সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

এমন বৃষ্টি দেখেনি রংপুরবাসী

১১০ বছর পর এমন বৃষ্টি, পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী

নজরুল মৃধা, রংপুর

রংপুরে এক রাতের বৃষ্টিতে মহাপ্লাবন হয়েছে। ১১০ বছর আগে রংপুরে এমন বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টিতে নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ড, সড়ক, মহাসড়ক কোমরপানি পর্যন্ত তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫ লাখের ওপর মানুষ। খাল-বিল ও পুকুরের কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছে নগরীর নিম্নাঞ্চলের মানুষ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ১৫ ঘণ্টায় ৪৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া পরশু রাত ১১টা থেকে গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত নগরী ছিল বিদ্যুৎবিহীন। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কেও মারাত্মক বিঘ্ন ঘটে। বেশ কিছু প্লাবিত এলাকার লোকজন স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সন্ধ্যা থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হলেও রাত ১০টা থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। তা চলে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত। টানা বৃষ্টিতে কামালকাছনা, শাহিপাড়া, খাসবাগ, মুন্সিপাড়া, কামারপাড়া, শালবনসহ নগরীর দেড় শতাধিক পাড়া-মহল্লা ২ থেকে ৩ ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ভোগান্তিতে পড়ে নিম্নাঞ্চলের ৮ লাখ মানুষ। কাঁচাবাড়ির বাসিন্দারা ছিল চরম বিপাকে। অনেকের বাড়ি ও রান্নাঘরে পানি প্রবেশ করে চুলা জ্বলেনি। একে তো বৃষ্টি, এর ওপর বিদ্যুৎ বিভ্রাট। ঘরে পানি প্রবেশ করায় এবং বিদ্যুৎ না থাকায় অনেকে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। অনেকের মনে হয়েছিল নুহ নবীর আমলের প্লাবন শুরু হয়েছে। কামালকাছনা এলাকার গৃহিণী মনিরা বেগম  জানান, তার ঘরে পানি ঢোকায় সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে। রান্না করতে পারেননি। হোটেল থেকে খাবার কিনে খেয়েছেন। মুন্সিপাড়া এলাকার রতন মিয়া বললেন, বৃষ্টিতে তার ঘর ও উঠানে হাঁটুপানি। এদের মতোই ভোগান্তিতে পড়েন কয়েক লাখ মানুষ। এ জন্য তারা অপরিকল্পতি নগরায়ণকে দায়ী করেছেন। নগরীর কেরানীপাড়া এলাকার ১০৩ বছর বয়সী আবু মিয়া বলেন, তিনি তার জীবদ্দশায় এমন বৃষ্টিপাত হতে দেখেননি। তার বাড়িতেও পানি উঠেছে। নগরীর প্রধান সড়ক জাহাজ কোম্পানি মোড়, টাউন হল চত্বর, কাচারিবাজার, গ্র্যান্ড হোটেল মোড়, স্টেশন রোড ছিল হাঁটুপানির নিচে।

অন্যান্য দিন নগরীতে ব্যস্ততা দেখা গেলেও গতকালের চিত্র ছিল একাবারেই ভিন্ন। নগরীতে অটোরিকশার চলাচল ছিল সামান্য। অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। শ্রমজীবী মানুষ কাজ না পেয়ে ছিল বেকায়দায়।

এদিকে বৃষ্টিতে নগরীর প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত শ্যামাসুন্দরী ও ক্যডিখাল দুকূল উপচে পানি নগরীর বিভিন্ন বাসাবাড়িতে প্রবেশ করে। এ ছাড়া কুকরুল বিল, চিকলি বিলসহ অসংখ্য পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। সকালে নগরীর রাস্তায় লোকজনকে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। দুপুর ১টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। তবে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক হতে সময় লাগে।

এদিকে প্রবল বর্ষণের ফলে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ছিল বস্তি এলাকার মানুষ। নগরীর কয়েকটি বস্তি ও কলোনির হাজার হাজার মানুষের গতকাল সারা দিন চুলা জ্বলেনি। কেউ কেউ খাবার বাইরে থেকে কিনে খেলেও অধিকাংশ গরিব মানুষই ছিল অর্ধাহারে।

এদিকে বর্ষণের সুযোগে নগরীর ছালেক মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চুরি হয়েছে। এ ছাড়া অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় পণ্য নষ্ট হয়ে গেছে। জেলা ত্রাণ অফিস এখন পর্যন্ত বর্ষণে কত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিরূপণ করতে পারেনি।

এদিকে রংপুর নগরী ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায় বৃষ্টিপাত হলেও তা ততটা প্রকট ছিল না।

রংপুর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মাহামুদুর রহমান টিটু বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মেয়র ও কাউন্সিলররা এলাকা ভাগ করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছি। নগরীর সেনপাড়া, মুলাটোল, রাধাবল্লভসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লাবিত লোকজনকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ে আশ্রিত পরিবারগুলোকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান বলেন, ‘আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যতটুটু জেনেছি, তা হলো ১৯১০ সালের দিকে রংপুরে এমন প্রবল বর্ষণ হয়েছিল। ১১০ বছর পর আবার এমন বর্ষণ হলো। শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত ৪৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর