সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপৎসীমা ছাড়াল সাত নদীর পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিপৎসীমা ছাড়াল সাত নদীর পানি

টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে রংপুরের প্রায় সব এলাকা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল সকালে সুনামগঞ্জে যদুকাটা নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নামলেও নতুন করে বিপৎসীমা ছাড়িয়েছে টাঙ্গন, করতোয়া ও যমুনেশ্বরী নদী। এতে গতকাল সকালে ৭টি নদী বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি অব্যাহত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন মাসের মধ্যে পঞ্চম দফা বন্যা আঘাত হেনেছে উত্তরের জেলাগুলোয়। অবিরাম বর্ষণ ও উজানের ঢলে তলিয়ে গেছে কুড়িগ্রাম, রংপুর, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ ও দিনাজপুরের নিম্নাঞ্চল ও চরগুলো। ঠাকুরগাঁওয়ে পানির তোড়ে হারিয়ে গেছে ছয় মাস আগে কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা পাকা সড়ক। একের পর এক বন্যার আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। আবারও পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের। কাজ না থাকায় দেখা দিয়েছে অর্থসংকট। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বানভাসি মানুষগুলো। সেই সঙ্গে নদী ভাঙনে প্রতিদিন ভিটেমাটি হারিয়ে পথে বসছেন অসংখ্য মানুষ। গত চার  দফা বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৩ জেলার লাখো কৃষক। পানি নেমে যাওয়ায় আশায় বুক বেঁধে নতুন করে আবাদ শুরু করে দেশের মানুষের জন্য খাদ্যের জোগান দেওয়া দরিদ্র মানুষগুলো। পঞ্চম দফা পানি বৃদ্ধিতে সেই ফসলও তলিয়ে গেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল সকালে জানায়, ২৪ ঘণ্টায় ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানিসমতল স্টেশনের ৬৪টিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ধরলা, যমুনেশ্বরী, করতোয়া, যমুনা, গুড়, টাঙ্গন ও আত্রাই নদী। গঙ্গা ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার সব প্রধান নদীর পানি বাড়ছে।

এ ছাড়া আজ বাড়তে পারে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মার পানিসমতল। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

দিনাজপুর : টানা বৃষ্টিপাত ও উজানের ঢলে দিনাজপুরের বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের মানুষ। গতকাল জেলার আত্রাই নদী বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং পুনর্ভবা ও ইছামতি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে পুনর্ভবা। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় ফুলবাড়ী উপজেলার শিবনগর ইউপির ঘাটপাড়া এলাকার মানুষ কলেজিয়েট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ও আদর্শ কলেজে আশ্রয় নিয়েছে।

ঠাকুরগাঁও : জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় ভারি বর্ষণে পানিতে ভেসে  গেছে ছয় মাস আগে কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাউনিয়া-সাবাজপুর সড়কটি। স্থানীয়দের অভিযোগ, মাটি ভরাট করে উঁচু না করে রাস্তা নির্মাণ ও নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের কারণে দ্বিতীয়বারের মতো রাস্তাটি পানির ধাক্কায় হারিয়ে গেছে। এতে মূল শহরের সঙ্গে জাউনিয়া, সাবাজপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সাবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এক বছরও হয়নি রাস্তাটি পাকা হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে প্রায় ৮০ শতাংশ রাস্তা ভেসে গেছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী মাইনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায় মাটি হলো বেলে মাটি। একটু চাপ দিলেই ভেঙে যায়। ৬ মাস কেন, ২/১ মাসেও রাস্তা ভাঙতে পারে। এটা কোনো ব্যাপার নয়। বৃষ্টি কমলেই আমরা রাস্তা মেরামতের কাজে হাত দেব।

কুড়িগ্রাম : জেলায় পঞ্চম দফা বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজারহাট আবহাওয়া অফিস জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৭৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে যা চলতি বর্ষা মৌসুমে সর্বোচ্চ। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত চলমান থাকবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শামসুজ্জামান মিয়া জানান, বন্যায় নতুন করে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমির আমনসহ ১৮ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী, মোগলবাসা, হলোখানা, রাজারহাটের ছিনাই, মহিধর, মীরেরবাড়ি, দেবালয় এবং ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ও শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের শত শত হেক্টর জমির শীতকালীন আগাম ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। ৬ উপজেলার ৬৭টি পয়েন্টে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙনে গত দুই দিনে বিভিন্ন এলাকার  দেড় শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে বাঁধ ও রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে।

বগুড়া : বগুড়ায় সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী এলাকায় চাষকৃত ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নতুন করে যমুনা ও বাঙ্গালি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নদী এলাকার আউশ, আমন, সবজির খেত তলিয়ে গেছে। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপপরিচালক শাহাদুজ্জামান জানান, পানি বাড়ায় জেলার ১ হাজার ২৫ হেক্টর রোপা আমন, ৪৫ হেক্টর মাসকালাই, ৩২ হেক্টর সবজি, ৪ হেক্টর মরিচ নিমজ্জিত হয়ে আছে। পানি নেমে গেলে ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা যাবে। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা, গাবতলী, ধুনট, শেরপুর, শাজাহানপুর ও নন্দীগ্রাম উপজেলার কিছু কিছু খেত পানিতে তলিয়ে আছে।

লালমনিরহাট : জেলায় ধরলা ও তিস্তার পানি কমলেও ভাঙনে দিশাহারা তিস্তাপাড়ের হাজারো পরিবার। অবিরাম ভারি বর্ষণের কারণে চর এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। আদিতমারী উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে নদী ভাঙনের তীব্রতা দেখা গেছে। নদী তীরবর্তী এলাকার পরিবারগুলো ঘরের মালামাল নৌকায় ভাসিয়ে নিয়ে স্থানীয় গাইডবাঁধে আশ্রয় নিচ্ছে। গত ৫ দিনে তিস্তা ও ধরলা নদীর ভাঙনে সহস্রাধিক বাড়িঘর নদীতে হারিয়ে গেছে। শুধু আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসতভিটা তিস্তায় হারিয়ে গেছে। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, তিস্তার তলদেশ ভরাট হওয়ায় সামান্য পানি বাড়লেই বন্যা দেখা দেয়। নদী ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর খোঁজ নিতে সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর