বুধবার, ১ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে করোনা

এযাবৎ আক্রান্ত ৫০, মৃত্যু ৫, সুস্থ ৩

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তর শরণার্থী ক্যাম্প কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে ব্যাপক মাত্রায় করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল সরকার ও বৈদেশিক সংস্থাগুলো। কিন্তু এখনো পর্যন্ত শিবিরের ৩২টি ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রয়েছে করোনা। এর পরও ঝুঁকি এড়াতে আক্রান্তদের অন্য জায়গায় আইসোলেশনে রেখে এবং আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থাগুলোর যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধ করার কথা ভাবছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সরকারি সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, ২৮ জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন। টেকনাফ আর উখিয়ার ৩২টি ক্যাম্পের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার একর জমিতে বসবাস করছে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা। লোখসংখ্যা অনুপাতে এখানে আক্রান্তের হার একেবারেই নগণ্য। বাংলাদেশে মার্চের ৮ তারিখ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার ৩৭ দিনের মাথায় কক্সবাজারে প্রথমবারের মতো একজন রোহিঙ্গার শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়ে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর ১১ মার্চ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প অবরুদ্ধ রাখা হয়। কেবল পানি, স্যানিটেশন, চিকিৎসা, এলপি গ্যাসের গাড়ি ও খাবার বিতরণের সঙ্গে জড়িত এনজিওগুলোর যানবাহন এবং এসব কাজে নিয়োজিতদের প্রবেশাধিকার রাখা হয়। ফলে করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির শুরু থেকেই কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় আমরা ক্যাম্প এলাকায় কঠোর সতর্ক অবস্থানে ছিলাম এবং এখনো পর্যন্ত সেই অবস্থানেই আছি। আমরা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যাম্প থেকে কোনো ব্যক্তির বের হওয়া ও প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়া অবস্থানে ছিলাম। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোও সহায়ক ভূমিকা রেখে আসছে। তারা সাত দিন, ১৫ দিন করে রোস্টার করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির সুবিধা দিয়ে আসছে। ফলে এখানে করোনা বেশি সংক্রমণ হতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘এর পরও সরকার এবং বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা বিশ্বের এই বৃহত্তম শরণার্থী ক্যাম্পে করোনা সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকির শঙ্কায় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন স্থানে পর্যায়ক্রমে ১ হাজার ৯০০ আইসোলেশন বেডের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫০০ বেড আইসোলেশন সেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। এ ছাড়া জিনগত কারণে রোহিঙ্গাদের শারীরিক ইউমিনিটি আমাদের চেয়ে বেশি এবং তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি। সব মিলিয়ে এখানে এখনো পর্যন্ত কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রয়েছে।’

তবে এই নিয়ন্ত্রিত অবস্থা কত দিন ধরে রাখা যায় তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসির। তিনি বলেন, অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ এই শরণার্থী ক্যাম্পে গাদাগাদি করেই বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। এমনিতেই তারা নানা কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সচেতনতার প্রবণতাও খুব কম। তাই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখেই এখানে কাজ করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সরকারকে।

এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কম রোগী শনাক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কম পরীক্ষা হওয়ার বিষয়টিও একটি কারণ বলে মনে করছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতারা। কুতুপালংয়ের পশ্চিম-১ ক্যাম্পের মাঝি (নেতা) মোহাম্মদ নূর বলেন, করোনাভাইরাস পরীক্ষা নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে। রোগ ধরা পড়লে যদি পরিবার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়!

এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনার কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. তোহা ভূঁইয়া বলেন, ক্যাম্পে এখন প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি ও আতঙ্কের কথা জানা গেলেও চিকিৎসকদের সামনে সরাসরি তারা এ বিষয়ে কিছু বলে না। ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে ডা. তোহা বলেন, যত বেশি টেস্ট হবে, প্রকৃত চিত্র পাওয়া তত সহজ হবে। ইতিমধ্যে নমুনা পরীক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে ও সাহস জোগাতে ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে, যেন অসুস্থ বোধ করলেই নমুনা দেওয়া হয়। এতে সফলতাও আসছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, করোনায় আক্রান্তদের ফ্যামিলি মেম্বার বা তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছে, তাদের শনাক্ত করে কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে রাখা হচ্ছে। এ পর্যন্ত সাত-আটশ লোককে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। অনেকে ভালো হয়ে ফিরে যাচ্ছে তাদের ক্যাম্পে। চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা পাচ্ছে তারা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বাইরের তুলনায় ‘অনেক কম’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, শূন্যের কোঠায় তো এখনই আনা যাবে না, তবে ধীরে ধীরে কমে আসবে আক্রান্তের সংখ্যা।

এদিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে অনেক ছোট জায়গায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাসের কারণেই এ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল। এ কারণে ক্যাম্পগুলো ৪ মার্চ থেকে আংশিক ও ১৪ মার্চ থেকে পুরোপুরি লকডাউন করে দেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গারা সরকারি বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে সামাজিক দূরত্বসহ অন্যান্য আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা না মেনে লকডাউন ভেঙে ফেলে। এতে প্রশাসন ও স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়তে থাকে। দীর্ঘ দুই মাসেরও বেশি সময় রোহিঙ্গাদের করোনামুক্ত রাখা গেলেও এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রথমবারের মতো সেখানে থাবা বসিয়েছে এ মহামারী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর