বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর লাশ আটকে ছেলেকে পুলিশে দিল ইন্টার্নরা

শেষ পর্যন্ত লাশ নেওয়া হলো মুচলেকা দিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

আবারও পুরনো চেহারায় ফিরলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। গতকাল সকালে বিনা চিকিৎসায় মারা যান মুক্তিযোদ্ধা ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ইসাহাক আলীর স্ত্রী পারুল বেগম (৬৫)। মায়ের চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিবাদ করেন ছেলে শিক্ষা কর্মকর্তা রাকিবুল। এরপর একদল ইন্টার্ন চিকিৎসক জোটবদ্ধ হয়ে রাকিবুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। মারধরের পর মা পারুল বেগমের লাশ আটকে রেখে ছেলেকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। এ সময় ইন্টার্ন চিকিৎসকরা হাতজোড় করে ক্ষমা চাওয়ার দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করেন। শেষে ছেলে রাকিবুলকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুক্তার হোসেন থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রাকিবুলকে আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ। ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর মুচলেকা দিয়ে স্ত্রীর লাশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনেন মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সুচিকিৎসা নিশ্চিতে সরকারের বারবার নির্দেশনার পরও ইন্টার্নিদের বেপরোয়া আচরণ কমেনি। উল্টো নিরাপত্তার কথা বলে তারা রামেক হাসপাতালে বিক্ষোভ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী অভিযোগ করেন, তার স্ত্রী পারুল ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গতকাল ভোরের দিকে মাথায় প্রচ- ব্যথায় প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন পারুল। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। সকাল ৭টার দিকে তাকে রাজশাহী মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান তারা। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে পৌনে ৮টার দিকে প্রথমে পারুলকে পাঠানো হয় ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে।

সেখানে তখন কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। রোগী বেশ কিছুক্ষণ মেঝেতেই পড়ে ছিলেন। আধঘণ্টা পর পারুলকে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় ছেলে রাকিবুল হক লিটন ওয়ার্ডে দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসক শোভন সাহার কাছে গিয়ে তার মাকে দেখার জন্য অনুরোধ করেন। শোভন সাহা বলে দেন, তার ডিউটি শেষ। পরের চিকিৎসক এসে দেখবেন। এরপর লিটন যান আরেক ইন্টার্ন চিকিৎসক আবদুর রহিমের কাছে। তিনিও জানিয়ে দেন, তিনি এখন বের হবেন, রোগী দেখতে পারবেন না। এভাবেই কেটে যায় আধঘণ্টা। শেষে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই পারুল বেগম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেন, চিকিৎসা ছাড়াই মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ছেলে রাকিবুল ওয়ার্ডের ভিতরই উচ্চ স্বরে কান্নাকাটি করছিলেন। এ সময় ইন্টার্ন চিকিৎসক শোভন সাহা ও আবদুর রহিমসহ আরও কয়েকজন এসে তাকে গালাগাল দিয়ে ওয়ার্ড থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় রাকিবুলের সঙ্গে দুই ইন্টার্ন চিকিৎসকের ধস্তাধস্তি হয়। এর পরই এই দুই ইন্টার্ন অন্য ইন্টার্নদের ফোন করে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে ডেকে আনেন। পরে রাকিবুলকে আটক করে বেধড়ক মারধর চলে কিছু সময়। এ সময় রোগীর স্বজনদের ওয়ার্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর মৃত পারুল বেগমের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীসহ স্বজনরা লাশ চাইলে ইন্টার্নরা লাশ আটকে ঘিরে পাহারা বসান। শেষে দুপুর সোয়া ১টার সময় মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে হাসপাতাল থেকে স্ত্রীর লাশ নিয়ে যান। তবে পুলিশ ডেকে পারুল বেগমের ছেলে রাকিবুলকে রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে হস্তান্তর করেন ইন্টার্নরা।

মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী বলেন, ‘আমরা হাসপাতালের ডাক্তারদের যে ভয়ঙ্কর চেহারা দেখলাম তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভোলার নয়। যেখানে মানুষ বাঁচার জন্য আসে, সেখানে এরা কারা, কোন সমাজের মানুষ জনসাধারণের সেবা দিচ্ছে? এত অরাজকতার প্রতিকার কী? আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি এমন অরাজকতা আর ভয়াবহতা দেখার জন্য?’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে অন্যায়ভাবে ও ঘটনা সাজিয়ে ইন্টার্নরা পুলিশে দিয়েছে। সে তার মায়ের মরামুখটাও দেখতে পারবে না- এ কেমন দেশ!’

রাজপাড়া থানার ওসি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের সব ওয়ার্ডে চিকিৎসা বন্ধ করে বসে ছিলেন। খবর পেয়ে আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থলে যান। তারা পরিস্থিত হয়ে নিয়ন্ত্রণ আনেন। দুপুরের পর পারুল বেগমের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ছেলে রাকিবুলকে পুলিশ আটক করেছে।

ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের নেতা মিজান জানান, পারুল বেগমের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ সঠিক নয়। তার ছেলে রাকিবুলের হামলায় ইন্টার্ন শোভন ও রহিম আহত হয়েছেন। তবে এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা সাংবাদিকদের ফোন ধরেননি। ঘটনার পর কোনো সাংবাদিককে হাসপাতালে ঢুকতেও দেওয়া হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আটরশিয়া গ্রামে। পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা ইসাহাক আলী পরিবার নিয়ে নগরীর সাগরপাড়া টিকাপাড়ায় বসবাস করেন। ছেলে রাকিবুল শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর