ষুণ্ন হচ্ছে সরকারের ইমেজ। তদবির করে বিদ্যুৎ এনে দেওয়ার নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে সারিকাইত ইউনিয়ন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক এক মেম্বারের বিরুদ্ধেও। এখানেই জনসাধারণের মধ্যে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ। স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা, জনপ্রতিনিধি ও সরকারের বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নাম ভাঙিয়ে কিছু অনৈতিকতা করার চেষ্টা চলছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর